১৮ ডিসেম্বর ২০১৭

নারদের জীবন চরিত

নারদ হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে- ব্রহ্মার মানসপুত্র। ইনি ত্রিকালজ্ঞ, বেদজ্ঞ ও তপস্বী। নারদ শব্দের অর্থ জল। ইনি সবসময় তর্পণের জন্য জলদান করতেন বলে এঁর নাম হয় নারদ।

ভগবত মতে- ইনি জনৈক ব্রাহ্মণের এক দাসীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। ইনি তাঁর মায়ের আদেশে সবসময় যোগীদের সেবা করতেন এবং এই যোগীদের উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে ধর্মপরায়ণ হয়ে উঠেন। এই সময় সাপের কামড়ে তাঁর মায়ের মৃত্যু ঘটে। এরপর ইনি তপস্যার জন্য বনে যান। ইনি মাত্র একবার ঈশ্বরের দর্শন লাভ করতে সক্ষম হন। ঈশ্বরকে পাবার জন্য আকুল চেষ্টা করেও ঈশ্বরকে ইনি দ্বিতীয় বার দর্শন করতে পারলেন না। এরপর ইনি বিভিন্ন সাধুদের সেবা করে তাঁর বুদ্ধিকে দৃঢ় করেন এবং ঈশ্বর চিন্তায় মগ্ন থেকেই পৃথিবী ভ্রমণ করতে থাকেন। এই ভ্রমণের মধ্য দিয়েই ইনি ঈশ্বরে লীন হয়ে যান।


এরপর কল্প শেষে বিষ্ণু যখন সমুদ্রের জলে শায়িত ছিলেন, তখন তাঁর নিঃশ্বাস যোগে নারদ বিষ্ণুর অন্তরে প্রবেশ করেন। বিষ্ণু তাঁর নিদ্রা ত্যাগ করে যখন সৃষ্টির ইচ্ছা করেন তখন তাঁর ইন্দ্রিয় থেকে ব্রহ্মার উৎপত্তি হয় এবং ব্রহ্মার মন থেকে নারদ আবির্ভূত হন। ইনি সেই থেকে দেবদত্ত বীণায় হরি গান করে সর্বত্র ভ্রমণ করতে থাকেন।


ব্রহ্মাবৈবর্ত পুরাণের মতে- এঁর জন্ম হয়ে ছিল ব্রহ্মার কণ্ঠ থেকে। প্রথমে ব্রহ্মা তাঁকে সৃষ্টির ভার দেন। সৃষ্টির কাজে ব্যস্ত থাকলে ঈশ্বর চিন্তা বিঘ্নিত হবে বিবেচনা করে ইনি ব্রহ্মার আদেশ মানতে রাজী হলেন না। ফলে ব্রহ্মা তাঁকে অভিশাপ দিয়ে বলেন যে, নারদকে গন্ধমাদন পর্বতে গন্ধর্বযোনিতে জন্মগ্রহণ করতে হবে। যথা সময়ে ইনি গন্ধর্বযোনিতে জন্মগ্রহণ করেন। এই সময় তাঁর নাম ছিল উপবর্হণ। এই জন্মে ইনি চিত্ররথের ৫০টি কন্যাকে বিবাহ করেন। এর পরে ইনি এক আসরে রম্ভার নাচ দেখে উত্তেজিত হলে, তাঁর বীর্যপাত হয়। এতে ব্রহ্মা আরও ক্রুদ্ধ হয়ে- তাঁকে মানুষ হয়ে জন্মানোর অভিশাপ দেন। ব্রহ্মার এই অভিশাপে কলাবতী নামক এক নারীর গর্ভে ইনি জন্মগ্রহণ করেন। ব্রাহ্মণরা নারদকে ব্রহ্মার পুত্র জেনে তাঁকে বিষ্ণুমন্ত্রে দীক্ষিত করেন। এরপর তিনি বিষ্ণুর ধ্যান করতে করতে ব্রহ্মে লীন হয়ে যান।


কয়েক কল্প পরে ব্রহ্মা পুনরায় সৃষ্টি আরম্ভ করলে আবার ইনি জন্মগ্রহণ করেন। এইবার ইনি বীণা যোগে সঙ্গীত পরিবেশন করে সকলকে মোহিত করা শুরু করেন। পুরাণ মতে- নারদ সর্বদাই নানা রাগ-রাগিণী যুক্ত সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। কিন্তু সবসময় তাঁর সঙ্গীতে কিছু না কিছু ত্রুটি থেকে যেতো। কিন্তু নারদ এই ত্রুটি নিজে বুঝতে পারতেন না, সেই কারণে নারদ তাঁর নিজের গান নিয়ে খুব গর্ব করতেন। নারদের এই গর্বকে খর্ব করার জন্য একবার রাগ-রাগিণীরা বিকলাঙ্গ নর-নারীর রূপ গ্রহণ করে নারদের যাত্রা পথে উপস্থিত হলেন। নারদ এই বিষয় অবগত ছিলেন না বলে- ইনি উক্ত বিকলাঙ্গ নারী-পুরুষরূপী রাগ-রাগিণীকে তাঁদেরকে বিকলাঙ্গের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন।

 তখন তাঁরা বললেন যে, তাঁরা নারদের বিকৃত সঙ্গীতের রূপ। নারদ এই কথা শুনে ব্যাকুল হয়ে, তাঁদেরকে প্রকৃষ্টরূপে সঙ্গীত পরিবেশনের উপায় জিজ্ঞাসা করলেন। উত্তরে তাঁরা বললেন যে, মহাদেবের গান শুনলে তাঁদের বিকলাঙ্গতা দূর হবে। এরপর নারদ মহাদেবের কাছে সঙ্গীত শোনার আবেদন জানালে- মহাদেব জানালেন যে, প্রকৃষ্ট শ্রোতা ছাড়া তিনি গান শোনাবেন না। পরে নারদ মহাদেবের পরামর্শ অনুসারে ব্রহ্মা ও বিষ্ণু-কে অনুরোধ করে আসরে নিয়ে আসেন। মহাদেবের গান শোনার পর রাগ-রাগিণীদের বিকলাঙ্গতা দূর হয়। এই সঙ্গীতের মর্ম ব্রহ্মা বুঝতে পারলেন না। কিন্তু বিষ্ণু কিছুটা বুঝতে পেরেছিলেন। ফলে ইনি আংশিক দ্রবীভূত হন। 

বিষ্ণুর এই দ্রবীভূত অংশ ব্রহ্মা তাঁর কমণ্ডলুতে ধারণ করেন। বিষ্ণুর এই দ্রবীভূত অংশই গঙ্গা নামে খ্যাত হয়। নারদের সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ লক্ষ্য করে, বিষ্ণু উলুকেশ্বর নামক এক গন্ধর্বের কাছে তাঁকে সঙ্গীত শিক্ষার জন্য পাঠান।

তাঁকে বিভিন্নস্থানে বিভিন্ন ভূমিকায় দেখা যায়। ইনি কৃষ্ণের জন্মবৃত্তান্ত পূর্বেই কংসকে জানিয়েছিলেন, ধ্রুবের তপস্যায় মন্ত্রদাতা ছিলেন, মহাদেব-পার্বতীর বিবাহের ঘটক ছিলেন, দক্ষের অহঙ্কার নাশে ইনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন। রাময়ণের মূল কাহিনী তিনি বাল্মীকিকে শুনিয়েছিলেন। পরে এই কাহিনী অবলম্বনে বাল্মীকি রামায়ণ রচনা করেছিলেন। এছাড়া ইনি দূত হিসাবেও বিভিন্ন সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ইনি কথা গোপন করে রাখতে পারতেন না। কখনো কখনো অবিবেচকের মতো কথা বলে, বিপর্যয় ডেকে আনতেন। কংসের কাছে কৃষ্ণের কাছে জন্মগ্রহণ এবং কৃষ্ণকর্তৃক কংসবধের কথা বলেছিলেন। বিন্ধ্যপর্বতের কাছে সুমেরুর গুণকীর্তন করে, পৃথিবী বিপর্যস্ত করেন। পরে এই বিপর্যয় থেকে অগস্ত্য মুনি পৃথিবী রক্ষা করেন।

(C) Sk Basak
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।