কবিতার নাম ‘সখার প্রতি’। কবি- স্বামী বিবেকানন্দ। ‘জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।’ এই বিখ্যাত উক্তিটি কে না শুনেছেন। আমরা এখন তার উৎস সম্পর্কে জানব। ‘সখার প্রতি’ কবিতাটি স্বামী বিবেকানন্দের জীবন বেদ বলা চলে। কবিতাটি যখন তিনি লিখছেন তখনো তিনি বিশ্বনন্দিত বিবেকানন্দ নন। তখন তাঁর বয়সও খুব বেশী নয়। ত্রিশেরও কম। রবীন্দ্রনাথে চেয়ে বয়সে দু’বছরের ছোট স্বামী বিবেকানন্দের আয়ুষ্কালও দীর্ঘ ছিল না। মাত্র ঊনচল্লিশ বছর বেঁচেছিলেন তিনি। এই স্বল্পদৈর্ঘ জীবনে যে বিপুল কাজ তিনি করে গেছেন তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা তাঁর জীবন দর্শন ও কর্মপরিধি আলোচনা করব না এখানে। আমরা নজর দেব ‘সখার প্রতি’র প্রতি।
স্বামীজির সংস্কৃত, বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় অত্যদ্ভুত দখল ছিল। জানতেন ফার্সি, উর্দুও। তাঁর পত্রাবলীর ভাষা দেখে অবাক হতে হয় যে সেই সময়ে এই রীতির ভাষা ব্যবহারের চল আদও ছিল না। শোনা যায় তাঁর ‘প্রাচ্য-পাশ্চাত্য’ প্রকাশিত হবার পর রবীন্দ্রনাথ বিমোহিত হয়ে বলেছিলেন ভবিষ্যতের বাংলার লেখ্যরূপ এরকমই হবে! ‘বাঙালা ভাষা’ নামে স্বামী বিবেকানন্দের একটা সারগর্ভ প্রবন্ধও আছে। এখানে আপাতত সেসবের কথা আনব না। কবিতার প্রসঙ্গে আসি। রবীন্দ্র সমসাময়িক যুগে মুক্তক ছন্দের চল খুব বেশী ছিল না। কবিগুরুও অনেক পরিণত বয়সে গিয়ে মুক্ত ধারায় লিখেছেন। সবকিছু বিচার করে মুক্ত ছন্দের কবিতা নিয়ে কথা তুললে আমার যে নামটি সর্বাগ্রে মনে আসে- তিনি হলেন স্বামী বিবেকানন্দ! আমি আগে একটা আলোচনায় বলেছিলাম সংস্কৃত কাব্যে এক্রস্টিকের মত রীতিরও সুচারু প্রয়োগ ঘটান তিনি। স্বামিজির কবিতা যা আছে তা হাতে গোনা। অধিকাংশই ইংরেজী ভাষায়। বাংলা যে কয়েকটা কবিতা পাওয়া যায়- তাতে দেখা যায় তিনি ছন্দ নিয়ে স্বেচ্ছাচারী ছিলেন। আবেগের কাছে ছন্দকে তিনি জিতে যেতে দেননি। এমন ভাবা অত্যন্ত মূর্খতা হবে যে- স্বামীজী ছন্দ বুঝতেন না। তিনি সংস্কৃত কাব্যে সুপন্ডিত ছিলেন। মাইকেল মধুসূদনে বিমুগ্ধ ছিলেন। অতি অল্প বয়সে ‘সঙ্গীত-কল্পতরু’ নামের দুরূহ বইয়ের সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। যাই আলোচনায় ইচ্ছুক পাঠকদের সাথে এ নিয়ে আরও কথা বলা যাবে আপাতত আমরা ‘সখার প্রতি’ পড়ে দেখি।
সখার প্রতি
________________
আঁধারে আলোক-অনুভব, দুঃখে সুখ, রোগে স্বাস্থ্যভান;
প্রাণ-সাক্ষী শিশুর ক্রন্দন, হেথা সুখ ইচ্ছ মতিমান্?
দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলে অনিবার, পিতা পুত্রে নাহি দেয় স্থান;
'স্বার্থ' স্বার্থ সদা এই রব, হেথা কোথা শান্তির আকার?
সাক্ষাৎ নরক স্বর্গময়—কেবা পারে ছাড়িতে সংসার?
কর্ম-পাশ গলে বাঁধা যার-ক্রীতদাস বল কোথা যায়?
যোগ-ভোগ, গার্হস্থ্য-সন্ন্যাস, জপ-তপ, ধন-উপার্জন,
ব্রত ত্যাগ তপস্যা কঠোর, সব মর্ম দেখেছি এবার;
জেনেছি সুখের নাহি লেশ, শরীরধারণ বিড়ম্বন;
যত উচ্চ তোমার হৃদয়, তত দুঃখ জানিহ নিশ্চয়।
হৃদিবান্ নিঃস্বার্থ প্রেমিক! এ জগতে নাহি তব স্থান;
লৌহপিণ্ড সহে যে আঘাত, মর্মর-মূরিত তা কি সয়?
হও জড়প্রায়, অতি নীচ, মুখে মধু, অন্তরে গরল—
সত্যহীন, স্বার্থপরায়ণ, তবে পাবে এ সংসারে স্থান।
বিদ্যাহেতু কবি প্রাণপণ, অর্ধেক করেছি আয়ুক্ষয়—
প্রেমহেতু উন্মাদের মতো, প্রাণহীন ধরেছি ছায়ায়;
ধর্ম তরে করি কত মত, গঙ্গাতীর শ্মশানে আলয়,
নদীতীর পর্বতগহ্বর, ভিক্ষাশনে কত কাল যায়।
অসহায়-ছিন্নবাস ধ'রে দ্বারে দ্বারে উদরপূরণ—
ভগ্নদেহ তপস্যার ভারে, কি ধন করিনু উপার্জন?
শোন বলি মরমের কথা, জেনেছি জীবনে সত্য সার—
তরঙ্গ-আকুল ভবঘোর, এক তরী করে পারাপার—
মন্ত্র-তন্ত্র, প্রাণ-নিয়মন, মতামত, দর্শন-বিজ্ঞান,
ত্যাগ-ভোগ-বুদ্ধির বিভ্রম; 'প্রেম' 'প্রেম'-এই মাত্র ধন।
জাব ব্রহ্ম, মানব ঈশ্বর, ভূত-প্রেত-আদি দেবগণ,
পশু-পক্ষী কীট-অনুকীট-এই প্রেম হৃদয়ে সবার ।
'দেব' 'দেব'-বলো আর কেবা? কেবা বলো সবারে চালায়?
পুত্র তরে মায়ে দেয় প্রাণ, দস্যু হরে—প্রেমের প্রেরণ ।।
হয়ে বাক্য-মন-অগোচর, সুখ-দুঃখে তিনি অধিষ্ঠান,
মহাশক্তি কালী মৃত্যুরূপা, মাতৃভাবে তাঁরি আগমন।
রোগ-শোক, দারিদ্র-যাতনা, ধর্মাধর্ম, শুভাশুভ ফল,
সব ভাবে তাঁরি উপাসনা, জীবে বলো কেবা কিবা করে?
ভ্রান্ত সেই যেবা সুখ চায়, দুঃখ চায় উন্মাদ সে জন—
মৃত্যু মাঙ্গে সেও যে পাগল, অমৃতত্ব বৃথা আকিঞ্চন।
যতদূর যতদূর যাও, বুদ্ধিরথে করি আরোহণ,
এই সেই সংসার-জলধি, দুঃখ সুখ করে আবর্তন।
পক্ষহীন শোন বিহঙ্গম, এ যে নহে পথ পালাবার
বারংবার পাইছ আঘাত, কেন কর বৃথায় উদ্যম?
ছাড় বিদ্যা জপ যজ্ঞ বল, স্বার্থহীন প্রেম যে সম্বল;
দেখ, শিক্ষা দেয় পতঙ্গম-অগ্মিশিখা করি আলিঙ্গন।
রূপমুগ্ধ অন্ধ কীটাধম, প্রেমমত্ত তোমার হৃদয়;
হে প্রেমিক, স্বার্থ-মলিনতা অগ্নিকুণ্ডে কর বিসর্জন।
ভিক্ষুকের কবে বলো সুখ? কৃপাপাত্র হয়ে কিবা ফল ?
দাও আর ফিরে চাও, থাকে যদি হৃদয়ে সম্বল।
অনন্তের তুমি অধিকারী প্রেমসিন্ধু হৃদে বিদ্যমান,
'দাও, দাও'-সেবা ফিরে চায়, তার সিন্ধু বিন্দু হয়ে যান।
ব্রহ্ম হ'তে কীট-পরমাণু, সর্বভূতে সেই প্রেমময়,
মন প্রাণ শরীর অর্পণ কর সখে, এ সবার পায়।
বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?
জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর
সখার প্রতি
________________
আঁধারে আলোক-অনুভব, দুঃখে সুখ, রোগে স্বাস্থ্যভান;
প্রাণ-সাক্ষী শিশুর ক্রন্দন, হেথা সুখ ইচ্ছ মতিমান্?
দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলে অনিবার, পিতা পুত্রে নাহি দেয় স্থান;
'স্বার্থ' স্বার্থ সদা এই রব, হেথা কোথা শান্তির আকার?
সাক্ষাৎ নরক স্বর্গময়—কেবা পারে ছাড়িতে সংসার?
কর্ম-পাশ গলে বাঁধা যার-ক্রীতদাস বল কোথা যায়?
যোগ-ভোগ, গার্হস্থ্য-সন্ন্যাস, জপ-তপ, ধন-উপার্জন,
ব্রত ত্যাগ তপস্যা কঠোর, সব মর্ম দেখেছি এবার;
জেনেছি সুখের নাহি লেশ, শরীরধারণ বিড়ম্বন;
যত উচ্চ তোমার হৃদয়, তত দুঃখ জানিহ নিশ্চয়।
হৃদিবান্ নিঃস্বার্থ প্রেমিক! এ জগতে নাহি তব স্থান;
লৌহপিণ্ড সহে যে আঘাত, মর্মর-মূরিত তা কি সয়?
হও জড়প্রায়, অতি নীচ, মুখে মধু, অন্তরে গরল—
সত্যহীন, স্বার্থপরায়ণ, তবে পাবে এ সংসারে স্থান।
বিদ্যাহেতু কবি প্রাণপণ, অর্ধেক করেছি আয়ুক্ষয়—
প্রেমহেতু উন্মাদের মতো, প্রাণহীন ধরেছি ছায়ায়;
ধর্ম তরে করি কত মত, গঙ্গাতীর শ্মশানে আলয়,
নদীতীর পর্বতগহ্বর, ভিক্ষাশনে কত কাল যায়।
অসহায়-ছিন্নবাস ধ'রে দ্বারে দ্বারে উদরপূরণ—
ভগ্নদেহ তপস্যার ভারে, কি ধন করিনু উপার্জন?
শোন বলি মরমের কথা, জেনেছি জীবনে সত্য সার—
তরঙ্গ-আকুল ভবঘোর, এক তরী করে পারাপার—
মন্ত্র-তন্ত্র, প্রাণ-নিয়মন, মতামত, দর্শন-বিজ্ঞান,
ত্যাগ-ভোগ-বুদ্ধির বিভ্রম; 'প্রেম' 'প্রেম'-এই মাত্র ধন।
জাব ব্রহ্ম, মানব ঈশ্বর, ভূত-প্রেত-আদি দেবগণ,
পশু-পক্ষী কীট-অনুকীট-এই প্রেম হৃদয়ে সবার ।
'দেব' 'দেব'-বলো আর কেবা? কেবা বলো সবারে চালায়?
পুত্র তরে মায়ে দেয় প্রাণ, দস্যু হরে—প্রেমের প্রেরণ ।।
হয়ে বাক্য-মন-অগোচর, সুখ-দুঃখে তিনি অধিষ্ঠান,
মহাশক্তি কালী মৃত্যুরূপা, মাতৃভাবে তাঁরি আগমন।
রোগ-শোক, দারিদ্র-যাতনা, ধর্মাধর্ম, শুভাশুভ ফল,
সব ভাবে তাঁরি উপাসনা, জীবে বলো কেবা কিবা করে?
ভ্রান্ত সেই যেবা সুখ চায়, দুঃখ চায় উন্মাদ সে জন—
মৃত্যু মাঙ্গে সেও যে পাগল, অমৃতত্ব বৃথা আকিঞ্চন।
যতদূর যতদূর যাও, বুদ্ধিরথে করি আরোহণ,
এই সেই সংসার-জলধি, দুঃখ সুখ করে আবর্তন।
পক্ষহীন শোন বিহঙ্গম, এ যে নহে পথ পালাবার
বারংবার পাইছ আঘাত, কেন কর বৃথায় উদ্যম?
ছাড় বিদ্যা জপ যজ্ঞ বল, স্বার্থহীন প্রেম যে সম্বল;
দেখ, শিক্ষা দেয় পতঙ্গম-অগ্মিশিখা করি আলিঙ্গন।
রূপমুগ্ধ অন্ধ কীটাধম, প্রেমমত্ত তোমার হৃদয়;
হে প্রেমিক, স্বার্থ-মলিনতা অগ্নিকুণ্ডে কর বিসর্জন।
ভিক্ষুকের কবে বলো সুখ? কৃপাপাত্র হয়ে কিবা ফল ?
দাও আর ফিরে চাও, থাকে যদি হৃদয়ে সম্বল।
অনন্তের তুমি অধিকারী প্রেমসিন্ধু হৃদে বিদ্যমান,
'দাও, দাও'-সেবা ফিরে চায়, তার সিন্ধু বিন্দু হয়ে যান।
ব্রহ্ম হ'তে কীট-পরমাণু, সর্বভূতে সেই প্রেমময়,
মন প্রাণ শরীর অর্পণ কর সখে, এ সবার পায়।
বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?
জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন