১২ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-৬১)

ভরত ‘বনের পশু’ বলে সম্বোধন করলেও হনুমান মোটেও ক্রুদ্ধ হল না। সে জানালো যে প্রভু শ্রীরাম- দেবী সীতা- লক্ষ্মণ ও সুগ্রীব জাম্বুবান, বিভীষণ সহ সকলে পুস্পক বিমানে আসছেন । আকাশে বিমান কেবল দেবতারা ব্যবহার করেন । সেসময় মর্তলোকে সেই বিমান প্রচলিত ছিলো না । আকাশ ভ্রমণের বিদ্যা বা যন্ত্র সেই যুগেও ছিলো। এখন আমরা এরোপ্লেন কে কেবল বিমান দেখি। অনেকে হয়তো হাসাহাসি করবে। কিন্তু এটাও সত্য যে বিমান সেই যুগেও ছিলো- তবে তা অনেক পরিমাণে ছিলো না । ব্রহ্মা এই বিমান কুবেরকে দিয়েছিলেন, পরে কুবেরের থেকে রাবণ বল পূর্বক এই বিমান ছিনিয়ে নেয় । সেই যুগে মুনি ঋষিরা ছিলেন বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানী মানে আমরা কেবল বুঝি ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাসী ও জড় জাগতিক ভোগের আবিস্কার কর্তা । কিন্তু এমন নয়। বিজ্ঞানীরাও এক সাধক । ঈশ্বরের সর্বোত্তম সৃষ্টি হলেন মানব জাতি। আর এই পৃথিবীতে মানবের সকল দুঃখের নিবৃত্তির উপায় ঈশ্বর সৃষ্টি করে রেখেছেন। মানবের সেই দিক গুলি খুঁজে নিতে হয়- যারা এই গুলি খুঁজে পেতে অনুশীলন করেন- তারাই বিজ্ঞানী । হিন্দু ঋষিরা কেবল মন্ত্র তন্ত্রেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক সম্বন্ধে সচেষ্ট ছিলেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান , আয়ুর্বেদ ভেষজ চিকিৎসা তে আবিস্কার করেছিলেন কবিরাজী ঔষধী সকল । যাই হোক শ্রীরামচন্দ্র আসছেন শুনে সকলে হা করে আকাশে তাকিয়ে ছিলেন । সমগ্র অযোধ্যা নগরী বিভিন্ন রঙ্গীন নেতের পতাকা, ঘণ্টা, কদলী বৃক্ষ দিয়ে সাজানো হয়েছিলো। সমস্ত পথ পরিচ্ছন্ন করে পুস্প দিয়ে সাজানো হয়েছিলো । ভরত নন্দিগ্রাম থেকে শ্রীরামের পাদুকা চামর, পাখা ব্যাঞ্জন করতে করতে নিয়ে এলো। সাথে অযোধ্যার সেই রাজাসন নিয়ে এলো । কিন্তু অগ্রজের আসতে দেরী । ভরত রেগে বলল- “আমি অগ্রজকে বলেছিলাম চতুর্দশ বৎসর সমাপন হলে উনি আসতে বিলম্ব করলে আমি অগ্নি প্রবেশ করবো।”

কৌশল্যা ও সুমিত্রা বললেন- “এ কি বলছ পুত্র? এইরূপ সংকল্প ত্যাগ করো। কেন অগ্নি প্রবেশ করবে? মাতা হয়ে পুত্রের মৃত্যু দেখা তো দূর – শ্রবণ করাও যায় না।” ভরত বলল- “মাতা! আমি মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামের ভ্রাতা। আমার অগ্রজ প্রতিজ্ঞা পালনের জন্য একবাক্যে বনে চলে গিয়েছেন। আর আমি তাঁর ভ্রাতা হয়ে প্রতিজ্ঞা থেকে বিচ্যুত হবো? আমিও প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে চতুর্দশ বৎসর সমাপন হলে অগ্রজের আসতে বিলম্ব হলে আমি অগ্নিতে প্রবেশ করবো।” এই বলে ভরত কাষ্ঠ এনে চিতা সাজাতে আদেশ দিলো। সেনারা কাষ্ঠ এনে চিতা সাজালো। পুত্র চিতাতে উঠবে শুনে মাতা কৈকয়ী এই শুনে রোদন করতে করতে ছুটে এলো। মাণ্ডবী কাঁদতে কাঁদতে ভরতের চরণে পড়ে নিবৃত্ত করবার চেষ্টা করলো। কৈকয়ী বলল- “পুত্র! আমার কোল খালি করে দিয়ো না!” ভরত ক্রুদ্ধ হয়ে বলল- “আমার দুঃখ থেকে আপনার শোক হচ্ছে? একবার ভাবুন চতুর্দশ বৎসর কিভাবে মাতা কৌশল্যা- মাতা সুমিত্রা দিন যাপন করেছেন । আপনি তো আমাকে সেই দিন হত্যা করে ফেলেছেন, যেদিন আপনি পিতার কাছে আমার রাজ্যলাভ ও অগ্রজের বনবাস চেয়েছিলেন । এই ভার আমাকে তিলে তিলে এত বছর ধরে গ্রাস করেছে। আজ অগ্নিতে প্রবেশ করে আমি সেই ভার লাঘব করবো। আপনার পাপ আমি বয়ে নিয়ে ছিলাম, সেই পাপের অন্ত করবো। পুত্র হারানোর দুঃখ আপনারাও পাওয়া উচিৎ। যে যেমন অন্যের সাথে অন্যায় করে- বিধাতা তার সাথেও তেমন অন্যায় করেন।” কৈকয়ী বলল- “হায় ভাগ্য! সেদিন কেন যে মন্থরার যুক্তি শুনে মহারাজের কাছে সেই বর চাইলাম। স্বামীকে হারালাম- যে পুত্র আমাকে এত সম্মান করতো, সেই দেবতুল্য পুত্রকে বনে পাঠিয়ে দিলাম- আজ গর্ভের সন্তানকে হারাচ্ছি। কেন যে কুবুদ্ধি শুনে চলেছিলাম!”

এই বলে কৈকয়ী ক্রন্দন করতে করতে বিদায় হলেন। ভরত সকলের কথা অমান্য করে চিতায় উঠতে যাবে, তখন আকাশে দেখলেন, সূর্য ঢাকা পড়েছে। সেই দিব্য পুস্পক বিমান আকাশে। ধীরে ধীরে নেমে আসছে ধরিত্রীতে । হনুমান বলল- “ঐ তো প্রভু আসছেন।” সকলে হা করে আকাশে দেখতে লাগলেন । পুস্পক বিমান দেখে মনে হল- একটি দিব্য মণি যেনো নেমে আসছে। এই আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল্ল। ধীরে ধীরে পুস্পক বিমান পৃথিবীর বুকে নেমে এলো। বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র, অগ্যস্ত সকলে খুশীতে পুস্পক বিমানের দিকে গমন করলেন। বিমান নামা মাত্রই ধূলিতে চতুর্দিকে ছেয়ে গেলো। ধূলি সরতেই দেখা গেলো পুস্পক বিমান থেকে করজোড়ে প্রভু শ্রীরাম , দেবী সীতা ও লক্ষ্মণ নেমে আসছেন । চতুর্দিকে ঢাক- ঢোল- ন্যাকরা- দুন্দুভি- কাঁসর- শিঙা- দামামা বেজে উঠলো। হৈ হৈ পড়ে গেলো । চিতায় গমন রত ভরত কে ধরে প্রভু শ্রীরাম বললেন- “ভ্রাতা! একি অনর্থ করছিলে ? আমি তো ফিরে এলাম । তোমার কিছু হলে আমি কি বেঁচে থাকতাম ভ্রাতা!” ভরতকে এই বলে আলিঙ্গন করলেন । ভরত এরপর প্রভু শ্রীরামের চরণে সেই পাদুকা পড়িয়ে দিয়ে বললেন- “অগ্রজ! এবার আর কোথাও তোমাকে যেতে দেবো না। আপনিই হবেন অযোধ্যার রাজা। আমি আপনার সেবক হয়ে চিরকাল আপনার সেবা করবো।” ভগবান শ্রীরাম বললেন- “এখানে আমার তিনজন মহাত্মা গুরুদেবের একত্রে অবস্থান দেখে আমি ধন্য হয়েছি । দণ্ডবৎ প্রণাম জানাই গুরুদেবের চরণে।” এই বলে ভগবান শ্রীরাম বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র ও অগ্যস্ত মুনিকে প্রনাম জানালেন। মাণ্ডবী, ঊর্মিলা , শ্রুতকীর্তি এসে বড় ভগিনী সীতাদেবীকে আলিঙ্গন করে অনেক ক্রন্দন করে সুখ দুঃখের ঘটনা বললেন। রাজা জনক ও তাঁর স্ত্রী সুনয়না এসে সীতাদেবীকে অনেক স্নেহ করলেন । পুত্রীর দুঃখের ঘটনা শ্রবণ করে অনেক অশ্রু বিসর্জন করলেন। শ্রীরাম এসেছেন- অযোধ্যার প্রজারা ছুটে আসতে লাগলো।

ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র চারি বর্ণ ।
শ্রীরামে দেখিতে লোক চলিল অগণ্য ।।
ঊর্ধ্বশ্বাসে ধাইয়া চলিল গর্ভবতী ।
লজ্জা ভয় ত্যজে যায় কুলের যুবতী ।।
কাণা খোঁড়া শিশু বুড়া লয়ে অন্যজনে ।
অন্ধজন চক্ষু পায় শ্রীরাম দর্শনে ।।
অনেক ব্রাহ্মণ চলে অনেক ব্রাহ্মণী ।
তাহাদের ঘরে নাহি রহে এক প্রাণী ।।
অবধূত সন্ন্যাসী চলিল ঊর্ধ্বমুখে ।
নপুংসক চলিল যে অন্তঃপুর রাখে ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

এইভাবে সকলে আনন্দে শ্রীরাম সীতা দর্শনে ছুটলেন। কত শত লোক শ্রীরামের চতুর্দিকে ঘীরে রেখেছে। কৌশল্যা, সুমিত্রা দেবী পুত্রদের দেখতেই পাচ্ছেন না। এত ভীড় । সকলে আনন্দে হাসছেন আবার ক্রন্দন করছেন । সকলের যেনো শরীরে প্রাণ ফিরে এসেছে। সকলের দুঃখের নিবৃত্তি ঘটেছে। ভগবান শ্রীরাম কিন্তু এত ভীড়ে মাতা কৈকয়ীকেই খুঁজতে লাগলেন । কারণ ছোটো থেকেই রানী কৈকয়ীর কাছেই বড় হয়েছেন। শ্রীরাম সকলকে প্রণাম করে শুভেচ্ছা কুশলাদি বিনিময় করলেন ।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।