১২ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব –৬)

একদিনের কথা । মাতা সীতাদেবী শৃঙ্গার করছিলেন সিঁদূর দ্বারা । মণি মুক্ত খচিত দর্পণে নিজ মুখ দেখে কপালে সিঁদুর দিলেন । দেবীর সীতার কপালে সূর্যের ন্যায় গোল সিঁদুরের টিকা শোভা পাচ্ছিল্ল। হনুমান সে সময় এসে মাতা সীতাকে প্রনাম করে বলল- “মাতা আপনি সিঁদুর কেন পড়েন ? সমস্ত বিবাহিতা নারীরাই কেন বা সিঁদূর পড়েন ?” শুনে সকল দাসী, মাতা সীতা হাস্য করতে লাগলেন । মাতা সীতা বললেন- “হনুমান! এয়োস্ত্রী নারী সর্বদা কপালে সিঁদূর ধারণ করেন , যাহাতে তার স্বামীর কল্যাণ হয়। স্বামীর দীর্ঘায়ু লাভ হয়। কারণ স্বামীই হলেন স্ত্রীর প্রভু।” এই শুনে হনুমান ভাবলেন যে সিঁদুর পরিধানে যদি সত্যই প্রভুর কল্যাণ হয়, তবে সে সমস্ত শরীরে সিঁদূর লেপন করবে। কারণ নিজেই ত প্রভুরসেবক , প্রভুর দাস। প্রভু শ্রীরাম ত ‘প্রভু’। এইভেবে হনুমান করলেন কি লম্ফ দিয়ে আকাশে উঠলেন । এল লাফে সোজা উড়ে চললেন মলয় পর্বতে। সেখানে এক দিব্য সিঁদূরের পর্বত ছিলো। সেই সিঁদূরের পর্বত তুলে আনলেন। হনুমানের কাণ্ড দেখে সকলে অবাক। গোটা সিঁদূরের পর্বত তুলে এনেছে । হনুমান করলেন কি “জয় শ্রী রাম” বলে মুঠে মুঠে সিঁদুর নিয়ে নিজেকে নিজেই মাখিয়ে দিলেন । লালে লাল হয়ে গেলো হনুমানের সমস্ত দেহ । দাসীরা হাসতে হাসতে গিয়ে সীতাদেবীকে হনুমানের সব কীর্তি বলতে লাগলেন । হনুমান এর এই কাণ্ড দেখে সীতাদেবী অবাক হলেন । দাসী দের সাথে নীচে নেমে এসে সেই সিঁদুরের পর্বত থেকে সিঁদূর দিয়ে কপালে দিলেন। একে অপরকে রাঙিয়ে দিলেন । এরপর হনুমান ‘জয় শ্রী রাম’ বলে সেই অবস্থায় দরবারে ঢুকলেন । সকলে অবাক হল। “জয় শ্রী রাম” বলে শ্রীরামের চরণে পড়লেন । ভগবান রাম হাস্য করে বললেন- “হনুমান! তুমি এমন সিঁদুর মেখেছো কেন?” হনুমান বললেন- “প্রভু! মাতা সীতা বলেছেন যে সিঁদুর ধারণে প্রভুর মঙ্গল হয়। আপনিই আমার প্রভু, আমি আপনার ভৃত্য। আপনার কল্যাণেই এই সিঁদুর মেখেছি।” হনুমানের ভক্তি ও এই কাণ্ড দেখে মুগ্ধ হলেন ভগবান শ্রীরাম। তখন ভগবান শ্রীরাম বললেন- “আজ হতে এই তিথিতে সিঁদুর ব্রত প্রচলিত হবে। এই দিন এয়োস্ত্রী নারীরা একে অপরকে সিঁদুর প্রদান করে স্বামীর জন্য দীর্ঘায়ু ও সুস্থ জীবন প্রাপ্ত করবেন। এই তিথির সাথে তোমার নাম যুগ যুগ জড়িয়ে থাকবে ভক্ত হনুমান ।”

দীর্ঘ পাঁচ মাস কেটে গেলো। সীতাদেবী সুখে ঘর সংসার করছেন। তিন মায়ের সেবা করছেন । প্রভু শ্রীরামের সাথে আনন্দে আছেন। সীতাদেবীর গর্ভলক্ষণ প্রকাশ পেলো। প্রভু শ্রীরামের সন্তান দেবীর গর্ভে । কিন্তু এবার রাক্ষসী দিগের অভিশাপ ফলিত হল। রাজা রামচন্দ্র সর্বদা প্রজার সেবা করতেন । প্রজাদের দর্শন দিয়ে অভাব অভিযোগ শুনতেন । ব্রাহ্মণ দের ইপ্সিত দ্রব্য দান করতেন । প্রজাদের দান করতেন। রাজ্যে কেহ আর দরিদ্র ছিলো না । সকলে যে যার মতো সুখে ছিলো। একদা ভগবান শ্রীরাম দুর্মুখ নামক এক গুপ্তচরকে আদেশ দিলেন- “দুর্মুখ! তুমি সমস্ত অযোধ্যা রাজ্য পরিক্রমা করবে। কাহার কি অভিযোগ আছে সব এসে আমাকে জানাবে। দেখো ছদ্দবেশে তুমি ঘুরে বেড়াবে। অযোধ্যার লোকেরা কি কি বিষয় সংক্রান্ত আলোচনা করে তাহা জানাবে। তাহাদের কোন বিষয়ে ক্ষোভ থাকলেও তা এসে আমাকে নিঃসন্দেহে জানাবে।” দুর্মুখ রাতের অন্ধকারে বের হল । সমগ্র অযোধ্যা ঘুরে দেখতে লাগলো। কোথায় কি মানব গল্প করছে, কোথায় কি কি ক্ষোভের কারণ বলছে, মাঠে কেমন ফসল হয়েছে এই সকল আলোচনা শুনতে লাগলো। দুুর্মুখ ছদ্দবেশে থাকাতে তাহাকে কেউ চিনতে পারলো না । লোকেরা গল্প করছে দেখতে পেলো । রাতের অন্ধকারে হুঁকো পান করতে করতে তারা গল্প করছে । তারা সকলেই প্রশংসা করছে । রামরাজ্যে থেকে তাহারা যে খুবুই খুশী ইহা তাহাদের কথায় পরিষ্কার হচ্ছে । সকলে আনন্দে সেই গল্প করছে । সমগ্র অযোধ্যায় কেবল শান্তি আর আনন্দের কথা। রাজার দান পেয়ে সকলেই খুশী হয়ে আছে । একজায়গায় দেখতে পেলো কিছু লোক হুঁকো খেতে খেতে গল্প করে বলছে – “আমাদের রাজা শ্রীরাম আর মাতা সীতার যুগল যেনো সাক্ষাৎ লক্ষ্মীনারায়ণ । নয়নে বিরাজিত হয়েছে সেই রূপ।” আর একজন শুনে বলল- “রাখো তোমার লক্ষ্মী নারায়ন। যেই নারী দশমাস রাক্ষসদের রাজত্বে ছিলো তার সাথে দেবীর তুলনা ? বলি সেই নারীর কি আর সতীত্ব বজায় আছে ? রাবণ কি তাহাকে ছেড়ে দিয়েছে?” সকলে হা করে শুনতে থাকলো, কুমনা সেই ব্যক্তি সমানে তার কথার পক্ষে নানা যুক্তি দেখাতে লাগলো ।

বলল- “আসলে রাজা ত। তাই কেউ কিছু বলে না, পাছে ঘরে আগুন দিয়ে জীবন্ত না পুড়িয়ে দেয়। কিন্তু মাথার ওপর ভগবান আছে – তিঁনি সব দেখছেন। কেন ঐ ভ্রষ্টা নারীকে এনে রানী করা। আর একটা কি বিবাহ করা যেতো না ? রাবণের রাজ্য থেকে কোন নারী সম্মান নিয়ে ফেরে না। সুতরাং সীতাদেবী কোন মতেই সতী নন।” অনেকে বলল- “কেন ঐ যে অগ্নিপরীক্ষার কথা , সাক্ষাৎ দেবতারা এসে মাতা সীতার সতীত্বের সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন।” সেই মন্দবুদ্ধি বলল- “আরে রাখো বাপু তোমার অগ্নিপরীক্ষা। কোথায় সাগর পাড়ে কি হয়েছে তা কি আমরা দেখতে গেছি? আর জীবন্ত চিতা থেকে কেউ বেঁচে ফেরে নাকি? ওসব বানানো কথা । হায় অবস্থা ! এমন সতীত্বহীন রমণী অযোধ্যার রমণী। দেশে আর ধর্ম বলে কিছু রইলো না।” দুর্মুখ সব শুনে মাথায় হাত দিলো। ভাবল এই মূর্খের দল বলে কি ? একবার মনে হল লোকটিকে যমালয়ে প্রেরণ করতে, কিন্তু মহারাজ শ্রীরাম এমন আদেশ করেন নি। সব শুনে দেখলো সেখানে সকলে সীতাদেবীর সতীত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে আলোচনা করছে । অন্য কয়েক জায়গাতে গিয়ে দুর্মুখ ছদ্দবেশে এমন শুনতে পেলো। তাহার আলোচনা করে বলছে- “সীতা দেবীর ধর্ম নাশ হয়েছে লঙ্কায়। তাকে আবার রাজ্যে এনে রানী বানানো কেন ? এইসব অনাছিষ্টি ধনী রাজার ঘরেই মানায়। যদি আমাদের ঘরে হতো তবে এমন বৌকে দূরদূর করে বিতারিত করতাম । নারীর ধর্ম নাশ হলে সে হয় অলক্ষ্মী, তাহাকে সংসারে স্থান দিলে অকল্যাণ হয়। কেন যে রাজা রামচন্দ্র সেইরকম নারীকেই রানী বানিয়ে মহলে রেখেছেন। কিন্তু কার ঘাড়ে কটা মাথা- কে রাজাকে বোঝাতে যাবে। তবে এই অনাচার ধর্মে সইবে না।” দুর্মুখ এই সকল ঘটনা শুনে কানে হাত দিলো। হায়রে! এই সব প্রজাদের মাতা সীতাদেবী নিজ পুত্রের ন্যায় স্নেহ করেন। এরা ত মাতার উপরেই কলঙ্ক দিচ্ছে। পাপিষ্ট গুলো অযোধ্যায় কিভাবে জন্ম নিলো। এই ভেবে দুর্মুখ শুনে সব কথা মাথায় হাত দিলো । লোক গুলো তখনও বলে যাচ্ছে- “যত নিয়ম কেবল আমাদের মতো গরীবদের জন্য। কেন তিনি রাজা বলেই কি যা ইচ্ছা তাই করবেন নাকি। অমন নারীকে ঘরে রাখা কেন ? দশমাস লঙ্কায় বন্দিনী ছিলো যে তার আবার সতীগিরি !” দুর্মুখ এগুলো শুনে রাজপ্রাসাদে চলে গেলো।

( ক্রমশঃ ) 
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।