১২ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব- ৫০ )

রাক্ষস আর বানর দের মধ্যে প্রবল যুদ্ধ আরম্ভ হল। দেখা গেলো একপাশ হতে অপর পাশে বড় বড় শিলা আর বৃক্ষ ছুটে অপর দিকের সৈন্যদের মধ্যে আছরে পড়ছে। আবার সেদিক হতে বর্শা, শর ছুটে এসে এপাশে আছরে পড়ছে । যুদ্ধে চারিদিকে দেখা গেলো কেবল শর ছুটে ছুটে যাচ্ছে। দুপক্ষের সৈন্য একে অপরকে হত্যা করতে লাগলো । উচ্চ শব্দে অশ্ব গুলি এদিক সেদিক ছুটছিলো, তার থেকে কেবল শর নিক্ষেপ হচ্ছিল্ল। কপি কটকেরা সেই শরে ধরাশায়ী হলে, জাম্বুবান তার ভল্লুক বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ আরম্ভ করলো। ভল্লুকেরা লম্ফ দিয়ে অশ্ব গুলির ওপর পড়ে রাক্ষস দিগকে ছিন্নভিন্ন করলো। মৈন্দ, গবাক্ষ, নল, নীল, কেশরী আদি বানরেরা গদা দিয়ে আঘাত করে রাক্ষস দিগকে হত্যা করতে লাগলো। হনুমানের পরাক্রম দেখে তাজ্জব হল রাক্ষসেরা। নিজ তনু বিশাল আকৃতি করে পদ পিষ্টে রাক্ষস দের হস্তী, অশ্ব, রথ চূর্ণ করতে লাগলো । মনে হচ্ছিল্ল যেখন এক চলন্ত পর্বত যুদ্ধক্ষেত্র জুড়ে রাক্ষসদের পিষ্ট করে বেড়াচ্ছে । রাবণ দেখলো তার অনুগত বলশালী রাক্ষসেরা হনুমানের পদপিষ্ট হল । তাহার অপর হনুমান যখন স্বীয় গদা দিয়ে রাক্ষস বাহিনীর মধ্যে আঘাত করলো, মনে হল বিশাল পর্বতমালা রাক্ষসদের ওপর পতিত হল। চূর্ণ চূর্ণ হল স্বর্ণ রথ, হস্তী । অপরদিকে যেসব মদমত্ত হস্তী অতি গর্জন করে বানর দের পিষ্ট করছিলো , বানরেরা উচ্চ আকারের শিলা খণ্ড নিক্ষেপ করে হস্তীগুলিকে ধরাশায়ী করলো। রাক্ষস দের হাতের অস্ত্র গুলি বানরদের রক্তে লিপ্ত হল। এবং বানর দের রক্তমাখা শিরা গুলি রাক্ষসদের অঙ্গে রক্তিম মাল্যের ন্যায় শোভা পাচ্ছিল্ল । শ্রী লক্ষ্মণ তখন যুদ্ধে নামলেন। প্রথমেই বায়ুবান নিক্ষেপ করলেন। লক্ষ্মণের ধনুক থেকে বায়ুবাণ অতি প্রবল বেগে ছোটার সাথে সাথে যেনো যুদ্ধ ভূমিতে ঝড় নেমে এলো। বায়ুবানের আঘাতে রাক্ষসেরা সব উড়ে উড়ে সমুদ্রে পড়ে গভীর জলে তলিয়ে গেলো। কেউ আবার অতি উচ্চ আকাশ থেকে ভূমিতে পড়ে চূর্ণ হল। রাক্ষসেরা মায়াযুদ্ধ আরম্ভ করলে , লক্ষ্মণ গন্ধর্ব বাণ নিক্ষেপ করলেন। গন্ধর্বদের মায়ায় রাক্ষসেরা নিজেদের মধ্যে কাটাকাটি করে মরতে লাগলো ।

রাবণ তখন বাণ বর্ষণ করে কপিদের হত্যা করতে লাগলো। অঙ্গদ এলো সামনে। অঙ্গদের সাথে রাবণের প্রবল গদাযুদ্ধ আরম্ভ হল।

গহি ভূমি পার্যোক লাত মার্যোা
বালিসুত প্রভু পহিঁ গয়ো ।
( তুলসীদাসী রামায়ণ )

তখন অঙ্গদ রাবণকে এক পদাঘাতে মাটিটে ফেলে দিয়ে প্রভু শ্রীরামের কাছে গেলেন। অঙ্গদের পদাঘাত সহ্য করতে রাবণের অল্প সময় লেগেছিল। তখন রাবণ বুঝলো কেন সেদিন রাজসভায় কেউ অঙ্গদের পা টলাতে সমর্থ হয় নি । সকলে দেখলো রাবণ হাস্য করছে । দেখতে দেখতে রাবণের তনু বৃদ্ধি পেলো। কুঁড়ি হস্ত হল। দশমুখ মেলে রাবণ এমন হাসতে লাগলো, যেনো ত্রিলোকে প্রলয় নেমে আসবে ।

তব রঘুপতি রাবন কে সীস
ভুজা সর চাপ ।
কাটে বহুত বঢ়ে পুনি
জিমি তীরথ কর পাপ ।।
( তুলসীদাসী রামায়ণ )

তখন ভগবান শ্রীরাম , রাবণের দিকে বাণের পর বাণ নিক্ষেপ করলেন। রঘুনাথের শরে রাবণের মস্তক, বাহু, ধনুর্বাণ সকলই খণ্ড খণ্ড হল । সেই সকল আবার নতুন করে বেড়ে উঠলো যেমন তীর্থ ধামে কোন পাপ করলে তার ফল অত্যাধিক বৃদ্ধি পায় ।

তখন বানর সেনারা বলল- “এই মূর্খকে বাহু মস্তক কেটে দিলেও ত মরছে না।” এই বলে অঙ্গদ, হনুমান, নল, নীল, সুগ্রীব, দিবিদ আদি বানরেরা রাবণের দিকে বৃক্ষ ও পর্বত খণ্ড নিক্ষেপ করতে লাগলো। রাবণ কুড়ি হস্ত দিয়ে তা লুফে নিয়ে পুনঃ বানরদের দিকে ছুড়লো। বানরের ধরাশায়ী হল। তখন বানরেরা লম্ফ দিয়ে রাবণের শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়লো। যেনো বট বৃক্ষে চড়াই পাখী শোভা পাচ্ছে এমন মনে হল। কেউ রাবণের শরীরে আঁচর কামড় দিলো। হুপ হুপ শব্দ করে বানর গুলো রাবণের সমস্ত দেহ রক্তাক্ত করলো। একজন রাবণকে পদাঘাত করলো। নল ও নীল রাবণের কীরিটে উঠে রাবণের কপালে ক্ষত সৃষ্টি করলো আঁচর দিয়ে । রাবণ গা ঝাড়া দিয়ে সব বানরদের ফেলে দিলেন । জাম্বুবান ভল্লুক দল নিয়ে এগিয়ে এলে রাবণ তার মুষল নিক্ষেপ করলেন । মুষলের আঘাতে জাম্বুবানের ভল্লুক সেনা ধরাশায়ী হলে জাম্বুবান পালালো। রাবণ দেখলো ক্রমশঃ তার রাক্ষস সেনা কমে আসছে। রাবণ তখন মায়া দ্বারা পিশাচ পিশাচিনী দের আহ্বান করলেন । তারা এসে মায়া দ্বারা কপিদের বধ করতে লাগলো ।

জব কীনহ তেহিঁ পাষণ্ড ।
ভএ প্রগট জন্তু প্রচণ্ড ।
বেতাল ভূত পিসাচ ।
কর ধঁরে ধনু নারাচ ।।
জোগিনি গহেঁ করবাল ।
এক হাথ মনুজ কপাল ।
করি সদ্য সোনিত পান ।
নাঁচহি করহিঁ বহু গান ।।
( তুলসীদাসী রামায়ণ )

সেই সকল অদ্ভুদ বেতাল, ভূত, পিশাচ বানর সেনাদের বধ করতে থাকলে, বানর সেনারা পালাতে লাগলো । তখন ভগবান শ্রীরাম একটি মাত্র শর সন্ধান করে সেই অদ্ভুত বেতাল, ভূত, পিশাচ, বানর দের সদ্গতি করলেন । তখন রাবণ একাই থাকলো । অট্টহাস্য করে কুড়ি হস্ত দিয়ে নানা ঘাতক অস্ত্র নিক্ষেপ করতে লাগলো। সেই সকল অস্ত্র জলন্ত ধূমকেতুর ন্যায় বানর দলে এসে পড়ছিলো। বানরেরা ঝলসে মারা যাচ্ছিল্ল । রাবণের দশমুখের হাস্য চতুর্দিকে বিস্তৃত হল । তাহার পর ভগবান রামের সাথে রাবণের যুদ্ধ আরম্ভ হল। আকাশে তখন হংস পৃষ্ঠে ব্রহ্মা- দেবী সাবিত্রী সহ অবস্থান করছিলেন , দেবাদিদেব পরমেশ্বর ভগবান শিব , দেবী গৌরী সহিত বৃষে অবস্থান করে যুদ্ধ করছিলেন । ইন্দ্র, পবন, বরুণ, যম, অগ্নি, চন্দ্রদেব, সূর্য দেব, নবগ্রহ , নারদ সহ সপ্তর্ষি , বিশ্বকর্মা, গরুর, ধন্বন্তরি, অশ্বিনী কুমার, দেবামাতা অদিতি, দেবতাদের পত্নী সহ শচী দেবী অপ্সরা বৃন্দ ও অনান্য দেবতারা নানান বাহনে উপস্থিত হয়ে এই যুদ্ধ দর্শন করছিলেন । ভগবান রাম তখন রাবণের নিক্ষেপিত সকল দিব্যাস্ত্রকে খণ্ডন করলেন। উল্কার পিণ্ডের ন্যায় সেই দিব্যাস্ত্রের খণ্ড খণ্ড অংশ ধরিত্রীর বুকে ঝরে পড়তে লাগলো। তখন ভগবান রাম নানা দিব্যাস্ত্রে রাবণের মুণ্ড সকল কেটে ফেললেন। কিন্তু রাবণের মৃত্যু আর হয় না। কাটা মুণ্ড মাটিটে পরে পুনঃ ধড়ে এসে সংযোজিত হল। বানরেরা মুণ্ডচ্ছেদ হতে দেখে জয়ধ্বনি করছিলো আবার মুণ্ড জোড়া লাগতেই আশাহত হচ্ছিল্ল । ভগবান শ্রীরাম বারবার রাবণের মুণ্ড কাটতে লাগলেন, বারবার জোড়া লাগলো । একসময় রাবণের আসল মুণ্ড কাটলেন, কিন্তু সেটিও আবার ধড়ে এসে জোড়া লাগলো । প্রবল যুদ্ধ হতে লাগলো ।

( ক্রমশঃ ) 
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।