১২ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব –১০)

শ্রীরাম শুনছিলেন তাঁহার ভ্রাতার কথা। সত্যই ত লক্ষ্মণের কথায় অনেক যুক্তি আছে । কিন্তু এই মুহূর্তে কি বা করার আছে । সীতাকে পরিত্যাগ করা ছাড়া দ্বিতীয় পথ নেই । শ্রীরাম শুনলেন । বললেন- “লক্ষ্মণ ! তোমার কথা যথার্থ। আমি সীতার স্বামী রূপে সীতার সাথে অন্যায় করছি। আমার সন্তানের সাথে অধর্ম করছি। কিন্তু আমি কর্তব্যকে অবহেলা করতে পারি না। রাজা হবার পূর্বে যে শপথ গ্রহণ করেছি- তাহাকে অস্বীকার করতে পারি না। ইহা করলে স্বয়ং সীতাই আমাকে অপছন্দ করবেন । হে লক্ষ্মণ ! প্রতি রাজ্যে একজন করে রাজা থাকে। রাজা স্বর্ণ মুকুট স্বর্ণ আবরণে সিংহাসণে বসে রাজকর্ম পরিচালনা করেন। সকলে ইহাই ভাবে রাজা কেবল সিংহাসণে বসে নানা সুখ ভোগ করেন। ইহা সম্পূর্ণ মিথ্যা নয়, এই ধরিত্রীতে এমন বহু রাজাই এমন হয়ে থাকেন। কিন্তু রঘুবংশের নৃপতিদের মধ্যে এই নিয়ম প্রচলিত নয়। এই মহান বংশের ‘রাজা’ র অর্থ প্রজানুরঞ্জন। প্রজার কল্যাণে , প্রজার দাবী মেনে প্রজার স্বার্থে কর্ম করা- তাতে নিজের সংসারের স্বার্থ বজায় থাকুক আর না থাকুক । সিংহাসণ কে চারটি পায়া তুলে ধরে রাখে লক্ষ্মণ। ন্যায়- ধর্ম- দণ্ড- শাসন সেই পায়া। আর সিংহাসণের ওপর সেই ছত্র হল সমগ্র রাজ্য, আর রাজার মস্তকের মুকুট হল গোটা রাজ্যের প্রজাদের দাবী- ইচ্ছা আর দায়িত্ব । ইহাই রাজার অবলম্বন । হে লক্ষ্মণ! আমি রঘুবংশী হয়ে কিভাবে এই সকল দায়িত্ব পালনে বিরত হতে পারি? লক্ষ্মণ তুমি নিজেও এই মহান কুলের বংশজ। পূর্বপুরুষদের কীর্তি কে অক্ষয় রাখতে এই ভূমিকা পালন করো। অন্যত্থায় রাজাজ্ঞা না মানার কারণে তোমাকে দণ্ড প্রদানে আমি বাধ্য থাকবো।” লক্ষ্মণ চোখের জল মুছতে মুছতে বলল- “হ্যা দাদা! সবার উপরে রাজধর্ম । কি সেই সিংহাসণের তলে কোন নির্দোষ নারী পিষে যাক, কি এক গর্ভবতী নারীর ইচ্ছা- আশা সকল কিছু পিষ্ট হোক- কি সন্তানের ওপর পিতার ভালোবাসা সেই বিশাল সিংহাসণের তলায় কোথাও হারিয়ে যাক- কিন্তু সিংহাসণের গরিমা কেন অক্ষুণ্ণ থাকবে ? এ কেমন নিয়ম অগ্রজ ? কোন নির্দয় পাষাণ ব্যক্তি এই নিয়ম বানিয়েছে?”

বলে লক্ষ্মণ পুনঃ গম্ভীর হয়ে বলল- “এই যদি নিয়ম হয়, তবে হে অযোধ্যাপতি শ্রীরাম, আমি এই অধর্ম করতে পারবো না। এতে আমাকে পূর্বপুরুষদের অভিশাপ কুড়াতে হলে, আমি তাহা কণ্ঠের মাল্য রূপে গ্রহণ করবো। বংশে কালিমা লেপন হলে তাহা আমি নিজে গ্রহণ করবো। রাজধর্ম উলঙ্ঘন হলে- সেই শাস্তি ভোগ করবো। কিন্তু আমি আমার বৌঠানের ওপর আর কোন কষ্ট আসতে দেবো না। আমি এই পাপ করতে পারবো না। আপনি নিজ হস্তে দেবী সীতাকে বনে দিয়ে আসুন। আর সাথে পতিধর্ম, পুত্রের প্রতি স্নেহ মমতাকে বিসর্জন দিয়ে আসুন।” শ্রীরাম বললেন- “ভ্রাতা! এই রাম, রাবণকে বধ করার শক্তি রাখে, কিন্তু সীতাকে স্বহস্তে বনে দিয়ে আসবার ক্ষমতা রাখে না। আমি নিরূপায় । বিধাতা এই শক্তি আমাকে দেন নি। আমি কিভাবে তাহাকে বলব- হে সীতা আমি তোমাকে ত্যাগ করলাম। ধরিত্রী দ্বিধাবিভক্ত হবে, আকাশ ভেঙ্গে পড়বে লক্ষ্মণ। তোমার অগ্রজ হয়ে আমি তোমার নিকট এই ভিক্ষা চাইছি যে তুমি এই কর্ম করো। নচেৎ আমি রাজকর্ম ছেড়ে , সকল প্রতিজ্ঞা ভুলে ভরতকে রাজা বানিয়ে আমি বনে চলে গিয়ে পূর্বপুরুষদের অভিশাপ সংগ্রহ করে নরকগামী হবো। লক্ষ্মণ তুমি বুঝবার চেষ্টা করো।” লক্ষ্মণ আর কি করেন, কোনরকমে রাজী হয়ে বললেন- “অগ্রজ! যদি আপনার এই ইচ্ছা হয়, তবে এই পাপ কর্ম আমি করবো। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাই- এই হেন পাপ করার পরে যেনো আমি জীবিত না থাকি । আমি কিভাবে মুখ দেখাবো ? কি ভাবে নিজেকে দর্পণে দেখবো ? এত বড় অধর্ম কেউ করে নি। আমি মহাপাপীষ্ঠ।” এই বলে লক্ষ্মণ কপালে শিরোঘাত করতে করতে চলে গেলেন । ভগবান শ্রীরাম খুবুই ভেঙ্গে পড়লেন ।

প্রভাতে দেবী সীতা অতি উত্তম বস্ত্রে সুসজ্জিতা হলেন। দিব্য আভূষণ সকল পরিধান করলেন। নক্ষত্র মণ্ডলীর ন্যায় সীতাদেবীর অলঙ্কার থেকে দ্যুতি নির্গত হতে লাগলো। তিঁনি অরণ্য ভ্রমণের জন্য ব্যাকুল । তিনি উত্তম, রূপে সুসজ্জিত হয়ে এসে ভগবান শ্রীরামকে প্রণাম করলেন । ভগবান শ্রীরাম চোখের জল চেপে বললেন- “সীতা তোমার ন্যায় সতী নারী এই জগতে নেই। তুমি প্রমান করলে নারীরা সর্বদা ত্যাগের মূর্তি। এক নারী স্বামীর সম্মানের জন্য যাবতীয় ভার নিজ ওপর ধারণ করতে পারে। হে সীতা! তুমি মহীষসী।” মাতা সীতা হাস্য করে বললেন- “প্রভু! আপনি এমন ভাবে বলছেন, যেনো আমি চিরতরে আপনার থেকে বিদায় নিচ্ছি। এমন বিষণ্ণ ভাবে আমাকে বিদায় জানাবেন না। সর্বদা আপনার প্রসন্ন ভরা মুখ আমি দেখি। সেই রূপেই আমাকে বিদায় দিন। আমি বন ভ্রমণ অন্তে পুনঃ আসবো।” শ্রীরামের কণ্ঠ রোধ হয়ে আসলো। চোখ ভেঙ্গে জল বেরিয়ে আসতে চাইলো। তবুও তিঁনি কোন মতে হাস্যমুখে বললেন- “সীতা! যেখানে যেই অবস্থায় থাকো, জানবে তুমি আমি অভিন্ন। এই দুই দেহ পৃথক কিন্তু অন্তরাত্মা এক । সীতার মধ্যেই রাম আর রামের মধ্যেই সীতা নিবাস করেন । সর্বদা আমি তোমার খেয়ালে, চিন্তনে থাকবো।” সীতাদেবী বিদায় নিলেন । তারপর তিন মাতা, দুভাই, তিন বোন ও অনান্য বয়োঃজ্যেষ্ঠ দের সাথে দেখা করে রথে উঠলেন। দেখলেন সারথি রূপে লক্ষ্মণ উপস্থিত । পিছনে দেখলেন শ্রীরাম ছলছল আঁখি নেত্রে কেবল তাঁহাকেই দেখছেন। সীতাদেবী এই সকলের কারণ কিছুই বুঝলেন না । রথ চলতে লাগলো। ধীরে ধীরে অযোধ্যা নগরী ছেড়ে রথ বের হল । তারপর ধীরে ধীরে বনের দিকে রথ প্রস্থান করলো।

( ক্রমশঃ ) 
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।