প্রভাতে উঠে হৈহৈ পড়লো বানর শিবিরে। বন্ধ তাঁবুর ভেতর থেকে দুজন কিভাবে উধাও হলেন এই ব্যাখা কেউ বুঝতে পারলো না। বিরূপাক্ষ গিয়ে রাবণকে জানালো যে মহীরাবণ সেই দুই নরকে অপহরণ করতে সমর্থ হয়েছে । রাবণ দশ মুখ দিয়ে অট্টহাস্য করতে লাগলো। তাঁর হাস্য গগনে এমন ভাবে বিস্তৃত হল, যেনো বিশাল নাদ হয়ে ধরিত্রীতে নেমে এলো। পশু, পক্ষী সকল পলায়ন করলো। সুগ্রীব, অঙ্গদ, নল, নীল, জাম্বুবান, গয়, গবাক্ষ, মৈন্দ , কেশরী আদি বানর বীরেরা মস্তকে হাত দিয়ে বসলো। বিভীষণ এসে বলল- “পবনপুত্র! শেষে তুমি নিদ্রা গেলে? আর দেখো কি অনর্থ হল। আমি পূর্বেই সতর্ক করেছিলাম মহীরাবণ কিভাবে কখন কোথায় আসবে তা কেউ বুঝতে পারে না।” হনুমান বলল- “প্রভুর নামে শপথ করে বলছি আমি কাল তিলমাত্র নিদ্রামগ্ন হই নি। সম্পূর্ণ রজনী প্রহরা দিয়েছি। আমার এই পুচ্ছের বাঁধন কেউ অতিক্রম করতে পারে না। না জানি কি হল। হায়! কাল যদি আমি শিবিড়ের ভেতরে থেকে জেগে প্রহরা দিতাম- তাহলে এমন হতো না। একভাবে এই দোষ আমার। এই ব্যর্থতা আমার।” এই বলে হনুমান কপালে হাত দিয়ে বসে রোদন করতে লাগলো। বিভীষণ ও বানরেরা শিবিরে প্রবেশ করে দেখলো যে দুজনের কেবল ধনুক আর তূন আছে। কিন্তু দুজন নেই। শয্যা তুলতেই দেখলো বিশাল এক সুরঙ্গ। অন্ধকার সুরঙ্গ নীচে নেমে গেছে অতল গহ্বরে । বিভীষন সেই সুরঙ্গ দেখিয়ে বলল- “এই পথেই মহীরাবণ এসে হরণ করে পাতালে নিয়ে গেছে ওঁনাদের। সর্বনাশ। অমাবস্যা তিথি ক্রমশ সন্নিকটে। এবার অনুমান করেছি কেন মহীরাবণ যুদ্ধ না করে ওঁনাদের হরণ করলেন। ওঁনারা ক্ষত্রিয়। বোধ হয় অমাবস্যায় ওঁনাদের বলিদান করবে মহীরাবণ।” সকলে ভয়ে পরস্পরের মুখের দিকে চাইলো। বিভীষণ বলল- “হনুমান! আর দেরী করো না। সত্বর পাতালে গমন করো। মহীরাবণ একবার সফল হলে এই যুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত।” হনুমান ক্রোধে বলল- “আমি পাতালপুরী যাবো। সেই মহীরাবণের অন্ত করে ফিরবো।” এই বলে হনুমান সেই সুরঙ্গে প্রবেশ করলেন।
যে পথে লক্ষ্মণ রামে হরেছে রাক্ষসে ।
সেই পথে গেল বীর চক্ষুর নিমিষে ।।
পাতালেতে গিয়া দেখে সূর্যের প্রকাশ ।
বিচিত্র নির্মাণ পুরী যেমন কৈলাস ।।
প্রথমে দেখিল বলিরাজার বসতি ।
পুণ্যতীর্থ গঙ্গা দেখে নামে ভোগবতী ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )
ভগবান বিষ্ণু বামন অবতার গ্রহণ করে বলি রাজার যজ্ঞে এসে তিনপদ ভূমি দান চেয়েছিলেন । দুই পদে সমগ্র গগন ও ধরিত্রী অধিকার করলেন , একপদে বলিকে পাতালে ঠেলে দেন । আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় ভগবান বিষ্ণু, বলি রাজার সাথে ছল করেছেন। কিন্তু এটা ভুল ধারণা। শ্রীবিষ্ণু চরণ লাভ দেবতাদের দুর্লভ। মহামূল্যবাণ। এক পেয়েছিলেন গয়াধাম- সেখানে হরির পাদপদ্ম পূজিত হচ্ছে, এক গঙ্গা, একজন হলেন কালীয়নাগ, অপর হলেন বলি। ভগবান ভক্তের আহ্বানে এমন সারা দিয়েছিলেন যে বলি মহারাজের দ্বারপাল হয়ে তিনি ছিলেন। পরে মাতা লক্ষ্মী দেবী এসে বলি মহারাজকে রাখী বন্ধন করে ভ্রাতার কাছে স্বামীর মুক্তি চান ও প্রাপ্তি করেন । ভগবান বিষ্ণুর পূজার পর তাঁর প্রসাদ হনুমান, প্রহ্লাদ, ধ্রুব, নারদ এই সকল বৈষ্ণব দের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়- এঁর মধ্যে বলি রাজাও আছেন। ভগবানের সাথে তাঁহারও পূজা হয় । হনুমানকে দেখে বলি রাজা খাতির যত্ন করলেন। বললেন- “আরে গোঁসাই! আপনি কিঞ্চিৎ এখানে বিশ্রাম করুন। শুনেছি আপনি পরম ভক্ত।” হনুমান বলল- “ গোঁসাই! আপনার ভক্তির কথা জগত বিহিত। যিঁনি বৈকুণ্ঠের নারায়ণ, তিঁনিই বামনদেব, তিঁনিই আমার প্রভু শ্রীরাম। রাবণের মানস পুত্র মহীরাবণ প্রভু ও তাঁর ভ্রাতাকে বলি দেবার জন্য তাঁহাদিগের হরণ করে এনেছে। আমি তাঁহাদিগের সন্ধানে যাচ্ছি।” বলি রাজ বললেন- “হনুমান! আমি রাবণকে বহু পূর্বে বন্দী বানিয়েছিলাম। মহীরাবণকে বধ করতে আমি অক্ষম। কারণ সে কেবল কোন মর্কটের হাতেই বদ্ধ। আপনিই সেই। সেই দুরাচারীর বধ করুন।” হনুমান এরপর পাতালের গঙ্গা ভোগবতীর দর্শন করলেন। এখানে অনেক অদ্ভুত ও বিচিত্র মানব দেখতে পেলেন । কত শত মন্দির দেখলেন । নাগিনী, যক্ষিণী যক্ষ দের দেখতে পেলেন । কিন্তু কোথাও প্রভু শ্রীরাম ও লক্ষ্মণকে দেখতে পেলেন না ।
তিন কোটি পুরুষে কপিল মুনি বৈসে ।
পরমাসুন্দরী কত দেখে আশে পাশে ।।
বিচিত্র নির্মাণ দেখে কত তীর্থ স্থান ।
সেথা রাম লক্ষ্মণেরে না পায় সন্ধান ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )
সেখানে কপিল মুনিকে দর্শন করলেন। সাংখ্য দর্শনের জনক কপিল মুনি । হনুমান গিয়ে মহর্ষি কপিলকে প্রনাম করলেন । এখানেই ষাটি হাজার রাজপুত্রকে ভস্ম করেছিলেন কপিল মুনি। তাঁহারা সব ভগবান শ্রীরামের পূর্বপুরুষ । তারপরেই গঙ্গা দেবীকে মর্তে আনায়ন করেছিলেন ভগবান শ্রীরামের পূর্বজ মহারাজ ভগীরথ । কপিল মুনিকে প্রণাম করলেন হনুমান। সবিস্তারে সব বললেন। কপিল মুনি বললেন- “বতস্য! এইস্থান হতে মহীরাবণের সাম্রাজ্য শুরু। তুমি সম্মুখে অগ্রসর হও। আর শুনেছি তোমার ন্যায় এক মর্কট মহীরাবণের রাজ্যের সেনাপতি। তাঁর থেকে সাবধান থাকবে। সে বড় বীর।” হনুমান সামনে এগিয়ে গেলো। দেখলো জলন্ত আগুনের লাভার নদী বইছে । তাঁর থেকে বিষাক্ত ধূম ও আগুনের ফুলকি উঠছে । সেই স্থান এত গরম যে তিলমাত্রে শরীর ভস্ম হয়। টগবগ করে লাভা ফুটছে । অগ্নিদেবতা বাল্যকালে হনুমানকে বর দিয়েছিলেন যে আগুনে তাঁর কোন ক্ষতি হবে না। তাই হনুমানের কোন উত্তাপ অনুভব হল না। রাম নাম নিয়ে লাভার ওপর দিয়ে হেটে পার হল । তারপর দেখলো একদল রাক্ষস সেখানে প্রহরা দিচ্ছে। হনুমানকে দেখা মাত্রই রেরে করে তেরে আসলো। হনুমান গদা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো । রাক্ষসদের সাথে হনুমানের প্রবল যুদ্ধ আরম্ভ হল। হনুমান বুঝলো এরা সকলে মহীরাবণের অনুগত । গদা দিয়ে পিটিয়ে হনুমান রাক্ষস দের বধ করলো। কাউকে আবার তুলে লাভার নদীতে ফেলে দিলো। দেখলো রাক্ষসদের মাংস এমনকি অস্থি সকল লাভাতে গলে গিয়ে মিশে গেলো। রাক্ষসদের নিধন করে হনুমান এগিয়ে গেলো। মক্ষীর আকৃতি হয়ে বিচরণ করতে লাগলেন হনুমান । দেখতে পেলেন চারপাশে কত শত রাক্ষস দের।
( ক্রমশঃ )
যে পথে লক্ষ্মণ রামে হরেছে রাক্ষসে ।
সেই পথে গেল বীর চক্ষুর নিমিষে ।।
পাতালেতে গিয়া দেখে সূর্যের প্রকাশ ।
বিচিত্র নির্মাণ পুরী যেমন কৈলাস ।।
প্রথমে দেখিল বলিরাজার বসতি ।
পুণ্যতীর্থ গঙ্গা দেখে নামে ভোগবতী ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )
ভগবান বিষ্ণু বামন অবতার গ্রহণ করে বলি রাজার যজ্ঞে এসে তিনপদ ভূমি দান চেয়েছিলেন । দুই পদে সমগ্র গগন ও ধরিত্রী অধিকার করলেন , একপদে বলিকে পাতালে ঠেলে দেন । আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় ভগবান বিষ্ণু, বলি রাজার সাথে ছল করেছেন। কিন্তু এটা ভুল ধারণা। শ্রীবিষ্ণু চরণ লাভ দেবতাদের দুর্লভ। মহামূল্যবাণ। এক পেয়েছিলেন গয়াধাম- সেখানে হরির পাদপদ্ম পূজিত হচ্ছে, এক গঙ্গা, একজন হলেন কালীয়নাগ, অপর হলেন বলি। ভগবান ভক্তের আহ্বানে এমন সারা দিয়েছিলেন যে বলি মহারাজের দ্বারপাল হয়ে তিনি ছিলেন। পরে মাতা লক্ষ্মী দেবী এসে বলি মহারাজকে রাখী বন্ধন করে ভ্রাতার কাছে স্বামীর মুক্তি চান ও প্রাপ্তি করেন । ভগবান বিষ্ণুর পূজার পর তাঁর প্রসাদ হনুমান, প্রহ্লাদ, ধ্রুব, নারদ এই সকল বৈষ্ণব দের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়- এঁর মধ্যে বলি রাজাও আছেন। ভগবানের সাথে তাঁহারও পূজা হয় । হনুমানকে দেখে বলি রাজা খাতির যত্ন করলেন। বললেন- “আরে গোঁসাই! আপনি কিঞ্চিৎ এখানে বিশ্রাম করুন। শুনেছি আপনি পরম ভক্ত।” হনুমান বলল- “ গোঁসাই! আপনার ভক্তির কথা জগত বিহিত। যিঁনি বৈকুণ্ঠের নারায়ণ, তিঁনিই বামনদেব, তিঁনিই আমার প্রভু শ্রীরাম। রাবণের মানস পুত্র মহীরাবণ প্রভু ও তাঁর ভ্রাতাকে বলি দেবার জন্য তাঁহাদিগের হরণ করে এনেছে। আমি তাঁহাদিগের সন্ধানে যাচ্ছি।” বলি রাজ বললেন- “হনুমান! আমি রাবণকে বহু পূর্বে বন্দী বানিয়েছিলাম। মহীরাবণকে বধ করতে আমি অক্ষম। কারণ সে কেবল কোন মর্কটের হাতেই বদ্ধ। আপনিই সেই। সেই দুরাচারীর বধ করুন।” হনুমান এরপর পাতালের গঙ্গা ভোগবতীর দর্শন করলেন। এখানে অনেক অদ্ভুত ও বিচিত্র মানব দেখতে পেলেন । কত শত মন্দির দেখলেন । নাগিনী, যক্ষিণী যক্ষ দের দেখতে পেলেন । কিন্তু কোথাও প্রভু শ্রীরাম ও লক্ষ্মণকে দেখতে পেলেন না ।
তিন কোটি পুরুষে কপিল মুনি বৈসে ।
পরমাসুন্দরী কত দেখে আশে পাশে ।।
বিচিত্র নির্মাণ দেখে কত তীর্থ স্থান ।
সেথা রাম লক্ষ্মণেরে না পায় সন্ধান ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )
সেখানে কপিল মুনিকে দর্শন করলেন। সাংখ্য দর্শনের জনক কপিল মুনি । হনুমান গিয়ে মহর্ষি কপিলকে প্রনাম করলেন । এখানেই ষাটি হাজার রাজপুত্রকে ভস্ম করেছিলেন কপিল মুনি। তাঁহারা সব ভগবান শ্রীরামের পূর্বপুরুষ । তারপরেই গঙ্গা দেবীকে মর্তে আনায়ন করেছিলেন ভগবান শ্রীরামের পূর্বজ মহারাজ ভগীরথ । কপিল মুনিকে প্রণাম করলেন হনুমান। সবিস্তারে সব বললেন। কপিল মুনি বললেন- “বতস্য! এইস্থান হতে মহীরাবণের সাম্রাজ্য শুরু। তুমি সম্মুখে অগ্রসর হও। আর শুনেছি তোমার ন্যায় এক মর্কট মহীরাবণের রাজ্যের সেনাপতি। তাঁর থেকে সাবধান থাকবে। সে বড় বীর।” হনুমান সামনে এগিয়ে গেলো। দেখলো জলন্ত আগুনের লাভার নদী বইছে । তাঁর থেকে বিষাক্ত ধূম ও আগুনের ফুলকি উঠছে । সেই স্থান এত গরম যে তিলমাত্রে শরীর ভস্ম হয়। টগবগ করে লাভা ফুটছে । অগ্নিদেবতা বাল্যকালে হনুমানকে বর দিয়েছিলেন যে আগুনে তাঁর কোন ক্ষতি হবে না। তাই হনুমানের কোন উত্তাপ অনুভব হল না। রাম নাম নিয়ে লাভার ওপর দিয়ে হেটে পার হল । তারপর দেখলো একদল রাক্ষস সেখানে প্রহরা দিচ্ছে। হনুমানকে দেখা মাত্রই রেরে করে তেরে আসলো। হনুমান গদা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো । রাক্ষসদের সাথে হনুমানের প্রবল যুদ্ধ আরম্ভ হল। হনুমান বুঝলো এরা সকলে মহীরাবণের অনুগত । গদা দিয়ে পিটিয়ে হনুমান রাক্ষস দের বধ করলো। কাউকে আবার তুলে লাভার নদীতে ফেলে দিলো। দেখলো রাক্ষসদের মাংস এমনকি অস্থি সকল লাভাতে গলে গিয়ে মিশে গেলো। রাক্ষসদের নিধন করে হনুমান এগিয়ে গেলো। মক্ষীর আকৃতি হয়ে বিচরণ করতে লাগলেন হনুমান । দেখতে পেলেন চারপাশে কত শত রাক্ষস দের।
( ক্রমশঃ )
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন