দেবনাগরী:- সরস্বতী
লিপ্যন্তর:- সনাতনী জ্ঞানমঞ্জুরী
অন্তর্ভুক্তি:- ত্রিদেবী, জ্ঞানদেবী, সংগীতাজ্ঞ ও শিল্পকলা
আসন:- শ্বেত পদ্মাসন
আবাস:- ব্রহ্মলোক
মন্ত্র:- ॐ শ্রী সরস্বত্যৈ নমঃ
সঙ্গী:- ব্রহ্মা জ্ঞানীরুপে
বাহন:- ময়ূর, হংস
পিতৃতর্পণ:- শুক্লামাঘী তিথি শুক্লাপঞ্চমী(বসন্ত পঞ্চমী)
সমাপন:- তশীতলষষ্ঠী
সরস্বতীর পূজার প্রচলন তথ্য:-
সরস্বতী হলেন জ্ঞান, সংগীত, শিল্পকলা, বুদ্ধি ও বিদ্যার হিন্দু দেবী। তিনি সরস্বতী-লক্ষ্মী-পার্বতী, এই ত্রিদেবীর অন্যতম। এই ত্রিদেবীর কাজ হল ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবকে যথাক্রমে জগৎ, সৃষ্টি, পালন ও ধ্বংস করতে সাহায্য করা। সরস্বতীর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগবেদে। বৈদিক যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত তিনি হিন্দুধর্মের একজন গুরুত্বপূর্ণ দেবী। হিন্দুরা বসন্তপঞ্চমী (মাঘ মাসের শুক্লাপঞ্চমী তিথি) তিথিতে সরস্বতী পূজা করে। এই দিন ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের হাতেখড়ি হয়। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীরাও সরস্বতীর পূজা করেন। জ্ঞান, সংগীত ও শিল্পকলার দেবী হিসেবে ভারতের বাইরে জাপান, ভিয়েতনাম, বালি (ইন্দোনেশিয়া), নেপাল, বাংলাদেশ, গ্রেটব্রিটেন, সাইপ্রাস, আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা ও মায়ানমারেও সরস্বতী পূজার প্রচলন আছে।
সরস্বতীর মূর্তি কল্পনা তথ্য:-
ধ্যানমন্ত্রে বর্ণিত মূর্তিকল্পটিতে দেবী সরস্বতীকে শ্বেতবর্ণা, শ্বেত পদ্মে আসীনা, মুক্তার হারে ভুষিতা, পদ্মলোচনা ও বীণা পুস্তক ধারিণী এক দিব্য নারী মূর্তিরূপে কল্পনা করা হয়েছে। তাই ধ্যান মন্ত্রে বলা হয়েছে:-
ওঁ তরুণশ কলমিন্দো র্বিভ্রতী শুভ্রকান্তিঃ কুচভরন মিতাঙ্গী সন্নিষণ্ণা সিতাব্জে।
নিজকর কমলোদ্যল্লেখনী পুস্তকশ্রীঃ সকল বিভবসিদ্ধৈ পাতু বাগ্দেবতা নঃ।।
অনুবাদ:- “চন্দ্রের নূতন কলাধারিণী, শুভ্রকান্তি, কুচভরনমিতাঙ্গী, শ্বেত পদ্মাসনে (উত্তমরূপে) আসীনা, হস্তে ধৃত লেখনী ও পুস্তকের দ্বারা শোভমানা বাগ্দেবী সকল বিভবপ্রাপ্তির জন্য আমাদিগকে রক্ষা করুন।”
আবার পদ্মপুরাণে উল্লিখিত সরস্বতীস্তোত্রম্-এ বর্ণিত হয়েছে:-
শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেতপুষ্পোপশোভিতা।
শ্বেতাম্বরধরা নিত্যা শ্বেতগন্ধানুলেপনা।।
শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চিতা।
শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারভূষিতা।।
অনুবাদ:- “দেবী সরস্বতী আদ্যন্তবিহীনা, শ্বেতপদ্মে আসীনা, শ্বেতপুষ্পে শোভিতা, শ্বেতবস্ত্র-পরিহিতা এবং শ্বেতগন্ধে অনুলিপ্তা। অধিকন্তু তাঁহার হস্তে শ্বেত রুদ্রাক্ষের মালা; তিনি শ্বেতচন্দনে চর্চিতা, শ্বেতবীণাধারিণী, শুভ্রবর্ণা এবং শ্বেত অলঙ্কারে ভূষিতা।
সরস্বতী মূর্তির প্রকাশ:-
ধ্যান বা স্তোত্রবন্দনায় উল্লেখ না থাকলেও সরস্বতী ক্ষেত্রভেদে দ্বিভূজা অথবা চতুর্ভূজা এবং মরালবাহনা অথবা ময়ূরবাহনা। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সাধারণত ময়ূরবাহনা চতুর্ভূজা সরস্বতী পূজিত হন। ইনি অক্ষমালা, কমণ্ডলু, বীণা ও বেদ পুস্তকধারিণী। বাংলা তথা পূর্বভারতে সরস্বতী দ্বিভূজা ও রাজহংসের পৃষ্ঠে আসীনা হাতে বীণাধারিণী রুপে পূজিত হন।
শ্রী শ্রী সরস্বতী পুষ্পাঞ্জলী মন্ত্রঃ
ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।
নমঃভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ।
বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত-বিদ্যা-স্থানেভ্য এব চ।।
এস স-চন্দন পুষ্পবিল্ব পত্রাঞ্জলি সরস্বতৈ নমঃ।।
প্রনাম মন্ত্রঃ
নমো সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে। বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্মী বিদ্যাংদেহি নমোহস্তুতে।।
জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে। বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।
সরস্বতীর স্তবঃ
শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেত পুষ্পোপশোভিতা। শ্বেতাম্ভরধরা নিত্যা শ্বেতাগন্ধানুলেপনা।। শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চ্চিতা। শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারবভূষিতা বন্দিতা সিদ্ধগন্ধর্ব্বৈর্চ্চিতা দেবদানবৈঃ। পূঝিতা মুনিভি: সর্ব্বৈঋষিভিঃ স্তূয়তে সদা।। স্তোত্রেণানেন তাং দেবীং জগদ্ধাত্রীং সরস্বতীম্। যে স্মরতি ত্রিসন্ধ্যায়ং সর্ব্বাং বিদ্যাং লভন্তি তে।।
সনাতনী পুরাণে সরস্বতীর প্রকাশ:-
ব্রহ্মা তাঁর কন্যা সরস্বতীর প্রতি দুর্ব্যবহার করলে শিব তাঁকে শরবিদ্ধ করে হত্যা করেন। তখন ব্রহ্মার পত্নী গায়ত্রী কন্যা সরস্বতীকে নিয়ে স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনার জন্য গন্ধমাদন পর্বতে তপস্যা শুরু করেন। তাঁদের দীর্ঘ তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে শিব ব্রহ্মার প্রাণ ফিরিয়ে দেন। সেই থেকে শিবের নির্দেশে গায়ত্রী ও সরস্বতীর তপস্যাস্থলে দুটি প্রসিদ্ধ তীর্থ সৃষ্টি হয়। জগতে সকল দেবতা তীর্থ আছে, শুধু ব্রহ্মার তীর্থ নেই – একথা ভেবে ব্রহ্মা পৃথিবীতে নিজের তীর্থ স্থাপনে উদ্যোগী হলেন। তিনি একটি সর্বরত্নময়ী শিলা পৃথিবীতে নিক্ষেপ করলেন। সেটি চমৎকারপুরে এসে পড়ল। ব্রহ্মা সেখানেই নিজের তীর্থ স্থাপন করবেন বলে ভাবলেন। ব্রহ্মার নির্দেশে সরস্বতী পাতাল থেকে উঠে এলেন। ব্রহ্মা তাঁকে বললেন, “তুমি এখানে আমার কাছে সব সময় থাকো। আমি তোমার জলে ত্রিসন্ধ্যা তর্পণ করব।” সরস্বতী ভয় পেয়ে বললেন, “আমি লোকের স্পর্শ ভয় পাই বলে সব সময় পাতালে থাকি। কিন্তু আপনার আদেশ আমি অমান্যও করতে পারি না। আপনি সব দিক বিচার করে একটি ব্যবস্থা করুন।” তখন ব্রহ্মা সরস্বতীর অবস্থানের জন্য একটি হ্রদ খনন করলেন। সরস্বতী সেই হ্রদে অবস্থান করতে লাগলেন। ব্রহ্মা ভয়ংকর সাপেদের সেই হ্রদ ও সরস্বতীর রক্ষক নিযুক্ত করলেন।
(তথ্যসূত্র:- স্কন্ধপুরাণ)
"শুক্ল যজুর্রবেদ" অনুসারে, একসময় ইন্দ্রের শরীরের শক্তি চলে যাওয়ার ফলে তিনি মেষ আকৃতি গ্রহণ করেন। সেসময় ইন্দ্রের চিকিৎসার দায়িত্ব ছিল স্বর্গের অশ্বিনীদ্বয়ের উপর এবং সেবা-শুশ্রুষার ভার ছিল সরস্বতীর হাতে। সংগীত ও নৃত্যপ্রেমী ইন্দ্র সরস্বতীর গানবাজনা ও সেবায় সুস্থ হওয়ার পর তাকে মেষটি দান করেন।
(তথ্যসূত্র:- শুক্ল যজুর্রবেদ)
বাল্মীকি রামায়ণে সরস্বতীর প্রকাশ:-
রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকি যখন ক্রৌঞ্চ হননের শোকে বিহবল হয়ে পড়েছিলেন, সে সময় জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী তার ললাটে বিদ্যুৎ রেখার মত প্রকাশিত হয়েছিলেন। (তথ্যসূত্র:- বাল্মীকি রামায়ণ)
সরস+বতী=সরস্বতী অর্থ জ্যোতিময়ী। ঋগ্বেদে এবং যর্জুবেদে অনেকবার ইড়া, ভারতী, সরস্বতীকে একসঙ্গে দেখা যায়। বেদের মন্ত্রগুলো পর্যালোচনায় প্রতীতী জন্মে যে, সরস্বতী মূলত সূর্যাগ্নি। ব্রহ্মা যখন সৃষ্টিকার্য শুরু করেন তখন জ্ঞান সংকটে সৃষ্টিকার্যের ব্যাঘাত ঘটে। তখনই ব্রহ্মা বিষ্ণুর স্মরণাপন্ন হয়, পালনকারী বিষ্ণু সমাধানের পথ না পেয়ে শিবকে স্তব করে। অতঃপর শিব বৈকুণ্ঠে উপস্থিত হয় এবং সৃষ্টিকারী ব্রহ্মাকে বলেন, গায়ত্রী কন্যা (ব্রহ্মা ও ব্রহ্মাপত্নী গায়ত্রী কন্যা) সরস্বতীই আপনার জ্ঞানধারী হবে। তখন ব্রহ্মাদেব সরস্বতীকে প্রকট করলেন। এরপরে বিষ্ণু সরস্বতীকে ময়ূর প্রদান করলেন এবং শিব শ্বেতপদ্ম ও বীণা প্রদান করে, তখন ব্রহ্মা সরস্বতীকে শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষণা করে। পরক্ষণে সরস্বতী ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবকে বললেন, হে ত্রিদেব আপনারা আমাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন "আমি কৃতার্ত" মার্জনা করবেন কিন্তু আমার অস্তিত্ব কি? তখন ব্রহ্মা দেবী সরস্বতীকে সর্বদেবসত্তা, বিষ্ণু সর্বজ্ঞানী, শিব সর্বপূজিত বরে ধন্য করেন। এই ত্রিদেবের বরে সরস্বতী এক বিরাট জোতির্ময় রুপ ধারণ করে, যা সূর্যের ন্যায় আলোকময়; সেইক্ষণ থেকে দেবী সরস্বতী সূর্যাগ্নি নামে খ্যাত। আজ সমগ্র বিশ্বে যে বেদ, পুরাণ, উপনিষদ, বিদ্যা, সংগীত, ও শিল্পকলার প্রকাশ তা দেবী সরস্বতীর কৃপান্নিত জ্ঞানালোকে।
সর্বসাকুল্যে দেবী সরস্বতী সৃষ্টির আদি থেকে আজ আধুনিককাল পর্যন্ত পূজিত হয়ে আসছেন, সনাতনী সমাজ তথা হিন্দুদের বিশ্বাস অনুযায়ী দেবী সরস্বতী শান্তির প্রতীক ও জ্ঞানের ভাণ্ডার। বিভিন্ন পুরাণ ও বেদ সম্বন্ধে হিন্দুরা অবগত নাহলেও, সৃষ্টির এই প্রাচীন দেবী পরিপূর্ণ ভাবে আজ সনাতনী সমাজে পরিলক্ষিত একজন। এই দেবী সবাইকে বিদ্যা বুদ্ধি প্রদান করুক এই কামনায় করি।
লিপ্যন্তর:- সনাতনী জ্ঞানমঞ্জুরী
অন্তর্ভুক্তি:- ত্রিদেবী, জ্ঞানদেবী, সংগীতাজ্ঞ ও শিল্পকলা
আসন:- শ্বেত পদ্মাসন
আবাস:- ব্রহ্মলোক
মন্ত্র:- ॐ শ্রী সরস্বত্যৈ নমঃ
সঙ্গী:- ব্রহ্মা জ্ঞানীরুপে
বাহন:- ময়ূর, হংস
পিতৃতর্পণ:- শুক্লামাঘী তিথি শুক্লাপঞ্চমী(বসন্ত পঞ্চমী)
সমাপন:- তশীতলষষ্ঠী
সরস্বতীর পূজার প্রচলন তথ্য:-
সরস্বতী হলেন জ্ঞান, সংগীত, শিল্পকলা, বুদ্ধি ও বিদ্যার হিন্দু দেবী। তিনি সরস্বতী-লক্ষ্মী-পার্বতী, এই ত্রিদেবীর অন্যতম। এই ত্রিদেবীর কাজ হল ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবকে যথাক্রমে জগৎ, সৃষ্টি, পালন ও ধ্বংস করতে সাহায্য করা। সরস্বতীর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগবেদে। বৈদিক যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত তিনি হিন্দুধর্মের একজন গুরুত্বপূর্ণ দেবী। হিন্দুরা বসন্তপঞ্চমী (মাঘ মাসের শুক্লাপঞ্চমী তিথি) তিথিতে সরস্বতী পূজা করে। এই দিন ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের হাতেখড়ি হয়। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীরাও সরস্বতীর পূজা করেন। জ্ঞান, সংগীত ও শিল্পকলার দেবী হিসেবে ভারতের বাইরে জাপান, ভিয়েতনাম, বালি (ইন্দোনেশিয়া), নেপাল, বাংলাদেশ, গ্রেটব্রিটেন, সাইপ্রাস, আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা ও মায়ানমারেও সরস্বতী পূজার প্রচলন আছে।
সরস্বতীর মূর্তি কল্পনা তথ্য:-
ধ্যানমন্ত্রে বর্ণিত মূর্তিকল্পটিতে দেবী সরস্বতীকে শ্বেতবর্ণা, শ্বেত পদ্মে আসীনা, মুক্তার হারে ভুষিতা, পদ্মলোচনা ও বীণা পুস্তক ধারিণী এক দিব্য নারী মূর্তিরূপে কল্পনা করা হয়েছে। তাই ধ্যান মন্ত্রে বলা হয়েছে:-
ওঁ তরুণশ কলমিন্দো র্বিভ্রতী শুভ্রকান্তিঃ কুচভরন মিতাঙ্গী সন্নিষণ্ণা সিতাব্জে।
নিজকর কমলোদ্যল্লেখনী পুস্তকশ্রীঃ সকল বিভবসিদ্ধৈ পাতু বাগ্দেবতা নঃ।।
অনুবাদ:- “চন্দ্রের নূতন কলাধারিণী, শুভ্রকান্তি, কুচভরনমিতাঙ্গী, শ্বেত পদ্মাসনে (উত্তমরূপে) আসীনা, হস্তে ধৃত লেখনী ও পুস্তকের দ্বারা শোভমানা বাগ্দেবী সকল বিভবপ্রাপ্তির জন্য আমাদিগকে রক্ষা করুন।”
আবার পদ্মপুরাণে উল্লিখিত সরস্বতীস্তোত্রম্-এ বর্ণিত হয়েছে:-
শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেতপুষ্পোপশোভিতা।
শ্বেতাম্বরধরা নিত্যা শ্বেতগন্ধানুলেপনা।।
শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চিতা।
শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারভূষিতা।।
অনুবাদ:- “দেবী সরস্বতী আদ্যন্তবিহীনা, শ্বেতপদ্মে আসীনা, শ্বেতপুষ্পে শোভিতা, শ্বেতবস্ত্র-পরিহিতা এবং শ্বেতগন্ধে অনুলিপ্তা। অধিকন্তু তাঁহার হস্তে শ্বেত রুদ্রাক্ষের মালা; তিনি শ্বেতচন্দনে চর্চিতা, শ্বেতবীণাধারিণী, শুভ্রবর্ণা এবং শ্বেত অলঙ্কারে ভূষিতা।
সরস্বতী মূর্তির প্রকাশ:-
ধ্যান বা স্তোত্রবন্দনায় উল্লেখ না থাকলেও সরস্বতী ক্ষেত্রভেদে দ্বিভূজা অথবা চতুর্ভূজা এবং মরালবাহনা অথবা ময়ূরবাহনা। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সাধারণত ময়ূরবাহনা চতুর্ভূজা সরস্বতী পূজিত হন। ইনি অক্ষমালা, কমণ্ডলু, বীণা ও বেদ পুস্তকধারিণী। বাংলা তথা পূর্বভারতে সরস্বতী দ্বিভূজা ও রাজহংসের পৃষ্ঠে আসীনা হাতে বীণাধারিণী রুপে পূজিত হন।
শ্রী শ্রী সরস্বতী পুষ্পাঞ্জলী মন্ত্রঃ
ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।
নমঃভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ।
বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত-বিদ্যা-স্থানেভ্য এব চ।।
এস স-চন্দন পুষ্পবিল্ব পত্রাঞ্জলি সরস্বতৈ নমঃ।।
প্রনাম মন্ত্রঃ
নমো সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে। বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্মী বিদ্যাংদেহি নমোহস্তুতে।।
জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে। বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।
সরস্বতীর স্তবঃ
শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেত পুষ্পোপশোভিতা। শ্বেতাম্ভরধরা নিত্যা শ্বেতাগন্ধানুলেপনা।। শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চ্চিতা। শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারবভূষিতা বন্দিতা সিদ্ধগন্ধর্ব্বৈর্চ্চিতা দেবদানবৈঃ। পূঝিতা মুনিভি: সর্ব্বৈঋষিভিঃ স্তূয়তে সদা।। স্তোত্রেণানেন তাং দেবীং জগদ্ধাত্রীং সরস্বতীম্। যে স্মরতি ত্রিসন্ধ্যায়ং সর্ব্বাং বিদ্যাং লভন্তি তে।।
সনাতনী পুরাণে সরস্বতীর প্রকাশ:-
ব্রহ্মা তাঁর কন্যা সরস্বতীর প্রতি দুর্ব্যবহার করলে শিব তাঁকে শরবিদ্ধ করে হত্যা করেন। তখন ব্রহ্মার পত্নী গায়ত্রী কন্যা সরস্বতীকে নিয়ে স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনার জন্য গন্ধমাদন পর্বতে তপস্যা শুরু করেন। তাঁদের দীর্ঘ তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে শিব ব্রহ্মার প্রাণ ফিরিয়ে দেন। সেই থেকে শিবের নির্দেশে গায়ত্রী ও সরস্বতীর তপস্যাস্থলে দুটি প্রসিদ্ধ তীর্থ সৃষ্টি হয়। জগতে সকল দেবতা তীর্থ আছে, শুধু ব্রহ্মার তীর্থ নেই – একথা ভেবে ব্রহ্মা পৃথিবীতে নিজের তীর্থ স্থাপনে উদ্যোগী হলেন। তিনি একটি সর্বরত্নময়ী শিলা পৃথিবীতে নিক্ষেপ করলেন। সেটি চমৎকারপুরে এসে পড়ল। ব্রহ্মা সেখানেই নিজের তীর্থ স্থাপন করবেন বলে ভাবলেন। ব্রহ্মার নির্দেশে সরস্বতী পাতাল থেকে উঠে এলেন। ব্রহ্মা তাঁকে বললেন, “তুমি এখানে আমার কাছে সব সময় থাকো। আমি তোমার জলে ত্রিসন্ধ্যা তর্পণ করব।” সরস্বতী ভয় পেয়ে বললেন, “আমি লোকের স্পর্শ ভয় পাই বলে সব সময় পাতালে থাকি। কিন্তু আপনার আদেশ আমি অমান্যও করতে পারি না। আপনি সব দিক বিচার করে একটি ব্যবস্থা করুন।” তখন ব্রহ্মা সরস্বতীর অবস্থানের জন্য একটি হ্রদ খনন করলেন। সরস্বতী সেই হ্রদে অবস্থান করতে লাগলেন। ব্রহ্মা ভয়ংকর সাপেদের সেই হ্রদ ও সরস্বতীর রক্ষক নিযুক্ত করলেন।
(তথ্যসূত্র:- স্কন্ধপুরাণ)
"শুক্ল যজুর্রবেদ" অনুসারে, একসময় ইন্দ্রের শরীরের শক্তি চলে যাওয়ার ফলে তিনি মেষ আকৃতি গ্রহণ করেন। সেসময় ইন্দ্রের চিকিৎসার দায়িত্ব ছিল স্বর্গের অশ্বিনীদ্বয়ের উপর এবং সেবা-শুশ্রুষার ভার ছিল সরস্বতীর হাতে। সংগীত ও নৃত্যপ্রেমী ইন্দ্র সরস্বতীর গানবাজনা ও সেবায় সুস্থ হওয়ার পর তাকে মেষটি দান করেন।
(তথ্যসূত্র:- শুক্ল যজুর্রবেদ)
বাল্মীকি রামায়ণে সরস্বতীর প্রকাশ:-
রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকি যখন ক্রৌঞ্চ হননের শোকে বিহবল হয়ে পড়েছিলেন, সে সময় জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী তার ললাটে বিদ্যুৎ রেখার মত প্রকাশিত হয়েছিলেন। (তথ্যসূত্র:- বাল্মীকি রামায়ণ)
সরস+বতী=সরস্বতী অর্থ জ্যোতিময়ী। ঋগ্বেদে এবং যর্জুবেদে অনেকবার ইড়া, ভারতী, সরস্বতীকে একসঙ্গে দেখা যায়। বেদের মন্ত্রগুলো পর্যালোচনায় প্রতীতী জন্মে যে, সরস্বতী মূলত সূর্যাগ্নি। ব্রহ্মা যখন সৃষ্টিকার্য শুরু করেন তখন জ্ঞান সংকটে সৃষ্টিকার্যের ব্যাঘাত ঘটে। তখনই ব্রহ্মা বিষ্ণুর স্মরণাপন্ন হয়, পালনকারী বিষ্ণু সমাধানের পথ না পেয়ে শিবকে স্তব করে। অতঃপর শিব বৈকুণ্ঠে উপস্থিত হয় এবং সৃষ্টিকারী ব্রহ্মাকে বলেন, গায়ত্রী কন্যা (ব্রহ্মা ও ব্রহ্মাপত্নী গায়ত্রী কন্যা) সরস্বতীই আপনার জ্ঞানধারী হবে। তখন ব্রহ্মাদেব সরস্বতীকে প্রকট করলেন। এরপরে বিষ্ণু সরস্বতীকে ময়ূর প্রদান করলেন এবং শিব শ্বেতপদ্ম ও বীণা প্রদান করে, তখন ব্রহ্মা সরস্বতীকে শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষণা করে। পরক্ষণে সরস্বতী ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবকে বললেন, হে ত্রিদেব আপনারা আমাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন "আমি কৃতার্ত" মার্জনা করবেন কিন্তু আমার অস্তিত্ব কি? তখন ব্রহ্মা দেবী সরস্বতীকে সর্বদেবসত্তা, বিষ্ণু সর্বজ্ঞানী, শিব সর্বপূজিত বরে ধন্য করেন। এই ত্রিদেবের বরে সরস্বতী এক বিরাট জোতির্ময় রুপ ধারণ করে, যা সূর্যের ন্যায় আলোকময়; সেইক্ষণ থেকে দেবী সরস্বতী সূর্যাগ্নি নামে খ্যাত। আজ সমগ্র বিশ্বে যে বেদ, পুরাণ, উপনিষদ, বিদ্যা, সংগীত, ও শিল্পকলার প্রকাশ তা দেবী সরস্বতীর কৃপান্নিত জ্ঞানালোকে।
সর্বসাকুল্যে দেবী সরস্বতী সৃষ্টির আদি থেকে আজ আধুনিককাল পর্যন্ত পূজিত হয়ে আসছেন, সনাতনী সমাজ তথা হিন্দুদের বিশ্বাস অনুযায়ী দেবী সরস্বতী শান্তির প্রতীক ও জ্ঞানের ভাণ্ডার। বিভিন্ন পুরাণ ও বেদ সম্বন্ধে হিন্দুরা অবগত নাহলেও, সৃষ্টির এই প্রাচীন দেবী পরিপূর্ণ ভাবে আজ সনাতনী সমাজে পরিলক্ষিত একজন। এই দেবী সবাইকে বিদ্যা বুদ্ধি প্রদান করুক এই কামনায় করি।
(c) Mishon Mojumder
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন