১২ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব – ১ )

ভয়হর মঙ্গল দশরথ রাম ।
জয় জয় মঙ্গল সীতা রাম ।।
মঙ্গলকর জয় মঙ্গল রাম ।
সঙ্গতশুভবিভবোদয় রাম ।।
আনন্দামৃতবর্ষক রাম ।
আশ্রিতবৎসল জয় জয় রাম ।।
রঘুপতি রাঘব রাজা রাম ।
পতিতপাবন সীতা রাম ।।

সুখে রাত্রি যাপন করলেন শ্রীরাম ও সীতাদেবী , ভরত ও মাণ্ডবী, লক্ষ্মণ ও ঊর্মিলা , শত্রুঘ্ন ও শ্রুতকীর্তি । কত দিবস পর অযোধ্যায় ফেরা। ভগবান শ্রীরামের সাথে আগত অতিথিরা সুখে রাত্রি কাটালেন । শ্রীরামের রাজ্যাভিষেকের দিন আগত হল । পুনর্বসু নক্ষত্র পূর্ণ চৈত্রমাস এই রাজ্যাভিষেকের তিথি। মুনি- ঋষি সকল শিষ্য সমেত আসলেন। ভারতের অনান্য রাজারা আসলেন। অযোধ্যা উৎসবে মুখরিত । বিবিধ রত্ন- ধন – ধেনু- বস্ত্র – ভূমি- আহার্য দান করা হবে । মুনি ঋষি গণ যেমন কৌশিক, যবক্রীত, গার্গ্য , গালব , কণ্ব , মেধাতিনন্দন , স্বস্ত্যাত্রেয় , অগ্যস্ত, অত্রি, নমুচি, প্রমুচি, সুমুখ, বিমুখ, নৃষঙ্গু , কবর্ষি , ধৌম্য, কৌশেয়, বশিষ্ঠ, কশ্যপ, বিশ্বামিত্র, গৌতম , জমদাগ্নি, ভরদ্বাজ এবং সপ্তর্ষি সকল তাঁহাদিগের শিষ্য সহ আসলেন । বহু ঋষিপত্নী তাঁহাদিগের শিষ্যা সহিত আসলেন । যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো সেই সকল বানর, মর্কট, লাঙ্গুর, ভল্লুকেরা আসলো । এছাড়া আসলেন অনেক বৈদিক ব্রাহ্মণ, বিশিষ্ট বণিক বৈশ্য ও ক্ষত্রিয়। যক্ষ, গন্ধর্ব এরাও আসলেন। স্বর্গের দেবতাবৃন্দ ছদ্দবেশে আসলেন। ব্রহ্মা ও সরস্বতী দেবী ছদ্দবেশে আসলেন। নারদ মুনি আসলেন। হর গৌরী ছদ্দবেশে আসলেন । মুনি ঋষি দিগকে ভগবান শ্রীরাম পাদ অর্ঘ দিয়ে পূজা করলেন । সকলে শ্রীরাম ও লক্ষ্মণের প্রশংসা করে বললেন- “আপনারা আমাদিগের উদ্ধার কর্তা । রাক্ষস দের ভয়ে ধর্ম যাগ যজ্ঞ বন্ধ হতে বসেছিলো। দশাননের অনুগত নিশাচরেরা আমাদিগের আশ্রমে আক্রমণ করে কন্যাদের অপহরণ ও সাধুদিগকে বধ করতো। হে শ্রীরাম আপনিই রাবণের অনুগত শক্তিশালী রাক্ষসদের নাশ করে আমাদের রক্ষা করেছেন। রাবণকে সংহার করে ধর্ম শাস্ত্র রক্ষা করেছেন। আপনাকে অনেক প্রণাম জানাই । মেঘনাদের ন্যায় প্রতাপী নিশাচরকে বধ করে শ্রী লক্ষ্মণ আমাদের অনেক উপকার করেছেন । আপনাকে প্রণাম।”

এরপর রাজ্যাভিষেকের পূজা আরম্ভ হল। ব্রাহ্মণেরা যজ্ঞ আরম্ভ করলেন। পবিত্র বৈদিক মন্ত্র পড়ে যজ্ঞে আহুতি দিলেন । কুল গুরু বশিষ্ঠ মুনি উঠে তখন বিবিধ নদী, কুণ্ডের পবিত্র বারিধারা দ্বারা ভগবান শ্রীরামের অভিষেক করালেন । নব বস্ত্র ও নানাবিধ নব অলঙ্কার দ্বারা শোভিত শ্রীরামকে সেই পরব্রহ্মের ন্যায় তেজস্বী মনে হতে লাগলো । অতঃ কপালে তিলক চর্চিত করে বশিষ্ঠ মুনি সেই রাজমুকুট পড়িয়ে দিলেন । পুস্পাদি গন্ধ দ্বারা অর্চনা করলেন। সকলে উঠে দাঁড়িয়ে পুস্প বর্ষণ করে শ্রীরামের জয়ধ্বনি করতে লাগলো ।

রাম বাম দিসি সোভতি রমা রূপ গুণ খানি ।
দেখি মাতু সব হরষীঁ জন্ম সুফল নিজ জানি ।।
( তুলসীদাসী রামায়ণ )

অর্থাৎ - প্রভু শ্রীরামচন্দ্রের বাম দিকে রূপ ও গুণের আকর রমা ( সীতাদেবী) শোভমান হলেন । সেই যুগল মূর্তি দর্শন করে সকল নিজ জন্ম সার্থক করে আনন্দিত হলেন ।

স্বয়ং অযোধ্যার নরেশ মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম ও বামে সীতাদেবী বসে আছেন সিংহাসনে । এই মনোহর দৃশ্য সকলে হাস্যমুখে দেখে নিজেদের নয়ন সার্থক করলেন । চোখের কাজ ঈশ্বর দর্শন । নাহলে আর হবে কি! সকলে ধন্য ধন্য করতে লাগলেন। পুস্পাদি দ্বারা ভগবান শ্রীরাম ও দেবী সীতার পূজাদি করলেন। হনুমান করজোড়ে দেখছিলেন। রাম সীতাদেবীর চরণে প্রণাম জানাচ্ছিল্লেন। হনুমানের এই আচরণ ভরত সহ অনেকের ভালো লাগছিলো না। ভাবছিলো জাতিতে পশু কতই না আদিখ্যেতা ! শ্রী ভরত তখন শ্রীরাম ও সীতাদেবীর উপর ছত্র ধারণ করলেন । শ্রী লক্ষ্মণ তখন চামর দুলাতে লাগলেন, শ্রী শত্রুঘ্ন পাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগলেন । এই দৃশ্য আরোও মধুর মনে হচ্ছিল্ল । দেবতারা নানা পুস্পাদি বর্ষণ করলেন। ভগবান শ্রীরাম ও মাতা সীতাদেবী ছদ্দবেশে থাকা দেবতাদের চিনতে পারলেন । জাম্বুবান , বিভীষণ, অঙ্গদ, সুগ্রীব, নল, নীল, কেশরী, গয়, গবাক্ষ, দিবিদ, মুকুন্দ আদি বানর বীরেরা ভগবানের জয়ধ্বনি করলেন ।

ফেলিয়া দিলেন ব্রহ্মা স্বর্ণ – পদ্মমালা ।
অলক্ষ্যে করিল শোভা শ্রীরামের গলা ।।
স্বর্ণ মণি মাণিক্য নির্মিত দিব্য- হার ।
ইন্দ্র পাঠাইয়া দিলো আরো অলঙ্কার ।।
নানাবিধ মণিমুক্তা পরশ পাথর ।
কুবেরের হার শোভে কণ্ঠের উপর ।।
দেবের ভূষণেতে হইয়া বিভূষিত ।
রাম রাজা হইলেন জগতে পূজিত ।।
শ্রীরামের অভিষেক শুনে যেই নরে ।
ঐহিক সম্পদ বাড়ে পরলোকে তরে ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

এই ভাবে শ্রীরাম শোভা পেলেন দেবী জানকী সহিত ।

শ্রী সহিত দিনকর বংস ভূষণ
কাম বহু ছবি সোহঈ ।
নব অম্বুধর বর গাত অম্বর
পীত সুর মন মোহঈ ।।
মুকুটাঙ্গগদাদি বিচিত্র ভূষন অঙ্গ
অঙ্গনহি প্রতি সজে ।
অম্ভোজ নয়ন বিসাল উর ভুজ
ধন্য নর নিরখঁতি যে ।।
( তুলসীদাসী রামায়ণ )

অর্থাৎ- সীতাদেবীর সহিত সূর্যবংশ বিভূষণ শ্রীরামচন্দ্রদেবের সৌন্দর্য তখন বহু মদনের যুগপৎ সৌন্দর্যকে ম্লান করেছিল । নবনীরদকান্তি শ্যামসুন্দর তখন পীতাম্বর ধারণ করে ছিলেন যা দেবতাদের মুগ্ধ করে দিয়েছিলো । অঙ্গে অঙ্গে তাঁর যখন কিরীট , বাজুবন্ধের বিচিত্র আভরণের অনুপম সজ্জা ছিল। তিনি তখন রাজীবায়তলোচন , প্রশস্ত বখঃস্থল ও আজানুলম্বিত বাহুতে অনিন্দ্যসুন্দর লাগছিলেন । ধন্য সেই সকল ব্যক্তি যাঁরা তাঁকে দর্শন করেছিলো ।

বশিষ্ঠ মুনি উঠে দাঁড়িয়ে নানা উপদেশ দিয়ে বললেন – “হে শ্রীরাম! তুমি সূর্যবংশী! সর্বদা রাজধর্ম নিষ্ঠা সহকারে পালন করবে । বর্ণাশ্রম ধর্ম রাজ্যে চালিত করবে । গো- ব্রাহ্মণ- শাস্ত্র ও প্রজাদিগকে রক্ষা করবে । প্রজাদের সন্তান জ্ঞানে পালন করবে। প্রজাদের দাবী মানতে নিজ ব্যক্তিগত স্বার্থ ত্যাগ করবে। হে শ্রীরাম! কদাপি বিস্মৃত হবে না- যে তুমি এই মহান কুলে আবির্ভূত- মহারাজ রঘুর দানের কথা স্মরণ করো, মহারাজ হরিশ্চন্দ্রের ত্যাগ ও সত্যের কথা স্মরণ রাখবে । মহারাজ সগর, অসমঞ্জ , অংশুমান, রাজা দীলিপ, রাজা ভগীরথের কথা স্মরণ রাখবে- যাঁরা রাজসুখ ছেড়ে মানব কল্যাণের জন্য দেবী গঙ্গাকে স্বর্গ থেকে ভূতলে আনতে কঠোর উপাসনা করেছেন। তাই সর্বদা মানব কল্যাণ করবে। নিজ সুখ ভুলে যাও। এই প্রতিজ্ঞা করো।” শ্রীরাম তখন উঠে দাড়িয়ে দেবতা, ঋষি মুনি, ত্রিদেব, গ্রহ, নক্ষত্র কুলকে সাক্ষী রেখে সেই প্রতিজ্ঞা করলেন । সকলে জয় জয় করতে লাগলেন । সীতাদেবী তখন শ্রীরামকে বললেন- “প্রভু! এবার আমি বানর সেনাদের পুরস্কার প্রদান করবো। এরা আমার উদ্ধারের জন্য কত না যাতনা সহ্য করেছে। আত্মীয় স্বজন ফেলে দূরে লঙ্কায় যুদ্ধ করেছে। অস্ত্রের আঘাত সহ্য করেও যুদ্ধ করছে। রাক্ষস বধ করে রাবণকে শক্তিহীন করেছে। ইহাদিগের কাছে আমরা চিরঋণী।” শ্রীরাম বললেন- “অবশ্যই দেবী! তুমি ইহাদের মনের মতো পুরস্কার প্রদান করো।” ব্রাহ্মণ, মুনি ঋষি দিগকে ধন, ধেনু, বস্ত্র, অর্থ, ভূমি , আহার্য দানের পর বানরদের সীতাদেবী নানা রত্ন প্রদান করতে লাগলেন ।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।