১৮ ডিসেম্বর ২০১৭

জ্ঞান-সঙ্কলিণী তন্ত্র হইতে দেবাদিদেব মহাদেব ও জগৎ জননী মাতার কথোকপোথন।

দেবী বললেন – হে দেব শক্তি কে? এবং শিব কে? তা আগে আমাকে বলুন তারপর জ্ঞানের বিষয়ে বলবেন।

মহাদেব বললেন – হে দেবী চিত্ত যখন অস্থির তখন তাতে শক্তি অবস্থান করেন এবং চিত্ত যখন স্থির হয় তখন তাতে শিব অবস্থান করেন। চিত্ত স্থির হলে জীব দেহ ধারণ করেই সিদ্ধি বা মোক্ষ লাভ করে থাকে।

দেবী জিজ্ঞেস করলেন – শরীরের কোন স্থানে তিন প্রকারের শক্তি , ছয় প্রকারের চক্র, একুশ টি ব্রহ্মাণ্ড ও সাত প্রকারের পাতাল অবস্থিত আছে তা আমাকে বলুন।

মহাদেব বললেন- উর্দ্ধশক্তি কণ্ঠে, অধোশক্তি গুহ্যদেশে এবং মধ্য-শক্তি নাভিতে অবস্থিত। আর যিনি এই তিন শক্তির বাইরে তাকেই নিরঞ্জন ব্রহ্ম বলে। গুহ্য চক্রকে আধার, লিঙ্গ-চক্রকে স্বাধিষ্ঠান, নাভি-চক্রকে মনিপুর, হৃদয়-চক্রকে অনাহত, কণ্ঠ-চক্রকে বিশুদ্ধ এবং মস্তক-চক্রকে সহস্রদল বলে। যিনি এই ছয় চক্রকে ভেদ করতে পারেন তিনি চক্রাতীত ও নমস্য ব্যক্তি। শরীরের উর্দ্ধ দিক হল ব্রহ্মলোক। এবং শরীরের নীচের দিক হল পাতাল লোক। এই শরীর বৃক্ষের মত কিন্তু এর উর্দ্ধদিক হল সেই বৃক্ষের মূল স্বরূপ এবং নিম্নদিক হল সেই বৃক্ষের শাখা স্বরূপ।

দেবী বললেন – হে শিব, হে শঙ্কর, হে ঈশান, হে পরমেশ্বর আমাকে বলুন এই দেহের মধ্যে কি ভাবে দশ প্রকার বায়ু অবস্থিত এবং যে দশটি দরজা আছে সেগুলি কি কি ?

মহাদেব বললেন – হৃদয়ে প্রাণবায়ু, গুহ্যদেশে অপাণবায়ু, নাভিদেশে সমান বায়ু, কণ্ঠে উদানবায়ু, দেহের ত্বকে ও সারা দেহ জুড়ে ব্যান বায়ু অবস্থিত। নাগ বায়ু উর্দ্ধপান হতে আগত এবং কূর্ম্মবায়ু তীর্থ দেশে আশ্রিত। কৃকর বায়ু মানসিক ক্ষোভে, দেবদত্ত বায়ু হাই তুললে এবং ধনঞ্জয় বায়ু গভীর চিৎকার করলে নিবেশিত হয়ে সাম্য রক্ষা করে। এই দশ প্রকার বায়ু নিরালম্ব (অবলম্বন শূন্য) এবং যোগীগণের যোগ সম্মত। আমাদের শরীরের নবদ্বার প্রত্যক্ষ করা যায় এগুলি হল দুটি চোখ, দুটি কান, দুটি নাসারন্ধ্র, মুখ, গুহ্য ও লিঙ্গ এবং দশম দ্বার হল মন।

দেবী বললেন – সারা শরীর জুড়ে যে নাড়ী অবস্থিত তা কয় ভাগে বিভক্ত? কুণ্ডলিনী শক্তি ও তা থেকে উৎপন্ন যে দশটি নাড়ী সে সম্বন্ধে আমাকে বলুন।

মহাদেব বললেন – ঈড়া, পিঙ্গলা এবং সুষুম্না এই তিনটি নাড়ী উর্দ্ধগামিনী; গান্ধারী, হস্তি জিহ্বা ও প্রসবা এই তিনটি নাড়ী দেহের সর্ব্বত্র ব্যাপ্ত আছে। শরীরের দক্ষিণ অঙ্গে অলম্বুষা ও যশা এই দুটি ও বাম অঙ্গে কুহু ও শঙ্খিনী এই দুটি নাড়ী ব্যবস্থিত। এই দশ প্রকার নাড়ী হতেই শরীরে নানা নাড়ী উৎপন্ন হয়েছে এবং বাহাত্তর হাজার প্রসূতিকা নাড়ী শরীরের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। যে যোগী এই সমস্ত নাড়ী গুলিকে জানেন তিনি যোগ লক্ষণ যুক্ত হয়ে যান এবং জ্ঞাননাড়ী হতেই যোগীগণ সিদ্ধিলাভ করে থাকেন।

দেবী বললেন – হে ভূতনাথ, হে মহাদেব, হে পরমেশ্বর তিন দেবতার সম্বন্ধে আমাকে বলুন তদের তিন প্রকার গুণ ও ভাব কি কি?

মহাদেব বললেন – রজো ভাবে ব্রহ্মা, সত্ত্ব ভাবে বিষ্ণু ও ক্রোধ ভাবে রুদ্র অবস্থিত আছেন। এই হল তিন দেবতা, এই হল তিন প্রকার গুণ। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর এই তিন দেবতার মূর্ত্তি একই, যার মনে এই তিন দেবতার পৃথক পৃথক ভাব পরিকল্পিত হয় তার মুক্তি কখনোই হয় না। দেহের মধ্যে ব্রহ্মা বীর্য্যরূপে, বিষ্ণু বায়ু রূপে ও রুদ্র মন রূপে অবস্থিত আছেন, এই তিন দেবতা ও এই তিন গুণ। দয়া ভাবে ব্রহ্মা, শুদ্ধ ভাবে বিষ্ণু ও অগ্নি ভাবে রুদ্র অবস্থান করে এই তিন দেবতা, এই তিন গুন। এই জগৎ চরাচর সকল কিছুই সেই সেই এক পরমব্রহ্ম থেকেই উৎপন্ন হয়েছে, যার মধ্যে এই জগৎ সম্বন্ধে নানা ভাবের সৃষ্টি হয় তার মুক্তি কখনই হয় না। আমিই সৃষ্টি, আমিই সময়, আমি ব্রহ্মা, আমি হরি, আমি রুদ্র, আমি শূন্য, আমি সর্বব্যাপী ও আমিই নিরঞ্জন ব্রহ্ম। আমি সর্বময়, আমি নিষ্কাম, আমার উপমা আকাশ, শুদ্ধ স্বভাব ও নির্ম্মল ব্রহ্ম স্বরূপ মনও আমি, এর মধ্যে কোন সংশয় নেই। যে বীর জিতেন্দ্রিয়, ব্রহ্মচারী, সুপণ্ডিত, সত্যবাদী, দানশীল, অন্য ব্যাক্তির হিতে রত (পরোপকারী) তাকেই ভক্ত বলে। ব্রহ্মচর্য তপস্যার মূল এবং দয়া ধর্মের মূল তাই যত্ন সহকারে দয়া ও ব্রহ্মচর্যের আশ্রয় গ্রহণ করা উচিত।

দেবী বললেন – হে যোগেশ্বর, হে জগন্নাথ, হে উমাপ্রাণবল্লভ, বেদ, সন্ধ্যা, তপস্যা, ধ্যান, হোম, কর্ম ও কুল কি তা আমাকে বলুন?

মহাদেব বললেন – হাজার অশ্বমেধ যজ্ঞ বা একশ বাজপেয় যজ্ঞের যে পুণ্যফল তা ব্রহ্মজ্ঞানের পুণ্যফলের ষোলকলার এক কলারও সমান নয়। সব সময়ে শুচি হয়ে সকল পুণ্যতীর্থে ভ্রমণ করে যে পুণ্যফল তা ব্রহ্মজ্ঞানের পুণ্যফলের ষোলকলার এক কলারও সমান নয়। না বন্ধু, না পুত্র, না পিতা, না সখা, না স্বামী কাউকেই সেই গুরুর সাথে তুলনা করা যায় না যে সেই পরম পদ দেখিয়ে দিতে পারেন। 
না বিদ্যা, না তীর্থ, না দেবতা কেউ সেই গুরুর সাথে তুলনীয় নয় যে সেই পরম পদ দেখিয়ে দিতে পারেন। এবং সেই পরম পদ পাওয়ার জন্য গুরু শিষ্যকে যে একাক্ষর মন্ত্র নিবেদন করেন সারা পৃথিবীতে এমন কোন দ্রব্যই নেই যার দ্বারা গুরুর সেই ঋণ শিষ্য শোধ করতে পারে।

 যাকে তাকে এই সুগোপনীয় ব্রহ্মজ্ঞান দেওয়া যায় না কেবলমাত্র সদগুরু(?) তার যে কোন ভক্ত শিষ্যকেই এই ব্রহ্মজ্ঞান প্রদান করবেন। জ্ঞানী মাত্রেই মন্ত্র, পূজা, তপ, ধ্যান, হোম, জপ, বলিক্রিয়া ও সন্ন্যাস আদি সকল প্রকার লৌকিক কাজ পরিত্যাগ করবেন। সংসর্গেই (সঙ্গগুণ) সকল প্রকার দোষ ও নিঃসঙ্গ(একাকী) থাকলেই সকল প্রকার গুণের উৎপত্তি হয়ে থাকে তাই সব রকমের চেষ্টা দ্বারা সব রকমের সঙ্গ পরিত্যাগ করবে। অকার সত্ত্বগুণ, উকার রজোগুণ এবং মকার তমোগুণ এই তিন গুনের আধারই প্রকৃতি। অক্ষরই প্রকৃতি এবং অক্ষরই স্বয়ং ঈশ্বর (পুরুষ)। প্রকৃতি এই পুরুষ থেকেই এসেছেন এবং সত্ত্ব, রজ:, তম: এই তিন গুনের দ্বারা বদ্ধ হয়েছেন। 

সেই মায়া স্বরূপ প্রকৃতি পালন, সৃষ্টি, সংহার এই তিন শক্তিবিশিষ্ট এবং সেই মায়াই অবিদ্যা, মোহিনী, শব্দরূপা ও যশস্বিনী হয়েছেন। অকার ঋকবেদ, উকার যজুর্বেদ ও মকার সাম বেদ এই তিনটি মিলিত হয়েই অথর্ব্ববেদ হয়েছে। ওঁকার প্লুত স্বর এবং একে ত্রিনাদও বলা হয়ে থাকে। অকার ভূলোক, উকার ভুবর্লোক ও ব্যঞ্জন সহ মকার স্বর্গলোক এবং এই তিন অক্ষরেই আত্মা বিশেষ ভাবে অবস্থিত থাকে। অকার পৃথিবী এবং হলুদ বর্ণের। উকার অন্তরীক্ষ এবং বিদ্যুৎ বর্ণ সংযুক্ত এবং মকার স্বর্গ এবং শুক্ল বর্ণ সংযুক্ত। এবং এই সকল বর্ণ সংযুক্ত একাক্ষর প্রণব ওঁকারই একমাত্র নিশ্চিত ব্রহ্ম। আসন করে এবং চিন্তাশূন্য ভাবে প্রতিদিন বসবে কিন্তু খেয়াল রাখবে ঘুমিয়ে না পড় এই ভাবে প্রতিদিন বসলেই যোগী হওয়া যায় এটাই শিবের কথা এর অন্যথা নেই। যে ব্যাক্তি প্রতিদিন এই ব্রহ্মজ্ঞানের কথা পাঠ বা শ্রবণ করে সে ব্যাক্তি সকল প্রকার পাপ থেকে মুক্ত হয়ে বিশুদ্ধ আত্মা হয়ে শিবলোক প্রাপ্ত হয়।

দেবী বললেন – স্থূল লক্ষণ কি, কি ভাবে মনের বিলয় ঘটে থাকে স্থূল ও সূক্ষ্মের লক্ষণ স্বরূপ যে পরমার্থ নির্বাণ তা কি?

মহাদেব বললেন- যখন জ্ঞান হয় তখন অন্ধকার স্বরূপ পাপ আর বিদ্যমান থাকে না। তখনই মনের বিলয় ঘটে থাকে। এবং যখন জ্ঞান জন্মায় তখন পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশ এই পঞ্চভূত হতে সৃষ্ট যে দেহ তা স্থুলরূপে অবস্থিত করে আর জ্ঞান লাভ করলে এর যে অন্যথা অবস্থান তাই সূক্ষ্মরূপে অবস্থিত থাকে।

- ইতি জ্ঞান-সঙ্কলিণী তন্ত্র

(C)এস.এম পারিয়েল কুমার
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।