১২ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব –১২)

সীতা দেবী তখন নিজ অশ্রু মুছে বললেন- “ভ্রাতা লক্ষ্মণ! কাকে কি কারণে দণ্ড দেবো ? দণ্ড দিতে চাইলে আমার স্বামী বহু পূর্বে দণ্ড প্রদান করতেন । নারীদের সন্দেহ করার বিধান কি সেই সকল প্রজারা রচনা করেছে যে তাহাদিগকে দণ্ড প্রদান করতে হবে। লক্ষ্মণ এই ভ্রান্ত নীতি বহু পূর্ব হতেই চলে আসছে। যার বলি হয়েছে আমার ন্যায় অসংখ্য সীতা। কখনো ধর্মের নামে, কখনো সতী প্রথার নামে, কখনো মান মর্যাদার নামে । রাবণের ন্যায় নারী নিপীড়কদের দণ্ডের প্রথা কেউ রচিত করে না। কিন্তু রাবণের দ্বারা লাঞ্ছিতা কন্যাদের দণ্ড প্রদানের নীতি সকলেই ঘোষিত করে । এই নিয়ম- দণ্ড প্রদান করে, এক দুদিনে পরিবর্তন হবে না। সমগ্র নারীজাতি নিজেদের সামর্থ্যে এই ভ্রান্ত নীতির দূরীকরণের কথা একদিন ঘোষণা করবে। আর সেই সমস্ত নারী দের পথ প্রদর্শক হবো এই আমি। আমি স্বামীর আদেশ মেনে এই ত্যাগ মেনে নিলাম । রঘুবীর সকলই জানেন। আমি জানি তিঁনি কতটা দুঃখে এই কর্ম করেছেন । আমি আর কি বলিব ? লক্ষ্মণ তুমি তোমার অগ্রজের আদেশ মেনে নাও।” লক্ষ্মণ বলল- “বৌঠান! এই অন্যায় কিভাবে করি ? আপনি বরং নিকটে মহর্ষি বাল্মিকীর আশ্রমে চলুন। সেখানে আমি আপনার ভৃত্য হয়ে আপনার সেবা করবো। এই অধর্ম আজ আমার হাত দিয়ে হচ্ছে, ইহা ভাবলেই আমি লজ্জিত হই। আমার বিবেক আমাকে দংশন করে। আমার অগ্রজ খুবুই সরল। একবাক্যে বনে চলে গেলেন, আপনার অগ্নিপরীক্ষা নিলেন আবার আপনাকে ত্যাগ করলেন- তাও কিছু মূর্খের কথা শুনে। কেন বারবার আমার অগ্রজের সরলতার জন্য আপনার জীবনে দুঃখ নেমে আসে ?” সীতা দেবী বললেন- “লক্ষ্মণ এই সকল হচ্ছে পরীক্ষা। নারীর জীবনে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা কি জানো- তাহার ধৈর্য, সেবা আর পতিব্রত ধর্ম । স্বামীর ছায়া হয়ে থাকাই নারীজাতির বড় ধর্ম । সকল নারীকেই এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়, সেই জগতে ‘সতী’ নামে খ্যাতা হন। তাঁর মাহাত্ম্য ত্রিলোকে ঘোষিত হয় ।”

এরপর সীতাদেবী আরোও বললেন- “লক্ষ্মণ! নিজ সূর্য বংশের কুল কে অশব্দ বোলো না। তোমার অগ্রজ যে কতটা দুঃখে আছেন ইহা আমি অনুভব করি । তুমি রাজধর্ম মেনে রাজাজ্ঞা পালন করো। মনে রাখবে, তোমার অগ্রজ একজন রাজা। রাজার নিকট তার রাজ কর্তব্য সবার ওপরে। এবার তুমি তোমার রাজ্যে ফিরে যাও। তোমার অগ্রজের সেবাভার গ্রহণ করো। মাতাদের সেবা করো। প্রজাদের পালন করো।" তখন লক্ষ্মণ বললেন- "বৌঠান! আমি ফিরে গিয়ে অগ্রজকে কি বলবো ?” তখন সীতাদেবী বললেন- “লক্ষ্মণ ! তুমি গিয়ে তোমার অগ্রজ তথা আমার স্বামীকে আমার প্রণাম জানাবে। ইহা জানাবে যে এই ঘটনায় সীতার মনে কোন ক্ষোভ নেই। স্বামীর কর্তব্যে স্ত্রী কদাপি বাধা হয় না, বরং স্ত্রীই স্বামীর কর্তব্যের অনুপ্রেরণা হয় । আমি জানি কি পরিস্থিতিতে উনি আমাকে ত্যাগ করেছেন। আমি তবুও বলবো সমগ্র অযোধ্যাবাসীর মঙ্গল হোক। সকলের গৃহ সুখ আনন্দে ভরে উঠুক । আর আমার স্বামীর সংসারে মঙ্গল হোক। প্রতি গৃহের স্ত্রীই আদতে গৃহলক্ষ্মী। স্ত্রী হল সেই প্রদীপের সলতের ন্যায় , যে প্রচণ্ড দাবদাহ সমান অনল কে ধারণ করে অন্ধকার দূর করে আলোময় করে তোলে। তুমি মাতাদিগকে প্রনাম জানাবে। আমার প্রচণ্ড দুর্ভাগ্য যে আমি আমার স্নেহশীলা তিন মাতার সেবা করতে পারলাম না। তাঁহাদের বলবে হয়তো সীতা পূর্বজন্মে কোন স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়েছিল, তাই বিধাতা এই জন্মে সীতাকে এইরূপ দণ্ড দিয়েছেন। আর আমার তিন ভগিনী আমার প্রাণ। তাহাদের বলবে তাহারা যেনো মন দিয়ে সংসার ধর্ম পালন করে, স্বামীকে সেবা করে, সর্বোপরি তিন মায়ের যেনো সেবা করে। ইহাই তাহাদের বড় ভগিনীর আদেশ জানাবে। আর মিথিলায় আমার পিতামাতাকে জানাবে যে তাঁহাদের সীতা যেখানেই থাকুক কুশলে আছে । জানিনা ইহজন্মে আমার স্বামীর সাথে সাক্ষাৎ হবে কিনা। এক স্ত্রী রূপে আমি আজ ত্যাগের ভূমিকা পালন করে স্বামীর কর্তব্যে সহায়িকা হলাম। কিন্তু আমি একজন নারী। যদি কোনদিন ওঁনার সাথে সাক্ষাৎ হয়- তবে সেদিন আমি জগতের সকল নারীর পক্ষ হতে ওঁনার মাধ্যমে সমাজের কাছে একটি প্রশ্ন করবো। এবার তুমি অযোধ্যায় ফিরে যাও ভ্রাতা লক্ষ্মণ। আমাকে আমার ভাগ্যের ওপরে ছেড়ে দাও।”

লক্ষ্মণ রোদন করতে লাগলো এক অবুঝ বালকের ন্যায় । বারবার বলতে লাগলো- “বৌঠান! কিরূপে এই অধর্ম আমার দ্বারা হচ্ছে আমি ভেবে পাচ্ছি না। কিরূপে এই অরন্যে হিংস্র জন্তুর মাঝে আপনাকে রেখে যাই?” সীতাদেবী বললেন- “লক্ষ্মণ! অগ্রজের আদেশ মান্য করাই কনিষ্ঠ ভ্রাতার প্রধান কর্তব্য। কর্তব্যে অবহেলা কোরো না। যাও তোমার অগ্রজের আদেশ মেনে ফিরে যাও। তোমার বৌঠান হয়ে আমি তোমাকে আদেশ দিচ্ছি, এই অরন্যে আমাকে রেখে তুমি প্রস্থান করো।” লক্ষ্মণ রোদন করতে করতে রথ ঘুরিয়ে নিলো। তারপর রোদন করতে করতে অশ্ব ছুটিয়ে রথ নিয়ে গেলো। অশ্বের খুঁড়ের আওয়াজ, রথের চক্রের আওয়াজ একসময় দূরে মিলিয়ে যেতেই স্থানটি নির্জনতায় ভরে গেলো । সীতাদেবী সেখানে কপালে হাত দিয়ে বসে রোদন করতে লাগলেন । সীতাদেবীর রোদন শুনে সকল পক্ষী কলরব ছেড়ে চুপ হয়ে গেলো। হরিণ গুলি ছুটে এলো। হংস হংসী যুগল জলকেলি ছেড়ে চলে এসে মূর্তির ন্যায় স্তব্ধ হয়ে গেলো। গোটা প্রকৃতি যেনো স্তব্ধ হয়ে গেলো। রাক্ষসী দিগের অভিশাপ ফলিত হল। বাল্মিকী মুনি সব দেখতে পেলেন । ব্রহ্মার কৃপায় তিনি ভব্যিষতের ঘটনা দেখতে পেতেন। দেখলেন যে এই রামায়নে সীতার কপালে এমনই দুঃখ লেখা আছে । তিঁনি আসলেন। বললেন- “পুত্রী সীতা! আমি মহর্ষি বাল্মিকী। শ্রীরামচন্দ্রের জীবনিকার। আমি পূর্বেই জানতাম এমন হবে। ইহাই বিধিলিপি। তুমি গর্ভবতী। এই অরন্য তোমার পক্ষে উপযুক্ত নয়। তুমি আমার আশ্রমে নিবাস করবে।” সীতাদেবী মুনিকে প্রনাম করে বললেন- “মহর্ষি! আপনাকে দর্শন করে ধন্য হলাম। আপনি আমার স্বামীর জীবনির রচনাকার। আপনাকে প্রণাম। কিন্তু মহর্ষি আমি এখানে আমার ভাগ্যের ওপর পড়ে থাকতে চাই। যাহা আমার কপালে লেখা আছে তাহাই ঘটবে।”

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।