১২ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-৫৬)

ভগবান রামের মুখে এমন বাক্য শুনে যেনো ত্রিলোক স্তব্ধ হল । বিশ্ব চরাচর যেনো মূর্তির ন্যায় থেমে গেলো। উপস্থিত সকলের কর্ণে এই সংবাদ শোনা মাত্রই যেনো পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেলো। সকলে নিজের কর্ণকে বিশ্বাস করতেই পারলো না। বন্দিনী সীতাদেবী যিঁনি সদ্য মুক্ত হয়েছিলেন , তিঁনি যেনো এবার প্রস্তরীভূত হলেন । সীতাদেবীর মনে যেনো প্রলয় ঝড় আরম্ভ হল। নিজের কর্ণকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। একবার মনে হল ইনি সত্যই শ্রীরামচন্দ্র নাকি এখনও রাবণের মায়াবী কোন অনুচর বেঁচে আছে , যে রঘুনাথের রূপ ধরেছে । সীতাদেবীর চোখে থেকে অশ্রুধারা গাল বেয়ে নামলো। লক্ষ্মণ বলল- “দাদা! এ কেমন আদেশ আপনার ? আপনি সীতাদেবীকে সতীত্বের পরীক্ষা দিতে বলছেন – যিঁনি স্বয়ং সতী শিরোমণি! আপনি কি দেবী সীতার চতুর্দিকে অগ্নিতেজ প্রত্যক্ষ করছেন না? এ আপনি কিরূপে বলতে পারলেন ? গঙ্গাকে কি নিজ পবিত্রতার প্রমান দিতে হবে? অগ্নিকে কি নিজ শুদ্ধতার প্রমান দিতে হবে? সেইরূপ সীতামাতাকে অগ্নিপরীক্ষা প্রদানের কথা বলা মূর্খতা । তবে এই যদি করার ছিলো, তবে যুদ্ধ করলেন কেন? ” শ্রীরাম বললেন- “হে লক্ষ্মণ! শ্রবণ করো। রাবণ খুবুই অসৎ উদ্দেশ্যে সীতাকে হরণ করেছিলো। দীর্ঘ দশমাস সে লঙ্কায় নিবাস করেছে। সুতরাং অগ্নিপরীক্ষা ব্যতীত কিভাবে তাহাকে গ্রহণ করি? আমি এই যুদ্ধ করেছি কেবল সীতাকে উদ্ধার করার জন্য। আমি সূর্য বংশী। যদি নিজ স্ত্রীকে উদ্ধার না করতাম তবে বংশে কলঙ্ক লেপন হতো। ” শুনে লক্ষ্মণ ক্ষিপ্ত হয়ে বলল- “ভ্রাতা! আজ অবধি আপনার কোন নীতির বিরোধিতা করি নি। আজ করছি। এই কথা সতী নারী সীতাদেবীর অপমান । আমি আজ আপনার বিরুদ্ধে। প্রয়োজনে আপনার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবো।” হনুমান বলল- “প্রভু! মা সীতাদেবী সাক্ষাৎ যেনো অগ্নি স্বরূপা । অগ্নি চিতাতেও অবস্থান করে, আবার মন্দিরে প্রদীপে অবস্থান করে। তবুও অগ্নি সর্ব অবস্থায় শুদ্ধ ও পবিত্র! আমি দেখেছি প্রভু মাতা সীতা কিভাবে লঙ্কায় সতীত্ব ধর্ম পালন করেছেন।”

সীতাদেবী বললেন- “স্তব্ধ হও পুত্র হনুমান! উনি যখন চাইছেন আমার অগ্নিপরীক্ষা , আমি তা দেবো। রাবণ আমাকে হরণ করার সময় আমাকে স্পর্শ করেছিল- সে দৈব চক্রে আমার দুর্ভাগ্যে হয়েছিলো। কিন্তু এরপর রাবণ কদাপি আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি। কিন্তু মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম কেন আমার কথায় বিশ্বাস করবেন? তাঁহার ত প্রমান চাই । জগতে আজ দেখুক এক নারীকে কি কি পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়? মাতা ত্রিজটা, লঙ্কার রাক্ষসীরা জানে যে রাবণ আমায় স্পর্শ করতে পেরেছে কিনা? কিন্তু ওঁনার কাছে চাক্ষুষ প্রমান চাই । তাই আমি প্রদান করবো। কিন্তু হে শ্রীরাম! আমি আপনাকে প্রশ্ন করছি- দশমাস যাবত আপনিও আমার নিকট হতে অনেক দূরে ছিলেন, শূর্পনাখা সুন্দরী বেশে আপনাকে বিবাহ প্রস্তাব দিয়েছিলো- কিন্তু এক পত্নী রূপে আমার সে অধিকার নেই পতির অগ্নিপরীক্ষা গ্রহণ করি, যদি সেই অধিকার থাকতো- তবে কি আপনি অগ্নিপরীক্ষা দিতেন ? কদাপি দিতেন না । কারণ এমন ঘটনা ঘটেনি, আর ঘটবেও না। স্বয়ং মর্যাদা পুরুষোত্তম অগ্নিপরীক্ষা গ্রহণ করে জগতে সকল পুরুষকে সেই অধিকার দিলেন, যাহাতে তারা নিজ স্ত্রীর পরীক্ষা নেয়। দশমাস বন্দিনী ছিলাম আমি এক হতভাগ্য নারী। মুক্তি পেয়েও নিজের সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে- আমি এক হতভাগা নারী । যদি এই আপনার বিধান হয়- তবে আমি অগ্নিপরীক্ষা দেবো।” এই বলে সীতাদেবী আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে ক্রন্দন করতে লাগলেন । তারপর ক্রন্দনরত অবস্থায় বললেন- “ভ্রাতা লক্ষ্মণ ! তুমি চিতা প্রস্তুত করো। আমি অগ্নিপরীক্ষা দেবো। স্বয়ং অগ্নিদেব আমার সতীত্ব প্রমান করবেন ।” লক্ষ্মণ ক্রন্দন করতে করতে কাষ্ঠ সংগ্রহ করলো। ভগবান শ্রীরাম তখনও সীতাদেবীর দিকে মুখ ফিরিয়ে ছিলেন । শ্রীরামের নয়ন দ্বয় জলে ভাসছিলো- এই দৃশ্য কাহারো চোখে পড়ে নি । লক্ষ্মণ অনেক কাষ্ঠ দিয়ে চিতা সাজালো। তাহাতে শত কলস ঘৃত দেওয়া হল। অগ্নি প্রজ্বলন করা হল । সীতা দেবী বললেন- “হে অগ্নিদেব! যদি আমি কায় মন বাক্যে সতী হই, তবে তোমার তেজে যেনো আমার কোন ক্ষতি না হয়। হে অগ্নিদেব! তুমিই আজ সীতার সতীত্বের প্রমান দাও।”

সাতবার রামের চরণে প্রদক্ষিণ ।
প্রদক্ষিণ অগ্নিকে করেন বার তিন ।।
কনক অঞ্জলি দিয়া অগ্নির উপরে ।
যোড়হাতে জানকী বলেন ধীরে ধীরে ।।
শুন দেব বৈশ্বানর , তুমি সর্ব আগে ।
পাপ পুণ্য লোকের জানহ যুগে যুগে ।।
কায়মনবাক্যে যদি আমি হই সতী ।
তবে অগ্নি তব ঠাঁই পাব অব্যাহতি ।।
শিরে হাত দিয়া কান্দে সবে সবিশেষ ।
সীতা সতী অগ্নি মধ্যে করেন প্রবেশ ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

সীতাদেবী অগ্নিমধ্যে প্রবেশ করলেন। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো। ঘৃত পেয়ে অগ্নির জিহ্বা লকলক করে উঠলো। পর্বত প্রমান অগ্নিশিখা উঠলো। কাষ্ঠের ধূমে চতুর্দিকে ছাইলো। সকলে দেখলো সীতাদেবী সেই অগ্নির মধ্যে করজোড়ে বসে আছেন। তাহার নয়ন অশ্রু জলে ভেসে যাচ্ছে । আগুনের শিখা সকল প্রবল হয়ে জ্বলছে। যেনো সব ভস্ম করে দেবে। কিন্তু সীতাদেবী নির্বিকার ভাবে বসে আছেন। আগুনের তেজ তাঁহাকে স্পর্শ করতে পারছে না । এমনকি সীতাদেবীর মস্তকের একটি কেশ রাশি অবধি ভস্ম হল না। প্রবল উত্তাপ ও ঘৃত স্পর্শে জ্বলা প্রচণ্ড অগ্নিশিখায় সীতাদেবীর কিছুই ভস্ম হল না। তিঁনি বসে আছেন । এই দৃশ্য দেখে স্বর্গের দেবতা সকল সীতামাতার জয়ধ্বনি দিয়ে পুস্প বর্ষণ করতে লাগলেন সীতাদেবীর ওপরে। কৈলাসে গৌরী দেবী এই দেখে ক্রন্দন করে শিবকে বললেন- “প্রভু ! এই দৃশ্য দেখে আমার পূর্ব জন্মের ঘটনা স্মরণ হচ্ছে। আমিও দক্ষযজ্ঞে স্বামী নিন্দা সহ্য করতে না পেরে যজ্ঞাগ্নিতে ঝাঁপ দিয়েছিলাম। কেন প্রভু বারবার নারীদের সতী ধর্মের পরীক্ষা দিতে হয়? এই বিধান কেন প্রভু?” শিব বললেন- “দেবী! এতেই নারীদের ত্যাগ ও ধৈর্যের প্রকাশ ঘটে। নারীদের এই আত্মত্যাগ তাঁহাদের সতী ধর্মের চূড়ান্ত নিদর্শন । শ্রীরাম জানেন , সীতাদেবী মহাসতী। কিন্তু লোক সমাজে তাঁহার সতী ধর্মের প্রকাশ ঘটাতেই এই আয়োজন করেছেন । এর কারণ পরে নিজেই বুঝতে পারবে।” সীতাদেবীর আগুনে কিছুই হল না। অগ্নিদেবতা বৈশ্বানর আসলেন । সীতাদেবীকে নিয়ে চিতা থেকে নামলেন। মহা সতীর সতীত্ব দেখে আশ্চর্য হলেন ত্রিলোক। অগ্নিদেবতা বললেন- “হে শ্রীরাম ! আপনি স্বয়ং নারায়ণ, সীতাদেবী হলেন মা লক্ষ্মী। সীতা দেবী পবিত্রা সতী নারী। রাবণ তাঁহাকে লঙ্কায় স্পর্শ অবধি করতে পারেনি। আমরা দেবতারা তার সাক্ষী। সীতাদেবী গঙ্গা, অগ্নির ন্যায় চির শুদ্ধা। আপনি সীতাদেবীকে গ্রহণ করুন।

আজি হতে রাম মোর সফল জীবন ।
করিলাম আজি আমি সীতা পরশন ।।
বলি রাম, সীতারে না দিও মনস্তাপ ।
রাজ্য দগ্ধ হইবে জানকী দিলে শাপ ।।
যেই স্ত্রী শুনিবেক সীতার চরিত্র ।
সর্ব পাপ খণ্ডিয়া সে হইবে পবিত্র ।।
শ্রীরামের হাতে সীতা করি সমর্পণ ।
স্বস্থানে প্রস্থান অগ্নি করিলা তখন ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

সীতাদেবীকে এই ভাবে প্রভু শ্রীরামের হস্তে দিলেন অগ্নিদেবতা ।

জিমি ছীরসাগর ইন্দিরা রামহী সমর্পী আনি সো ।
সো রাম বাম বিভাগ রাজতিঁ রুচির অতি সোভা ভলী ।।
( তুলসীদাসী রামায়ণ )

অর্থাৎ- এই ঘটনা তেমন ভাবেই হল, যেমন ক্ষীর সমুদ্র মন্থনের পর দেবী লক্ষ্মী উদিতা হয়েছিলেন, এবং সমুদ্র দেবতা রত্নাকর তাঁর কন্যা লক্ষ্মী দেবীকে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর হাতে সমর্পণ করেছিলেন । সেই সীতাদেবী , প্রভু শ্রীরামের বামে অধিষ্ঠান করলেন।

মাতা লক্ষ্মী দেবীকে সমুদ্র তনয়া বলা হয়। এবং সমুদ্র দেব রত্নাকর কে নারায়ণের শ্বশুর বলা হয় । সেজন্য সমুদ্র থেকে উদিত চন্দ্রদেব , সমুদ্রে জাত দৈত্য জালন্ধরকে – লক্ষ্মী দেবীর ভ্রাতা বলা হয় ।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।