কুরঙ্গমাতঙ্গ পতঙ্গভৃঙ্গমীনা হতাঃ পঞ্চভিরেব পঞ্চ ।
একঃ প্রমাদী স কথং ন হন্যতে যঃ সেবতে পঞ্চভিরেব পঞ্চ ।।
' মৃগ , হস্তী , পতঙ্গ , ভ্রমর ও মৎস্য - এই পঞ্চ - জীব পাঁচটি বিষয়ের এক একটির জন্য প্রাণ হারিয়ে থাকে ; তাহলে তো যে প্রমাদী একাই পঞ্চ - ইন্দ্রিয় সেবন করে সে কেমন করে বাঁচবে ? অতএব মনুষ্যমাত্রেরই উচিত যে , মন ও পঞ্চ - ইন্দ্রিয়কে বিষয় থেকে দূরে রেখে পরমাত্মার নিত্যযুক্ত করা ।
এই প্রসঙ্গে একটা গল্প শুনুন ।
এক চক্রবর্তী সম্রাট ঘোষণা করেছিলেন - ' আগামীকাল যে ব্যক্তি আমাকে দর্শন করতে সক্ষম হবে তাকে আমি যুরবাজ পদ দেব । আমি যে উদ্যানবাড়িতে বাস করি তা কাল সারাদিন অবারিত ( খোলা ) দ্বার থাকবে । যে কেউ আমার কাছে আসতে পারে । কারো জন্য বাধানিষেধ নেই ।
প্রত্যেকে বাড়িতে ঘুরে বেড়াবার জন কেবল দুই ঘন্টা সময় দেওয়া হবে , তার বেশি কাল কেউ ভিতরে থাকতে পারবে না । উদ্যানে প্রবেশ করে আমার কাছে আসবার জন্য কেবল আধ মিনির্টই যথেষ্ট , কারণ বাড়ির পথসকল সুগম ও সুলভ । অতএব যে ব্যক্তি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমার দর্শন করে নেবে তাকে যুবরাজ পদ দেওয়া হবে আর যে উদ্যানেই রমণ করতে থাকবে তাকে দুই ঘন্টা পর বের করে দেওয়া হবে । '
এই ঘোষণা রাজ্যের সর্বত্র প্রচারিত হল । আর সকাল হতেই লোকে উদ্যানে প্রবেশ করতে লাগল । বাড়ির দ্বারেই নিয়ামক - নিয়ন্ত্রণকর্তার নিবাসস্থান ছিল । সেই নিয়ন্ত্রণকর্তা উদ্যানে প্রবেশকারীকে একটি টিকিট দিচ্ছিলেন যার একটা প্রতিলিপি নিজের কাছে রেখে দিচ্ছিলেন । এইভাবে অনুমতিপত্র নিয়ে লোকে উদ্যানে প্রবেশ করতে লাগল । উদ্যানে ঢুকে কেউ নানারকম চামেলি , কেওড়া , গোলাপ পুষ্পের আঘ্রাণ উপভোগ করে বেড়াতে লাগল ; সুশীতল সুগন্ধযুক্ত বায়ু তাদের মুগ্ধ করেছিল
আবার আরও কিছু লোক এগিয়ে গিয়ে মেওয়া ও সমুধুর ফল পেড়ে খেতে লাগল । আরও কিছু লোক আরও এগিয়ে গিয়ে সার্কাস , সিনেমা , মিউজিয়াম , নাট্যভিনয় আর রত্নের স্তূপ আর সুবর্ণ রজতের মুদ্রা আর বহু ধরণের পূর্বে না জানা , না দেখা জিনিস প্রত্যক্ষ করতে লাগল । কিছু লোক রমণীদের সঙ্গে রমণ করতে লাগল , আরও কিছু লোক এগিয়ে গিয়ে যন্ত্রসংগীত , কন্ঠ সংগীত শুনতে লাগল ।
এইভাবে লোকেরা উদ্যানের সুখ , আরাম ও ভোগে যুক্ত থেকে রাজদর্শনে নিরাশ হল এবং অজ্ঞানতার বশীভূত হয়ে ভাবতে লাগল যে রাজার দর্শন করে কী হবে ! তাদের মধ্যে একজন বৈরাগ্যযুক্ত পুরুষ ছিলেন যাঁর মন ইন্দ্রিয় বশীভূত ছিল । তিনি সুখ , আরাম , স্বাদ , ভোগ আদিকে দূরে ঠেলে সোজা মহারাজের কাছে গিয়ে উপনীত হলেন । মহারাজ তাঁকে যুবরাজ পদ প্রদান করলেন ।
ব্যবস্থাপকের অনেক চর সেই উদ্যানে ঘুরছিল যারা নির্ধারিত সময় শেষ হওয়া মাত্রই টিকিট ছিনিয়ে নিয়ে তাদের উদ্যানের বাইরে বার করে দিচ্ছিল । কিন্তু যারা পুষ্প সুগন্ধ নিয়ে হাওয়া খাচ্ছিল তারা বলল - ' আমাদের আরও কিছুক্ষণ থাকতে দাও । ' কিন্তু দারোয়ানগণ কড়া ছিল , কেউ এক মিনিটও বেশি থাকতে পারছিল না - তারা তাদের ধাক্কা দিয়ে বের করে দিচ্ছিল ।
যে লোকেরা মেওয়া ও মধুর ফল খাচ্ছিল তারা দারোয়ানকে বলল - ' ভাই ! আমাদের দুুই মিনিট আরও থাকতে দাও । আমরা মেওয়া ও ফল একত্রে করেছি - বোঁচকাটা বেঁধে ফেলি । ' দারোয়ান জানাল -- ' এখান থেকে কেউ কোনো জিনিস সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে না । যা খেয়েছো তাতেই সন্তুষ্ট থাকো । ' এই বলে দারোয়ান বোঁচকা কেড়ে নিয়ে ধাক্কা মেরে তাদের বাইরে বের করে দিল ।
যারা বিনোদন ও অভিনয় প্রভৃতি দেখছিল তারা তো উঠতে চাইছিল না কিন্তু সেইখানে কেউ এক মিনিটও বেশি থাকতে পারে কি ? দারোয়ান তাদের জোর করে বাইরে বের করে দিল । কতলোক টাকা , মোহর ও রত্নের পুঁটলি করে নিল । দারোয়ান জিজ্ঞাসা করল - ' এইটা কি ? ' তুমি পুঁটলি কেন বেঁধেছ ? ' তারা বলল - ' এই টাকা , মোহর ও রত্ন আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাব । ' দারোয়ান তাদের লাঠিপেটা করতে করতে বলল - ' মূর্খগণ ! এইগুলি তোমরা কেবল দর্শনই করতে পার । এইখান থেকে কেউ এক আধলাও সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে না । '
তাদের বাঁধা পুঁটলি ছেড়ে যেতে বড় দুঃখ হচ্ছিল ; কিন্তু উপায় ছিল না , বাধ্য হয়ে ছেড়ে যেতেই হবে । যারা রমণীসঙ্গ উপভোগ করছিল তারা কিছুতেই বাইরে যেতে চাইছিল না কিন্তু আইনত দারোয়ান এক মুহূর্তও সেইখানে থাকতে দিল না । সময় শেষ হতেই দারোয়ান লাঠি মেরে তাদের বাইরে বের করে দিল আর যারা সংগীত আদি শুনছিল তারা তো জানতই না যে কত কাল অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে । দারোয়ান তাদের টিকিকের নম্বর দেখে বলল - ' চলো তোমাদের যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে । '
যারা শুনছিল তারা বলল - ' আরে ভাই ! এই গানটা তো পুরো শুনতে দাও । ' দারোয়ান বলল - ' তোমাদের সময় শেষ হয়ে গিয়েছে , তোমরা আর এক মুহূর্তও এইখানে থাকতে পারবে না । ' তারাও লাঠিপেটা খেয়ে উদ্যান থেকে বেরিয়ে এল ।
এটি একটি কল্পিত উদাহরণ । এক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে যে , চক্রবর্তী সম্রাট হলেন ভগবান আর তাঁর উদ্যান হল এই জগৎ । রাজার ঘোষণাই শ্রুতি - স্মৃতি আদি ধর্মগ্রন্থ । লোকদের আসা - যাওয়াই সময় - কাল । উদ্যানের জন্য নির্ধারিত দুই ঘন্টা সময় হল মানুষের আয়ু । রাজার দর্শন সকলের জন্যই প্রশস্ত তাই মানুষ মাত্রের জন্য ঈশ্বর প্রাপ্তির স্বতন্ত্রতার ঘোষণা । যুবরাজ পদই হল পরম নিঃশ্রেয়স প্রাপ্তি ।
সহজ ও সুলভ পথে গিয়ে আধ মিনিটে পথ অতিক্রম করাই হল ভক্তি আদি উচ্চকোটি সহজ সাধনার দ্বারা ছয় মাসে ঈশ্বর সাক্ষাৎকারের পথ । নিয়ামক ধর্মরাজ । টিকিট দেওয়া আয়ু । টিকিকের প্রতিলিপি রাখাই আয়ুর হিসাব । উদ্যানে প্রবেশ ও নিষ্ক্রমণই হল মানুষের জন্ম - মৃত্যু । উদ্যানে প্রবেশ করে পুষ্পগন্ধযুক্ত বায়ু সেবনই এইখানে নাসিকা ইন্দ্রিয়র বশীভূত হয়ে মানুষের পুষ্পমালা , আতর আদি সুগন্ধে সময় নষ্ট করা ।
উদ্যানে মেওয়া ও মধুর ফল ভক্ষণই জিহ্বা ইন্দ্রিয় বশীভূত মানুষের ভোজনাদিতে রসাস্বাদে সময় নষ্ট করা । উদ্যানে বিনোদন আদি দেখা হল নেত্র ইন্দ্রিয়র বশীভূত মানুষের অবক্ষয়যুক্ত ক্ষণভঙ্গুর আশ্চর্যজনক পদার্থসকল দেখে নিজ অমূল্য সময় নষ্ট করা । উদ্যানে রমণীসঙ্গ করা আদিই এইখানে স্পর্শ ইন্দ্রিয়ের বশীভূত মানুষের স্পর্শাদি দ্বারা স্পর্শের যোগ্য বিনাশশীল ক্ষণভঙ্গুর পদার্থসকল উপভোগ করে নিজের জীবনকে বিপদের মুখে নিয়ে যাওয়া । উদ্যানে সংগীত আদি শ্রবণ করা হল - কর্ণেন্দ্রিয় বশীভূত মানুষের রসের কথা শ্রবণ করে নিজ অমূল্য জীবনকে বৃথা নষ্ট করা ।
রাজার দর্শনে নিরাশ হওয়া হল ঈশ্বরলাভে শ্রদ্ধার ঘাটতির কারণে সাধনায় অকর্মণ্যতা । উদ্যানে সোজা রাজদর্শনে গমনকারী যে মন - ইন্দ্রিয় সংযমী বৈরাগ্যবান পুরুষ , সেই এইখানে পরম সাক্ষাৎকার - রূপ সিদ্ধি - লাভকারী উচ্চকোটির সাধক । উদ্যানে রাজদর্শনই ভগবৎ - সাক্ষাৎকার এবং যুবরাজ পদই পরমপদ প্রাপ্তি । উদ্যানে পরিভ্রমণকারী দারোয়ানই এই জগতে ধর্মরাজের দূত । টিকিকের আয়ু শেষ হওয়াই এইখানে মানুষের আয়ুর পরিসমাপ্তি । উদ্যানের বাইরে বের করে দেওয়াই মানুষকে যমরাজের হাতে তুলে দেওয়া ।
উদ্যানে ফল ও সম্পদের পুঁটলি বাঁধা হল মৃত্যুকালে অজ্ঞান ও স্নেহবশত সম্পদাদিতে আসক্ত থাকা । আয়ুর পরিসমাপ্তির ইচ্ছা না থাকলেও দারোয়ানের লাঠিপেটা ও ধাক্কা মেরে বাইরে বের করে দেওয়াই এইখানে মৃত্যুর ইচ্ছা না থাকলেও যমদূত দ্বারা জোর করে যন্ত্রণা দিয়ে যমদ্বারে নিয়ে যাওয়া ।
উদ্যানের মেওয়া , ফল , সম্পদ আদি কোনো বস্তু সঙ্গে না নিয়ে যেতে পারাই এই জগতে মেওয়া মিষ্টান্ন , সম্পদ , স্ত্রী - পুত্র আদি সকল এইখানেই ত্যাগ করে যাওয়া , কারণ এই জগতে কিঞিতমাত্রও বস্তু আজ পর্যন্ত কেউ সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারেনি , যাবেও না । তাই এই বিনাশশীল ক্ষণভঙ্গুর পদার্থে ও বিষয়ে বৈরাগ্য ধারণ করে মন - ইন্দ্রিয়কে তা থেকে সরিয়ে পরমাত্মার নিত্যযুক্ত করা উচিত ।
লেখকঃ - Joy Shree Radha Madhav
একঃ প্রমাদী স কথং ন হন্যতে যঃ সেবতে পঞ্চভিরেব পঞ্চ ।।
' মৃগ , হস্তী , পতঙ্গ , ভ্রমর ও মৎস্য - এই পঞ্চ - জীব পাঁচটি বিষয়ের এক একটির জন্য প্রাণ হারিয়ে থাকে ; তাহলে তো যে প্রমাদী একাই পঞ্চ - ইন্দ্রিয় সেবন করে সে কেমন করে বাঁচবে ? অতএব মনুষ্যমাত্রেরই উচিত যে , মন ও পঞ্চ - ইন্দ্রিয়কে বিষয় থেকে দূরে রেখে পরমাত্মার নিত্যযুক্ত করা ।
এই প্রসঙ্গে একটা গল্প শুনুন ।
এক চক্রবর্তী সম্রাট ঘোষণা করেছিলেন - ' আগামীকাল যে ব্যক্তি আমাকে দর্শন করতে সক্ষম হবে তাকে আমি যুরবাজ পদ দেব । আমি যে উদ্যানবাড়িতে বাস করি তা কাল সারাদিন অবারিত ( খোলা ) দ্বার থাকবে । যে কেউ আমার কাছে আসতে পারে । কারো জন্য বাধানিষেধ নেই ।
প্রত্যেকে বাড়িতে ঘুরে বেড়াবার জন কেবল দুই ঘন্টা সময় দেওয়া হবে , তার বেশি কাল কেউ ভিতরে থাকতে পারবে না । উদ্যানে প্রবেশ করে আমার কাছে আসবার জন্য কেবল আধ মিনির্টই যথেষ্ট , কারণ বাড়ির পথসকল সুগম ও সুলভ । অতএব যে ব্যক্তি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমার দর্শন করে নেবে তাকে যুবরাজ পদ দেওয়া হবে আর যে উদ্যানেই রমণ করতে থাকবে তাকে দুই ঘন্টা পর বের করে দেওয়া হবে । '
এই ঘোষণা রাজ্যের সর্বত্র প্রচারিত হল । আর সকাল হতেই লোকে উদ্যানে প্রবেশ করতে লাগল । বাড়ির দ্বারেই নিয়ামক - নিয়ন্ত্রণকর্তার নিবাসস্থান ছিল । সেই নিয়ন্ত্রণকর্তা উদ্যানে প্রবেশকারীকে একটি টিকিট দিচ্ছিলেন যার একটা প্রতিলিপি নিজের কাছে রেখে দিচ্ছিলেন । এইভাবে অনুমতিপত্র নিয়ে লোকে উদ্যানে প্রবেশ করতে লাগল । উদ্যানে ঢুকে কেউ নানারকম চামেলি , কেওড়া , গোলাপ পুষ্পের আঘ্রাণ উপভোগ করে বেড়াতে লাগল ; সুশীতল সুগন্ধযুক্ত বায়ু তাদের মুগ্ধ করেছিল
আবার আরও কিছু লোক এগিয়ে গিয়ে মেওয়া ও সমুধুর ফল পেড়ে খেতে লাগল । আরও কিছু লোক আরও এগিয়ে গিয়ে সার্কাস , সিনেমা , মিউজিয়াম , নাট্যভিনয় আর রত্নের স্তূপ আর সুবর্ণ রজতের মুদ্রা আর বহু ধরণের পূর্বে না জানা , না দেখা জিনিস প্রত্যক্ষ করতে লাগল । কিছু লোক রমণীদের সঙ্গে রমণ করতে লাগল , আরও কিছু লোক এগিয়ে গিয়ে যন্ত্রসংগীত , কন্ঠ সংগীত শুনতে লাগল ।
এইভাবে লোকেরা উদ্যানের সুখ , আরাম ও ভোগে যুক্ত থেকে রাজদর্শনে নিরাশ হল এবং অজ্ঞানতার বশীভূত হয়ে ভাবতে লাগল যে রাজার দর্শন করে কী হবে ! তাদের মধ্যে একজন বৈরাগ্যযুক্ত পুরুষ ছিলেন যাঁর মন ইন্দ্রিয় বশীভূত ছিল । তিনি সুখ , আরাম , স্বাদ , ভোগ আদিকে দূরে ঠেলে সোজা মহারাজের কাছে গিয়ে উপনীত হলেন । মহারাজ তাঁকে যুবরাজ পদ প্রদান করলেন ।
ব্যবস্থাপকের অনেক চর সেই উদ্যানে ঘুরছিল যারা নির্ধারিত সময় শেষ হওয়া মাত্রই টিকিট ছিনিয়ে নিয়ে তাদের উদ্যানের বাইরে বার করে দিচ্ছিল । কিন্তু যারা পুষ্প সুগন্ধ নিয়ে হাওয়া খাচ্ছিল তারা বলল - ' আমাদের আরও কিছুক্ষণ থাকতে দাও । ' কিন্তু দারোয়ানগণ কড়া ছিল , কেউ এক মিনিটও বেশি থাকতে পারছিল না - তারা তাদের ধাক্কা দিয়ে বের করে দিচ্ছিল ।
যে লোকেরা মেওয়া ও মধুর ফল খাচ্ছিল তারা দারোয়ানকে বলল - ' ভাই ! আমাদের দুুই মিনিট আরও থাকতে দাও । আমরা মেওয়া ও ফল একত্রে করেছি - বোঁচকাটা বেঁধে ফেলি । ' দারোয়ান জানাল -- ' এখান থেকে কেউ কোনো জিনিস সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে না । যা খেয়েছো তাতেই সন্তুষ্ট থাকো । ' এই বলে দারোয়ান বোঁচকা কেড়ে নিয়ে ধাক্কা মেরে তাদের বাইরে বের করে দিল ।
যারা বিনোদন ও অভিনয় প্রভৃতি দেখছিল তারা তো উঠতে চাইছিল না কিন্তু সেইখানে কেউ এক মিনিটও বেশি থাকতে পারে কি ? দারোয়ান তাদের জোর করে বাইরে বের করে দিল । কতলোক টাকা , মোহর ও রত্নের পুঁটলি করে নিল । দারোয়ান জিজ্ঞাসা করল - ' এইটা কি ? ' তুমি পুঁটলি কেন বেঁধেছ ? ' তারা বলল - ' এই টাকা , মোহর ও রত্ন আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাব । ' দারোয়ান তাদের লাঠিপেটা করতে করতে বলল - ' মূর্খগণ ! এইগুলি তোমরা কেবল দর্শনই করতে পার । এইখান থেকে কেউ এক আধলাও সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে না । '
তাদের বাঁধা পুঁটলি ছেড়ে যেতে বড় দুঃখ হচ্ছিল ; কিন্তু উপায় ছিল না , বাধ্য হয়ে ছেড়ে যেতেই হবে । যারা রমণীসঙ্গ উপভোগ করছিল তারা কিছুতেই বাইরে যেতে চাইছিল না কিন্তু আইনত দারোয়ান এক মুহূর্তও সেইখানে থাকতে দিল না । সময় শেষ হতেই দারোয়ান লাঠি মেরে তাদের বাইরে বের করে দিল আর যারা সংগীত আদি শুনছিল তারা তো জানতই না যে কত কাল অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে । দারোয়ান তাদের টিকিকের নম্বর দেখে বলল - ' চলো তোমাদের যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে । '
যারা শুনছিল তারা বলল - ' আরে ভাই ! এই গানটা তো পুরো শুনতে দাও । ' দারোয়ান বলল - ' তোমাদের সময় শেষ হয়ে গিয়েছে , তোমরা আর এক মুহূর্তও এইখানে থাকতে পারবে না । ' তারাও লাঠিপেটা খেয়ে উদ্যান থেকে বেরিয়ে এল ।
এটি একটি কল্পিত উদাহরণ । এক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে যে , চক্রবর্তী সম্রাট হলেন ভগবান আর তাঁর উদ্যান হল এই জগৎ । রাজার ঘোষণাই শ্রুতি - স্মৃতি আদি ধর্মগ্রন্থ । লোকদের আসা - যাওয়াই সময় - কাল । উদ্যানের জন্য নির্ধারিত দুই ঘন্টা সময় হল মানুষের আয়ু । রাজার দর্শন সকলের জন্যই প্রশস্ত তাই মানুষ মাত্রের জন্য ঈশ্বর প্রাপ্তির স্বতন্ত্রতার ঘোষণা । যুবরাজ পদই হল পরম নিঃশ্রেয়স প্রাপ্তি ।
সহজ ও সুলভ পথে গিয়ে আধ মিনিটে পথ অতিক্রম করাই হল ভক্তি আদি উচ্চকোটি সহজ সাধনার দ্বারা ছয় মাসে ঈশ্বর সাক্ষাৎকারের পথ । নিয়ামক ধর্মরাজ । টিকিট দেওয়া আয়ু । টিকিকের প্রতিলিপি রাখাই আয়ুর হিসাব । উদ্যানে প্রবেশ ও নিষ্ক্রমণই হল মানুষের জন্ম - মৃত্যু । উদ্যানে প্রবেশ করে পুষ্পগন্ধযুক্ত বায়ু সেবনই এইখানে নাসিকা ইন্দ্রিয়র বশীভূত হয়ে মানুষের পুষ্পমালা , আতর আদি সুগন্ধে সময় নষ্ট করা ।
উদ্যানে মেওয়া ও মধুর ফল ভক্ষণই জিহ্বা ইন্দ্রিয় বশীভূত মানুষের ভোজনাদিতে রসাস্বাদে সময় নষ্ট করা । উদ্যানে বিনোদন আদি দেখা হল নেত্র ইন্দ্রিয়র বশীভূত মানুষের অবক্ষয়যুক্ত ক্ষণভঙ্গুর আশ্চর্যজনক পদার্থসকল দেখে নিজ অমূল্য সময় নষ্ট করা । উদ্যানে রমণীসঙ্গ করা আদিই এইখানে স্পর্শ ইন্দ্রিয়ের বশীভূত মানুষের স্পর্শাদি দ্বারা স্পর্শের যোগ্য বিনাশশীল ক্ষণভঙ্গুর পদার্থসকল উপভোগ করে নিজের জীবনকে বিপদের মুখে নিয়ে যাওয়া । উদ্যানে সংগীত আদি শ্রবণ করা হল - কর্ণেন্দ্রিয় বশীভূত মানুষের রসের কথা শ্রবণ করে নিজ অমূল্য জীবনকে বৃথা নষ্ট করা ।
রাজার দর্শনে নিরাশ হওয়া হল ঈশ্বরলাভে শ্রদ্ধার ঘাটতির কারণে সাধনায় অকর্মণ্যতা । উদ্যানে সোজা রাজদর্শনে গমনকারী যে মন - ইন্দ্রিয় সংযমী বৈরাগ্যবান পুরুষ , সেই এইখানে পরম সাক্ষাৎকার - রূপ সিদ্ধি - লাভকারী উচ্চকোটির সাধক । উদ্যানে রাজদর্শনই ভগবৎ - সাক্ষাৎকার এবং যুবরাজ পদই পরমপদ প্রাপ্তি । উদ্যানে পরিভ্রমণকারী দারোয়ানই এই জগতে ধর্মরাজের দূত । টিকিকের আয়ু শেষ হওয়াই এইখানে মানুষের আয়ুর পরিসমাপ্তি । উদ্যানের বাইরে বের করে দেওয়াই মানুষকে যমরাজের হাতে তুলে দেওয়া ।
উদ্যানে ফল ও সম্পদের পুঁটলি বাঁধা হল মৃত্যুকালে অজ্ঞান ও স্নেহবশত সম্পদাদিতে আসক্ত থাকা । আয়ুর পরিসমাপ্তির ইচ্ছা না থাকলেও দারোয়ানের লাঠিপেটা ও ধাক্কা মেরে বাইরে বের করে দেওয়াই এইখানে মৃত্যুর ইচ্ছা না থাকলেও যমদূত দ্বারা জোর করে যন্ত্রণা দিয়ে যমদ্বারে নিয়ে যাওয়া ।
উদ্যানের মেওয়া , ফল , সম্পদ আদি কোনো বস্তু সঙ্গে না নিয়ে যেতে পারাই এই জগতে মেওয়া মিষ্টান্ন , সম্পদ , স্ত্রী - পুত্র আদি সকল এইখানেই ত্যাগ করে যাওয়া , কারণ এই জগতে কিঞিতমাত্রও বস্তু আজ পর্যন্ত কেউ সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারেনি , যাবেও না । তাই এই বিনাশশীল ক্ষণভঙ্গুর পদার্থে ও বিষয়ে বৈরাগ্য ধারণ করে মন - ইন্দ্রিয়কে তা থেকে সরিয়ে পরমাত্মার নিত্যযুক্ত করা উচিত ।
লেখকঃ - Joy Shree Radha Madhav
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন