"লব্ধ্বা সুদুর্লভমিদং বহুসম্ভবান্তে
মানুষ্যমর্থদমনিত্যমপীহ ধীরঃ ।
তূর্ণং যতেত ন পতেদনুমৃত্যযাব-
ন্নিঃশ্রেয়সায় বিষয়ঃ খলু সর্ব্বতঃ স্যাৎ ॥"
-শ্রীমদ্ভাগবতম্
উপরোক্ত শ্নোকটি হইতে ষ্পষ্টই প্রতীয়মান হইতেছে যে এই মানবজীবন জীবের কত সুদুর্লভ ও মূল্যবান সস্পদ । দেবদুর্লভ এই অমূল্য সম্পদ লাভ করিয়া জীব যদি ইহার সার্থকতা উপলব্ধি করিতে না পারে, যদি মায়ার মোহে বিভ্রাস্ত জীব প্রাকৃত জগতের সুখ-দুঃখের অন্বেষণে এই জীবনে প্রাপ্ত অল্প কয়েকটি বৎসর বৃথা অতিবাহিত করিয়া দেয়, তাহা হইলে তাহার আর দুঃখের অবধি থাকে না । অনন্তের (Eternity) তুলনায় মনুষ্যের এই জীবিতকাল কতটুকু ? কয়েকটি নিমেষমাত্র বলিলেও অত্যুক্তি হয় না । কিন্তু তথাপি এই অল্প কয়েকক্ষণ অতি মূল্যবান—ইহার একাংশও বৃথা ব্যয় করিলে পরিণামে অশেষ দুঃখ ভোগ করিতে হয় । জন্ম যখন হইয়াছে, তখন মৃত্যু একদিন ঘটিবেই । আর এই অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকে যখন একদিন না একদিন বরণ করিতেই হইবে—ইহার অনিবার্য্য গতি রোধ করিবার মত শক্তি যখন মানুষের নাই, তখন এই পার্থিব জগতের সুখ-দুঃখ, সম্পদ-বিপদের মধ্যে নিজকে সম্পূর্ণ ভাবে নিমজ্জিত করিয়া এবং অবশেষে মৃত্যুকালে দারা-পুত্র-পরিজনের জন্য চিন্তা করিতে করিতে সজলনয়নে এই পৃথিবী হইতে বিদায় লওয়া যে অতিমাত্রায় মূর্খতার পরিচয়—ইহা যে কেহ চিন্তা করিলে উপলব্ধি করিতে পারিবেন ।
তথাকথিত পার্থিব-সভ্যতাগর্ব্বিত, অজ্ঞানতার গভীরতম পঙ্কে নিমজ্জিত, মায়ামুগ্ধ-জীব, এই চরম সত্যকে অস্বীকার করিবার স্পর্দ্ধা দেখায়—সাংসারিক লাভালাভের অঙ্ক নির্দ্ধারণ করিয়া, নানা পাপকর্ম্মে জীবনের দিনগুলি অতিবাহিত করিয়া অবশেষে মৃত্যবরণ করে এবং পরিণামে অশেষ নরকযন্ত্রণা ভোগ করে । ইহা অপেক্ষা দুঃখের বিষয় আর কি হইতে পারে ?
জীবনের এই ভয়ঙ্কর পরিণামের কথা যুগে যুগে মহাপুরুষগণ জীবকে বারবার স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন । অশ্রুসজল-নয়নে প্রতিটী জীবের কাছে তাঁহাদের কাতর আবেদন জানাইয়া বলিয়াছেন ;— ওগো অমৃতের সন্তানগণ, এই মূল্যহীন জাগতিক লাভ-লোকসান ব্যাপারে বৃথা কালক্ষেপ না করিয়া একবার শ্রীভগবানের শরণ লও । তাঁহার শ্রীচরণে নিজেকে নিঃশেষে বিলাইয়া দাও ও তাঁহাতেই নিজের মন-প্রাণ, সমস্ত সত্ত্বা অর্পণ কর—দেখিবে, পরম শান্তি লাভ করিবে, অনন্ত আনন্দের সন্ধান পাইবে । জাগতিক সুখ-দুঃখ, জরা, ব্যাধি সকলের ঊর্দ্ধ্বে তুমি স্থানলাভ করিবে ; মৃত্যুও তোমাকে ভয় দেখাইতে সাহস করিবে না—তুমি মৃত্যুঞ্জয়ী হইবে । সেই আত্মচেতনা লাভ করিয়া নিজেকে সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করিতে পারিবে ; দেখিবে—তুমি কত বড়, কত মহান্ ! ক্ষণিক সুখ-মোহে কর্ত্তব্যপথ বিস্মৃত হইয়া যে পার্থিব বিষয়ে নিজকে এতদিন লিপ্ত রাখিতে চাহিয়াছ, সেই জগৎ কত ক্ষুদ্র ! সে আজ তোমার দিকে মুগ্ধ-বিস্ময়ে চাহিয়া—তোমার পূজায় নিজকে ধন্য জ্ঞান করিতেছে । স্বর্গের অমরগণও তোমার ন্যায় মর-জীবন কামনা করিতেছে ।
ইহাই মনুষ্যজীবনের চরমতম সার্থকতা । কিন্তু কৃপাময় শ্রীভগবানের কৃপা ব্যতিরেকে ইহা কোনক্রমেই সম্ভবপর নহে । সেইজন্য—
শ্রবণং কীর্ত্তনং বিষ্ণোঃ স্মরণং পাদসেবনং ।
অর্চ্চনং বন্দনং দাস্যং সখ্যমাত্মনিবেদনম্ ॥
এইভাবে নিঃশেষে তাঁহার চরণে নিজের সমস্ত কিছু উৎসর্গ করিয়া মনে-প্রাণে তাঁহার সেবায় নিজকে নিয়োগ করিলে তবেই তাঁহার কৃপালাভ করা যায়,—নচেৎ নিছক স্বার্থান্ধভাবে লাভালাভের কথা চিন্তা করিয়া এবং বহু গ্রন্থ পাঠ দ্বারা সারাজীবন তর্ক ও বিচারাদি করিয়াও তাঁহার কণামাত্র কৃপা লাভ করা যায় না । "বিশ্বাসে মিলয়ে কৃষ্ণ তর্কে বহুদূর," তাঁহার উপর অনন্ত-বিশ্বাস রাখিয়া একান্ত নির্ভরশীলভাবে ভজবৎ কথা শ্রবণ-কীর্ত্তন ও ভগবৎ সেবায় সদাসর্ব্বদা প্রতিটী মুহূর্ত্ত অতিবাহিত করিতে হইবে এবং পরিপূর্ণভাবে তাঁহাতেঈ আত্মসমর্পণ করিতে হইবে । আমি যখন তাঁহার সেবায় মন-প্রাণ অর্পণ করিয়াছি, তখন আমার কথা নিতিই বিন্তা করিবেন, নিজের জন্য আমার বিন্দুমাত্র চিন্তা করিবার প্রয়োজন নাই ;— এই যে পূর্ণ-বিশ্বাস ও অনন্ত-বির্ভরতা ইহার তুলনা নাই । সকল শাস্ত্রগ্রন্থাদির ঊর্দ্ধ্বে ইহার স্থান । এইরূপভাবে ভজনা করিয়া ভক্ত, ভগবানের কৃপালাভে সমর্থ হন এবং তদনুগ্রহ লাভ করিয়া নিজেকে কৃতার্থ জ্ঞান করেন । শ্রীভগবানও ভক্তের এইরূপ সেবায় পরম প্রীতিলাভ করেন ।
শ্রীগৌড়ীয়-দর্শন, ১ বর্ষ, ১ সংখ্যা
১১ হৃষিকেশ, ২৮শে শ্রাবণ, ১৪ আগষ্ট, রবিবার, গৌরাব্দ ৪৬৯, বাং ১৩৬২, ইং ১৯৫৫
মানুষ্যমর্থদমনিত্যমপীহ ধীরঃ ।
তূর্ণং যতেত ন পতেদনুমৃত্যযাব-
ন্নিঃশ্রেয়সায় বিষয়ঃ খলু সর্ব্বতঃ স্যাৎ ॥"
-শ্রীমদ্ভাগবতম্
উপরোক্ত শ্নোকটি হইতে ষ্পষ্টই প্রতীয়মান হইতেছে যে এই মানবজীবন জীবের কত সুদুর্লভ ও মূল্যবান সস্পদ । দেবদুর্লভ এই অমূল্য সম্পদ লাভ করিয়া জীব যদি ইহার সার্থকতা উপলব্ধি করিতে না পারে, যদি মায়ার মোহে বিভ্রাস্ত জীব প্রাকৃত জগতের সুখ-দুঃখের অন্বেষণে এই জীবনে প্রাপ্ত অল্প কয়েকটি বৎসর বৃথা অতিবাহিত করিয়া দেয়, তাহা হইলে তাহার আর দুঃখের অবধি থাকে না । অনন্তের (Eternity) তুলনায় মনুষ্যের এই জীবিতকাল কতটুকু ? কয়েকটি নিমেষমাত্র বলিলেও অত্যুক্তি হয় না । কিন্তু তথাপি এই অল্প কয়েকক্ষণ অতি মূল্যবান—ইহার একাংশও বৃথা ব্যয় করিলে পরিণামে অশেষ দুঃখ ভোগ করিতে হয় । জন্ম যখন হইয়াছে, তখন মৃত্যু একদিন ঘটিবেই । আর এই অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকে যখন একদিন না একদিন বরণ করিতেই হইবে—ইহার অনিবার্য্য গতি রোধ করিবার মত শক্তি যখন মানুষের নাই, তখন এই পার্থিব জগতের সুখ-দুঃখ, সম্পদ-বিপদের মধ্যে নিজকে সম্পূর্ণ ভাবে নিমজ্জিত করিয়া এবং অবশেষে মৃত্যুকালে দারা-পুত্র-পরিজনের জন্য চিন্তা করিতে করিতে সজলনয়নে এই পৃথিবী হইতে বিদায় লওয়া যে অতিমাত্রায় মূর্খতার পরিচয়—ইহা যে কেহ চিন্তা করিলে উপলব্ধি করিতে পারিবেন ।
তথাকথিত পার্থিব-সভ্যতাগর্ব্বিত, অজ্ঞানতার গভীরতম পঙ্কে নিমজ্জিত, মায়ামুগ্ধ-জীব, এই চরম সত্যকে অস্বীকার করিবার স্পর্দ্ধা দেখায়—সাংসারিক লাভালাভের অঙ্ক নির্দ্ধারণ করিয়া, নানা পাপকর্ম্মে জীবনের দিনগুলি অতিবাহিত করিয়া অবশেষে মৃত্যবরণ করে এবং পরিণামে অশেষ নরকযন্ত্রণা ভোগ করে । ইহা অপেক্ষা দুঃখের বিষয় আর কি হইতে পারে ?
জীবনের এই ভয়ঙ্কর পরিণামের কথা যুগে যুগে মহাপুরুষগণ জীবকে বারবার স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন । অশ্রুসজল-নয়নে প্রতিটী জীবের কাছে তাঁহাদের কাতর আবেদন জানাইয়া বলিয়াছেন ;— ওগো অমৃতের সন্তানগণ, এই মূল্যহীন জাগতিক লাভ-লোকসান ব্যাপারে বৃথা কালক্ষেপ না করিয়া একবার শ্রীভগবানের শরণ লও । তাঁহার শ্রীচরণে নিজেকে নিঃশেষে বিলাইয়া দাও ও তাঁহাতেই নিজের মন-প্রাণ, সমস্ত সত্ত্বা অর্পণ কর—দেখিবে, পরম শান্তি লাভ করিবে, অনন্ত আনন্দের সন্ধান পাইবে । জাগতিক সুখ-দুঃখ, জরা, ব্যাধি সকলের ঊর্দ্ধ্বে তুমি স্থানলাভ করিবে ; মৃত্যুও তোমাকে ভয় দেখাইতে সাহস করিবে না—তুমি মৃত্যুঞ্জয়ী হইবে । সেই আত্মচেতনা লাভ করিয়া নিজেকে সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করিতে পারিবে ; দেখিবে—তুমি কত বড়, কত মহান্ ! ক্ষণিক সুখ-মোহে কর্ত্তব্যপথ বিস্মৃত হইয়া যে পার্থিব বিষয়ে নিজকে এতদিন লিপ্ত রাখিতে চাহিয়াছ, সেই জগৎ কত ক্ষুদ্র ! সে আজ তোমার দিকে মুগ্ধ-বিস্ময়ে চাহিয়া—তোমার পূজায় নিজকে ধন্য জ্ঞান করিতেছে । স্বর্গের অমরগণও তোমার ন্যায় মর-জীবন কামনা করিতেছে ।
ইহাই মনুষ্যজীবনের চরমতম সার্থকতা । কিন্তু কৃপাময় শ্রীভগবানের কৃপা ব্যতিরেকে ইহা কোনক্রমেই সম্ভবপর নহে । সেইজন্য—
শ্রবণং কীর্ত্তনং বিষ্ণোঃ স্মরণং পাদসেবনং ।
অর্চ্চনং বন্দনং দাস্যং সখ্যমাত্মনিবেদনম্ ॥
এইভাবে নিঃশেষে তাঁহার চরণে নিজের সমস্ত কিছু উৎসর্গ করিয়া মনে-প্রাণে তাঁহার সেবায় নিজকে নিয়োগ করিলে তবেই তাঁহার কৃপালাভ করা যায়,—নচেৎ নিছক স্বার্থান্ধভাবে লাভালাভের কথা চিন্তা করিয়া এবং বহু গ্রন্থ পাঠ দ্বারা সারাজীবন তর্ক ও বিচারাদি করিয়াও তাঁহার কণামাত্র কৃপা লাভ করা যায় না । "বিশ্বাসে মিলয়ে কৃষ্ণ তর্কে বহুদূর," তাঁহার উপর অনন্ত-বিশ্বাস রাখিয়া একান্ত নির্ভরশীলভাবে ভজবৎ কথা শ্রবণ-কীর্ত্তন ও ভগবৎ সেবায় সদাসর্ব্বদা প্রতিটী মুহূর্ত্ত অতিবাহিত করিতে হইবে এবং পরিপূর্ণভাবে তাঁহাতেঈ আত্মসমর্পণ করিতে হইবে । আমি যখন তাঁহার সেবায় মন-প্রাণ অর্পণ করিয়াছি, তখন আমার কথা নিতিই বিন্তা করিবেন, নিজের জন্য আমার বিন্দুমাত্র চিন্তা করিবার প্রয়োজন নাই ;— এই যে পূর্ণ-বিশ্বাস ও অনন্ত-বির্ভরতা ইহার তুলনা নাই । সকল শাস্ত্রগ্রন্থাদির ঊর্দ্ধ্বে ইহার স্থান । এইরূপভাবে ভজনা করিয়া ভক্ত, ভগবানের কৃপালাভে সমর্থ হন এবং তদনুগ্রহ লাভ করিয়া নিজেকে কৃতার্থ জ্ঞান করেন । শ্রীভগবানও ভক্তের এইরূপ সেবায় পরম প্রীতিলাভ করেন ।
শ্রীগৌড়ীয়-দর্শন, ১ বর্ষ, ১ সংখ্যা
১১ হৃষিকেশ, ২৮শে শ্রাবণ, ১৪ আগষ্ট, রবিবার, গৌরাব্দ ৪৬৯, বাং ১৩৬২, ইং ১৯৫৫
1 Comments:
হরে কৃষ্ণ,
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন