শ্রীরাম প্রাসাদে ফিরে স্তব্ধ হয়ে গেলেন । টলতে টলতে এসে শয্যা সে বসলেন। নিজের কর্ণ কে বিশ্বাস করতে পারলেন। সত্যই বলেছে দুর্মুখ যে এই সকল কথা অযোধ্যাবাসীদের মুখ থেকে নির্গত হবে এটা বিশ্বাস হয় না । শ্রীরামচন্দ্রের সমস্ত শরীর বিষন্নতায় ভরে গেলো। মুখমণ্ডলে সেই চিহ্ন পরিষ্কার বোঝা গেলো। তিনি পদচারনা করে ভাবতে লাগলেন কেন এমন হল ? সীতার মতো সতীকেই যদি এত লাঞ্ছনা গঞ্জনা সহ্য করতে হয় তবে আর সকল নারীদের কপালে না জানি কি দুর্ভাগ্য ধেয়ে আসে । এই সৃষ্টির অদ্ভুত নিয়ম । ভাবতে লাগলেন শ্রীরাম । কি হবে এই সকল কথা সীতার কর্ণগোচর হলে। সে হয়তো লজ্জায় আর বাঁচবে না । হায় ! গর্ভবতী সীতার কপালে এত দুঃখ। শ্রীরামের মনে প্রাণে বারবার কুলগুরু বশিষ্ঠদেবের কথা ভেসে উঠতে লাগলো- “হে রাম! প্রজার সেবা করাই রাজার একমাত্র কর্তব্য। রাজার কোন আত্মীয় নেই, রাজার কোন সংসার নেই। সমস্ত রাজ্যই রাজার সংসার। সমস্ত রাজ্যবাসীই রাজার আত্মীয়। রাজার কর্তব্য সেই রাজ্যবাসীদের সেবা করা – তাদিগের মতামতকে মেনে চলা। নিজের ব্যক্তিগত সুখ ত্যাগ করে রাজার কর্তব্য প্রজার সেবা করা, তাঁহাদিগের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া কর্তব্য- নচেৎ সেই রাজা ভ্রষ্ট হয়।” শ্রীরামচন্দ্রের মনে যেনো মন্থন চলতে থাকলো। একদিকে অযোধ্যার রাজা শ্রীরাম, অপরদিকে সীতার স্বামী রাম। উভয়ে মিলে যেনো শ্রীরামের মন কে টানাটানি করতে লাগলো। কখনো কর্তব্য রূপে শ্রীরামের মন কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে সঙ্কল্প হল আবার কখনো বা সীতার স্বামী রূপে সীতার প্রতি দায়বদ্ধ হল । ভেবে পাচ্ছেন না শ্রীরাম কি করবেন । রাজা রূপে তিনি যদি এখন প্রজাদের মতামতকে স্বীকার না করেন তবে তিনি রাজা হিসাবে ভ্রষ্ট হবেন । আবার সীতার প্রতি অন্যায় করলে তিনি স্বামী রূপে পৃথিবীতে কলঙ্ক প্রাপ্তি করবেন । কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। কপালে শিরোঘাত করে ভাবতে লাগলেন । দুই রকম মনোভাব ফুটে উঠলো। আর কখনো চোখের সামনে অযোধ্যার সিংহাসন ভেসে উঠলো, আবার চোখের সামনে কখনো বা সীতার কোমল নিস্পাপ মুখ ভেসে উঠলো ।
একবার ভাবলেন দায়িত্ব ছেড়ে তিঁনি সীতাকে নিয়ে কোথাও দূরে চলে যাবেন । ভরত নিজেই রাজ্যভার সামলে নেবে। এতে প্রজাদের মতামত কে গুরুত্ব দেওয়া হবে আবার সীতার প্রতি কোন অবিচার হবে না । পরে ভাবলেন এ কি সব চিন্তা করছেন। কর্তব্য ছেড়ে পলায়ন করা ত মহাপাপ । এই সকল প্রজা তাহাকেই ত অযোধ্যার রাজারূপে কামনা করেছেন। তাহলে প্রজাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা হবে। এতে ত আরোও বড় পাপ হবে। এই কর্ম করা বড় পাপ । প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে প্রজাদের সেবা করবেন। নিজের সুখ বিসর্জন দিয়েও প্রজাদের মতামতকে গুরুত্ব দেবেন । শ্রীরাম একাকী ভাবছেন। রঘুবংশের কথা ভাবছেন। রাজা হরিশ্চন্দ্র কি নিজের সুখের কথা ভেবেছেন – নাকি নিজ প্রতিজ্ঞায় অটল থেকে এক কাপড়ে স্ত্রী পুত্র সহিত বের হয়ে গেছিলেন, মহর্ষি বিশ্বামিত্রকে সব কিছু দান করে । রাজা সগর, রাজা অসমঞ্জ , রাজা অংশুমান, রাজা দীলিপ , রাজা ভগীরথ এই সকল পূর্বপুরুষেরা কি নিজের স্বার্থের জন্যই গঙ্গাকে মর্তে এনেছিলেন নাকি সমগ্র বিশ্ববাসীর মঙ্গলের জন্য। কি দরকার ছিলো তাহাদের রাজসুখ ত্যাগ করে প্রজা কল্যাণের জন্য বনে গিয়ে বছরের পর বছর তপস্যা করার । “প্রান যায়- বচন না যায়”- প্রাণ যাক- কিন্তু প্রতিজ্ঞা থেকে যেনো বিচ্যুত না হই – এই ত রঘুবংশের মূল কথা । ভাবলেন বৃদ্ধ রাজা অনরণ্যের কথা- তিনিও ত রঘুবংশীয়। কি দরকার পড়েছিলো বৃদ্ধ অবস্থায় রাবণের সাথে যুদ্ধ করে পরাজয় নিশ্চিত জেনে, এই সকল ত প্রজাদের সুরক্ষার জন্য, প্রজাদের নিমিত্ত । ভাবলেন তাঁর পিতার কথা। রাজা দশরথ প্রাণ দিয়েছেন, কিন্তু তাঁর প্রতিজ্ঞার কথা মেনেই চতুর্দশ বৎসর বনে কাটানো হয়েছে । এই মহান কুলে আবির্ভূত হয়ে কিভাবে প্রতিজ্ঞার কথা, দায়িত্বের কথা অস্বীকার করা যায় ? তাহলে পূর্বপুরুষদের ইতিহাসে কলঙ্ক লেপন করা হবে । আবার ভাবছেন- নির্দোষ সীতার ওপর কিভাবে অন্যায় করে তাহাকে ত্যাগ করা যাবে ? সে পূর্ণ সতী। দেবতারা তাহার সাক্ষ্য দিয়েছেন । এই হেন সতী নারীকে কোন দোষে ত্যাগ করা যায় । তার ওপর সে গর্ভবতী। সীতাকে ত্যাগ করলে তাঁর গর্ভের সন্তান তথা রঘুবংশের বংশধরের ওপরেও অন্যায় করা হবে ।
এভাবে ভাবতে ভাবতে শ্রীরাম ভাবলেন – কিন্তু কিছুই করার নেই। সমগ্র অযোধ্যার দায়িত্ব তাঁহার স্কন্ধে। কোন কিছুর দায়িত্ব নিলে তা সর্ব ভাবে সুসম্পন্ন করাই ধর্ম । দায়িত্ব ছেড়ে পলায়ন করা অধর্ম । রাজার ব্যক্তিগত সুখ- দুঃখ বলে কিছু হয় না । রাজ্যের উন্নতি রাজার সুখ, রাজ্যের অবনতি রাজার দুঃখ । কুলগুরু বশিষ্ঠ ইহাই বলেছেন । সুতরাং কর্তব্য আগে। এই ভেবে রামচন্দ্র নিজের মনকে শক্ত করলেন। রামচন্দ্রের মধ্য থেকে সীতাপতি শ্রীরাম বিলুপ্ত হয়ে অযোধ্যার রাজা শ্রীরামচন্দ্র পূর্ণ ভাবে বিকশিত হলেন । শ্রীরামের মনে হল এখন তিনি রাজার ন্যয় কর্তব্য করবেন। জানি এতে অধর্ম হবে কিন্তু প্রজার মতামত না মেনে নিলে সবথেকে বড় অধর্ম হবে । ভাবলেন সীতাকে বনে প্রেরণ করবেন। সীতার অদৃষ্টে এই হয় তো বিধাতা লেখেছিলেন । এই ভেবে তিঁনি চোখের জল মুছে কঠোর মূর্তি অবলম্বন করলেন। সীতার দিকে গেলেন। গর্ভবতী সীতার ঘুমন্ত অবস্থা দেখে পুনঃ তিঁনি ভেঙ্গে পড়লেন। অঝোরে অশ্রু বিসর্জন করলেন। পুনঃ অশ্রুজল মুছে শক্ত হলেন । সীতাদেবী উঠে বললেন- “প্রভু! আমি গর্ভাবস্থায় খুব অলক্ষুণে স্বপ্ন দেখেছি, দেখলাম আমাকে কে যেনো আপনার থেকে অনেক দূরে নিয়ে চলে গেছে। যাহা দেখে আমি খুবুই ভীত হয়েছি।” শ্রীরাম বললেন- “সীতা! তুমি ক্ষত্রিয়া নারী। এত সামান্য স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে যাওয়া তোমাকে মানায় না। রাম ও সীতা কদাপি অভিন্ন ছিলো না । রাম ও সীতাকে কেউ ভিন্ন করতে পারে না।” সীতা দেবী বললেন- “প্রভু! আর আপনার থেকে দূরে সড়ে থেকে বাঁচতে পারবো না । এই বিচ্ছেদ সহ্য হয় না। লোকে আমাকে বসুমতীর পুত্রী বলে। কিন্তু সর্বংসহা বসুধার পুত্রী হয়েও এই বিচ্ছেদ সহ্যের শক্তি আমার নেই।” শ্রীরাম বললেন- “সীতা! বিধাতার ইচ্ছায় যে কি হয় আমরা তাহা কেউ অনুমান করতে পারি না, তবুও তাহা আমাদের সহ্য করতে হয়। বিধাতাই সেই শক্তি যুগিয়ে দেন। আদিকাল থেকে সংসার এই নিয়মেই চলে আসছে।” এই বলে শ্রীরামচন্দ্র সীতাদেবীকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন ।
( ক্রমশঃ )
একবার ভাবলেন দায়িত্ব ছেড়ে তিঁনি সীতাকে নিয়ে কোথাও দূরে চলে যাবেন । ভরত নিজেই রাজ্যভার সামলে নেবে। এতে প্রজাদের মতামত কে গুরুত্ব দেওয়া হবে আবার সীতার প্রতি কোন অবিচার হবে না । পরে ভাবলেন এ কি সব চিন্তা করছেন। কর্তব্য ছেড়ে পলায়ন করা ত মহাপাপ । এই সকল প্রজা তাহাকেই ত অযোধ্যার রাজারূপে কামনা করেছেন। তাহলে প্রজাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা হবে। এতে ত আরোও বড় পাপ হবে। এই কর্ম করা বড় পাপ । প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে প্রজাদের সেবা করবেন। নিজের সুখ বিসর্জন দিয়েও প্রজাদের মতামতকে গুরুত্ব দেবেন । শ্রীরাম একাকী ভাবছেন। রঘুবংশের কথা ভাবছেন। রাজা হরিশ্চন্দ্র কি নিজের সুখের কথা ভেবেছেন – নাকি নিজ প্রতিজ্ঞায় অটল থেকে এক কাপড়ে স্ত্রী পুত্র সহিত বের হয়ে গেছিলেন, মহর্ষি বিশ্বামিত্রকে সব কিছু দান করে । রাজা সগর, রাজা অসমঞ্জ , রাজা অংশুমান, রাজা দীলিপ , রাজা ভগীরথ এই সকল পূর্বপুরুষেরা কি নিজের স্বার্থের জন্যই গঙ্গাকে মর্তে এনেছিলেন নাকি সমগ্র বিশ্ববাসীর মঙ্গলের জন্য। কি দরকার ছিলো তাহাদের রাজসুখ ত্যাগ করে প্রজা কল্যাণের জন্য বনে গিয়ে বছরের পর বছর তপস্যা করার । “প্রান যায়- বচন না যায়”- প্রাণ যাক- কিন্তু প্রতিজ্ঞা থেকে যেনো বিচ্যুত না হই – এই ত রঘুবংশের মূল কথা । ভাবলেন বৃদ্ধ রাজা অনরণ্যের কথা- তিনিও ত রঘুবংশীয়। কি দরকার পড়েছিলো বৃদ্ধ অবস্থায় রাবণের সাথে যুদ্ধ করে পরাজয় নিশ্চিত জেনে, এই সকল ত প্রজাদের সুরক্ষার জন্য, প্রজাদের নিমিত্ত । ভাবলেন তাঁর পিতার কথা। রাজা দশরথ প্রাণ দিয়েছেন, কিন্তু তাঁর প্রতিজ্ঞার কথা মেনেই চতুর্দশ বৎসর বনে কাটানো হয়েছে । এই মহান কুলে আবির্ভূত হয়ে কিভাবে প্রতিজ্ঞার কথা, দায়িত্বের কথা অস্বীকার করা যায় ? তাহলে পূর্বপুরুষদের ইতিহাসে কলঙ্ক লেপন করা হবে । আবার ভাবছেন- নির্দোষ সীতার ওপর কিভাবে অন্যায় করে তাহাকে ত্যাগ করা যাবে ? সে পূর্ণ সতী। দেবতারা তাহার সাক্ষ্য দিয়েছেন । এই হেন সতী নারীকে কোন দোষে ত্যাগ করা যায় । তার ওপর সে গর্ভবতী। সীতাকে ত্যাগ করলে তাঁর গর্ভের সন্তান তথা রঘুবংশের বংশধরের ওপরেও অন্যায় করা হবে ।
এভাবে ভাবতে ভাবতে শ্রীরাম ভাবলেন – কিন্তু কিছুই করার নেই। সমগ্র অযোধ্যার দায়িত্ব তাঁহার স্কন্ধে। কোন কিছুর দায়িত্ব নিলে তা সর্ব ভাবে সুসম্পন্ন করাই ধর্ম । দায়িত্ব ছেড়ে পলায়ন করা অধর্ম । রাজার ব্যক্তিগত সুখ- দুঃখ বলে কিছু হয় না । রাজ্যের উন্নতি রাজার সুখ, রাজ্যের অবনতি রাজার দুঃখ । কুলগুরু বশিষ্ঠ ইহাই বলেছেন । সুতরাং কর্তব্য আগে। এই ভেবে রামচন্দ্র নিজের মনকে শক্ত করলেন। রামচন্দ্রের মধ্য থেকে সীতাপতি শ্রীরাম বিলুপ্ত হয়ে অযোধ্যার রাজা শ্রীরামচন্দ্র পূর্ণ ভাবে বিকশিত হলেন । শ্রীরামের মনে হল এখন তিনি রাজার ন্যয় কর্তব্য করবেন। জানি এতে অধর্ম হবে কিন্তু প্রজার মতামত না মেনে নিলে সবথেকে বড় অধর্ম হবে । ভাবলেন সীতাকে বনে প্রেরণ করবেন। সীতার অদৃষ্টে এই হয় তো বিধাতা লেখেছিলেন । এই ভেবে তিঁনি চোখের জল মুছে কঠোর মূর্তি অবলম্বন করলেন। সীতার দিকে গেলেন। গর্ভবতী সীতার ঘুমন্ত অবস্থা দেখে পুনঃ তিঁনি ভেঙ্গে পড়লেন। অঝোরে অশ্রু বিসর্জন করলেন। পুনঃ অশ্রুজল মুছে শক্ত হলেন । সীতাদেবী উঠে বললেন- “প্রভু! আমি গর্ভাবস্থায় খুব অলক্ষুণে স্বপ্ন দেখেছি, দেখলাম আমাকে কে যেনো আপনার থেকে অনেক দূরে নিয়ে চলে গেছে। যাহা দেখে আমি খুবুই ভীত হয়েছি।” শ্রীরাম বললেন- “সীতা! তুমি ক্ষত্রিয়া নারী। এত সামান্য স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে যাওয়া তোমাকে মানায় না। রাম ও সীতা কদাপি অভিন্ন ছিলো না । রাম ও সীতাকে কেউ ভিন্ন করতে পারে না।” সীতা দেবী বললেন- “প্রভু! আর আপনার থেকে দূরে সড়ে থেকে বাঁচতে পারবো না । এই বিচ্ছেদ সহ্য হয় না। লোকে আমাকে বসুমতীর পুত্রী বলে। কিন্তু সর্বংসহা বসুধার পুত্রী হয়েও এই বিচ্ছেদ সহ্যের শক্তি আমার নেই।” শ্রীরাম বললেন- “সীতা! বিধাতার ইচ্ছায় যে কি হয় আমরা তাহা কেউ অনুমান করতে পারি না, তবুও তাহা আমাদের সহ্য করতে হয়। বিধাতাই সেই শক্তি যুগিয়ে দেন। আদিকাল থেকে সংসার এই নিয়মেই চলে আসছে।” এই বলে শ্রীরামচন্দ্র সীতাদেবীকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন ।
( ক্রমশঃ )
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন