সীতাদেবী অতীব মমতা প্রদান করে লব কুশ কে বড় করতে লাগলেন । লব কুশ রাজার কুমার বলে আলাদা সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করেন নি সীতাদেবী। আশ্রমের আর পাঁচটি শিশুর ন্যায় বড় করেছেন। অতি সাধারণ বস্ত্র ও রুদ্রাক্ষ মাল্য দিয়েছেন। বৃদ্ধা কাবেরী দেবী সীতার দুই পুত্রের জন্য কোমল শয্যা রচনা করলে সীতাদেবী তাহা গ্রহণ করেন নি। এই কঠোরতার পেছনে ছিলো লব কুশ যাহাতে আরামে বিলাসে পালিত না হয়- কর্তব্য যেনো ভুলে না যায় । প্রবল রোদ্রে তাহাদের নিয়ে বনে জ্বালানী কাষ্ঠ সংগ্রহ করতে যেতেন। লব কুশ সকল কাষ্ঠ জোগার করে এনে দিতো, সীতাদেবী অনান্য আশ্রম কন্যাদের সহিত মাথায় সেই কাষ্ঠ আশ্রমে নিয়ে আসতেন। অতি প্রত্যুষে ব্রাহ্ম মুহূর্তে লব কুশকে জাগিয়ে তুলে উষ্ণ সলিলে নয় বরং তমসা নদীর শীতল জলে স্নান করিয়ে আনতেন। মুনির আশ্রমে যোগা অনুশীলন করতেন লব কুশ । প্রবল তাপের মধ্যেও বিদ্যা শিক্ষা চলতো। একটা প্রবাদ আছে যে অতি বিলাসে পড়াশোনা হয় না। এ কথাটা সর্ব ভাবে সত্য । বিদ্যা শিক্ষা গ্রহণ করতে হলে অতি আরামে হয় না। বই মুখস্থ করে বড়জোর পাশ করা যায়- আসলে কিন্তু মনের অন্ধকার দূর হয়ে যায় না । ভারতে প্রাচীন কালে গুরুগৃহে এইভাবে ছাত্রদের ব্রহ্মচর্য অবলম্বন পূর্বক বিদ্যা শিক্ষা অর্জন করে হত অত্যন্ত কঠোরতার সাথে। তাই তো ভারতবর্ষে ভগবান শ্রীরাম, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, ভীস্ম, পাণ্ডব এঁনারা উঠে এসেছেন । সকলেই একই কঠোরতার সহিত গুরুকুলে বিদ্যা গ্রহণ করেছেন। আজকে তেমন আর পরিবেশ নেই- সেজন্য আজ প্রকৃত শিক্ষিতর বড়ই অভাব- সব বই মুখস্থ বিদ্যা । সীতা দেবীর পুত্রপ্রেমের সহিত এই রূপ কঠোর জীবন প্রনালী সকলকেই আশ্চর্য করতো। বৃদ্ধা কাবেরীদেবী মাঝে মাঝে মানা করতেন। কিন্তু সীতাদেবী স্নেহ বাৎসল্যের সাথে সাথে কঠোর নিয়ম কানুন বজায় রাখেন ।
পুত্রেরা বড় হল। বাল্মিকী মুনি তাহাদিগকে শিষ্য বানালেন । লব আর কুশ যেনো ভাইগতপ্রাণ। ভাতৃপ্রেমের জলন্ত নিদর্শন । একে অন্যকে ছাড়া থাকতে পারেন না। একে অপরকে খুবুই স্নেহ করেন। একে না খেয়ে যেনো অন্যের মুখে আহার তুলে দেয় এমন । বাল্মিকী মুনি অস্ত্র শিক্ষা দিলেন। একে একে ধনুর্বিদ্যা সহ তরবারি- ছোড়াখেলা – লাঠিখেলা- বর্শা নিক্ষেপ- গদা যুদ্ধ- মুষ্টিযুদ্ধ- মল্লযুদ্ধ আদি সব শেখালেন । রাজনীতি- কূটনীতি শেখালেন। বেদ, উপনিষদ, শাস্ত্র সমূহ শেখালেন । দুজনেই ধীরে ধীরে সকল আয়ত্ত করলেন । দুজনের ধনুক থেকে যখন শর ছোটে মনে হয় যেনো উল্কার ন্যায় বাণ ছুটে গেলো। মহর্ষি বাল্মিকী দুই বালককে দিব্যাস্ত্র সকল প্রদাণ করলেন । যখন তাহারা বাণ দ্বারা খেলা করতো, বাণে বাণে আকাশ ঢেকে অন্ধকার হয়ে যেতো। দুজনের বীরত্ব দেখে আশ্রমের সকলে ধন্য ধন্য করতো। সীতাদেবী অন্তরে খুশী হতেন । একদা মহর্ষি বাল্মিকী তাহাদের বললেন- ‘এসো বতস্য! আমি তোমাদিগকে সঙ্গীত শিক্ষা প্রদান করবো। ভগবান শ্রীরামের জীবন চরিত হচ্ছে ‘রামায়ন’। প্রজাপতি ব্রহ্মার ইচ্ছায় সেই ‘রামায়ন’ রচনা করছি। তাহার সঙ্গীত শিক্ষা অর্থাৎ রামায়ন গান আমি তোমাদিগকে প্রদান করবো। শ্রীরাম মনুষ্যদেহে সাক্ষাৎ পরমব্রহ্ম । তিঁনিই ভগবান বিষ্ণু । তাঁর জীবন কথাই ‘রামায়ন’। যাহা শ্রবণে মানবের সর্ব প্রকার মঙ্গল হয়। রোগ- শোক- মহামারী- দুর্যোগ- বিপদ- আপদ- ভয় দূর হয় । পুন্যাত্মাদের রক্ষা ও অসাধুদের বিনাশের জন্যই ভগবান নরদেহে রাম রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি মর্যাদা পুরুষোত্তম । আর তাঁহার স্ত্রী সীতাদেবী হলেন সাক্ষাৎ ভগবতী লক্ষ্মী দেবী। তিনি সতী সাধ্বী। এই যুগল রূপের দর্শন, পূজা মাত্রই মানবের কল্যাণ হয়। ‘রাম’ নামের অপার মহিমা বলে সমাপ্ত হয় না। মহর্ষি বশিষ্ঠের পুত্র বামদেব এই রাম নামের সংশয়ের জন্য অভিশপ্ত হয়েছিলেন। একবার ‘রাম’ নামে কোটি ব্রহ্মহত্যা পাপ নাশ হয়।”
এই বলে মহর্ষি বাল্মিকী লব আর কুশকে দুটি বীনা দিলেন । সুর তাল শেখালেন । এরপর রামায়ন গাণ শোনালেন । সাথে সাথে লব কুশ শিখতে লাগলেন । দুভ্রাতার কণ্ঠে যেনো দেবী সরস্বতী আবির্ভূতা হলেন। সুরেলা মিষ্টি কণ্ঠস্বর তাহাদের । সুর তাল লয় কোন কিছুতেই ভুল হয় না । তালে তালে বীনা বাদন করে গান করেন। রামায়ণ সঙ্গীত শুনে আশ্রমের সকলে একেবারে বনের পশু পক্ষী অবধি চুপ হয়ে যায় । সীতাদেবী সেসব শোনেন- খুশীতে তাঁহার অশ্রু বাঁধ মানে না। দুই শিশু ইহাও জানে না যে শ্রীরাম তাহাদের পিতা আর তাদের মা হলেন সাক্ষাৎ জনকনন্দিনী সীতাদেবী । কিভাবেই বা জানবে। তাহারা জানে তাহার মাতা এক জনমদুখিনী , এই আশ্রমেই ঠাঁই পেয়েছেন । কৌশল্যা দেবী আক্ষেপ করেন, শুধু তিনি নয়, মাতা কৈকয়ী, মাতা সুমিত্রা দেবীও আক্ষেপ করে বলেন- “হায় যদি আজ সীতা থাকতো এখানে তবে শ্রীরামের সন্তান কে ক্রোড়ে লইয়া কত আদর বাৎসল্য প্রদান করতাম। না জানি তাহারা আদৌ বেঁচে আছে কি ?” শ্রীরাম সব শুনে চুপ থাকেন। দুঃখে অন্তর ফেটে চৌচির হলেও রাজধর্মের দায়িত্ব স্বরূপ পাথর বুকে চেপে আবেগ, পিতৃ ধর্ম, স্বামী ধর্ম কে রুদ্ধ করে রাখেন । গোপোনে অশ্রুপাত করেন আর সীতার কথা ভাবেন । অপরদিকে লব কুশের বীরত্ব দেখে অবাক সকলে। বনে গিয়ে সিংহ, ব্যাঘ্রের পৃষ্ঠে আরোহিত হয়ে খেলা করে। কোন ভয় নাই। একদিনের কথা। মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র রাজসভায় বসে আছেন । এক ব্রাহ্মণ একটি বালকের শবদেহ নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে এসে বলল- “ হে রাম! আমরা তোমার রাজ্যে থাকি । রাজার অত্যাচারেই প্রজাদের অকালমৃত্যু হয় অথবা প্রজারা অধর্ম করছে, রাজা তাহা দেখেও না, ইহা থেকে অধর্ম হয় আর তা থেকে হয় অকালে শিশুর মৃত্যু । তোমার রাজ্যে ঠিক অনাচার হয়েছে, তাই আমার পুত্রের অকালমৃত্যু হয়েছে। এই ব্রহ্মহত্যার দায়ী তুমি। তোমার কারণেই আমার পুত্র অকালে যমের ভবন চলে গেছে। এর বিচার চাই।”
( ক্রমশঃ )
পুত্রেরা বড় হল। বাল্মিকী মুনি তাহাদিগকে শিষ্য বানালেন । লব আর কুশ যেনো ভাইগতপ্রাণ। ভাতৃপ্রেমের জলন্ত নিদর্শন । একে অন্যকে ছাড়া থাকতে পারেন না। একে অপরকে খুবুই স্নেহ করেন। একে না খেয়ে যেনো অন্যের মুখে আহার তুলে দেয় এমন । বাল্মিকী মুনি অস্ত্র শিক্ষা দিলেন। একে একে ধনুর্বিদ্যা সহ তরবারি- ছোড়াখেলা – লাঠিখেলা- বর্শা নিক্ষেপ- গদা যুদ্ধ- মুষ্টিযুদ্ধ- মল্লযুদ্ধ আদি সব শেখালেন । রাজনীতি- কূটনীতি শেখালেন। বেদ, উপনিষদ, শাস্ত্র সমূহ শেখালেন । দুজনেই ধীরে ধীরে সকল আয়ত্ত করলেন । দুজনের ধনুক থেকে যখন শর ছোটে মনে হয় যেনো উল্কার ন্যায় বাণ ছুটে গেলো। মহর্ষি বাল্মিকী দুই বালককে দিব্যাস্ত্র সকল প্রদাণ করলেন । যখন তাহারা বাণ দ্বারা খেলা করতো, বাণে বাণে আকাশ ঢেকে অন্ধকার হয়ে যেতো। দুজনের বীরত্ব দেখে আশ্রমের সকলে ধন্য ধন্য করতো। সীতাদেবী অন্তরে খুশী হতেন । একদা মহর্ষি বাল্মিকী তাহাদের বললেন- ‘এসো বতস্য! আমি তোমাদিগকে সঙ্গীত শিক্ষা প্রদান করবো। ভগবান শ্রীরামের জীবন চরিত হচ্ছে ‘রামায়ন’। প্রজাপতি ব্রহ্মার ইচ্ছায় সেই ‘রামায়ন’ রচনা করছি। তাহার সঙ্গীত শিক্ষা অর্থাৎ রামায়ন গান আমি তোমাদিগকে প্রদান করবো। শ্রীরাম মনুষ্যদেহে সাক্ষাৎ পরমব্রহ্ম । তিঁনিই ভগবান বিষ্ণু । তাঁর জীবন কথাই ‘রামায়ন’। যাহা শ্রবণে মানবের সর্ব প্রকার মঙ্গল হয়। রোগ- শোক- মহামারী- দুর্যোগ- বিপদ- আপদ- ভয় দূর হয় । পুন্যাত্মাদের রক্ষা ও অসাধুদের বিনাশের জন্যই ভগবান নরদেহে রাম রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি মর্যাদা পুরুষোত্তম । আর তাঁহার স্ত্রী সীতাদেবী হলেন সাক্ষাৎ ভগবতী লক্ষ্মী দেবী। তিনি সতী সাধ্বী। এই যুগল রূপের দর্শন, পূজা মাত্রই মানবের কল্যাণ হয়। ‘রাম’ নামের অপার মহিমা বলে সমাপ্ত হয় না। মহর্ষি বশিষ্ঠের পুত্র বামদেব এই রাম নামের সংশয়ের জন্য অভিশপ্ত হয়েছিলেন। একবার ‘রাম’ নামে কোটি ব্রহ্মহত্যা পাপ নাশ হয়।”
এই বলে মহর্ষি বাল্মিকী লব আর কুশকে দুটি বীনা দিলেন । সুর তাল শেখালেন । এরপর রামায়ন গাণ শোনালেন । সাথে সাথে লব কুশ শিখতে লাগলেন । দুভ্রাতার কণ্ঠে যেনো দেবী সরস্বতী আবির্ভূতা হলেন। সুরেলা মিষ্টি কণ্ঠস্বর তাহাদের । সুর তাল লয় কোন কিছুতেই ভুল হয় না । তালে তালে বীনা বাদন করে গান করেন। রামায়ণ সঙ্গীত শুনে আশ্রমের সকলে একেবারে বনের পশু পক্ষী অবধি চুপ হয়ে যায় । সীতাদেবী সেসব শোনেন- খুশীতে তাঁহার অশ্রু বাঁধ মানে না। দুই শিশু ইহাও জানে না যে শ্রীরাম তাহাদের পিতা আর তাদের মা হলেন সাক্ষাৎ জনকনন্দিনী সীতাদেবী । কিভাবেই বা জানবে। তাহারা জানে তাহার মাতা এক জনমদুখিনী , এই আশ্রমেই ঠাঁই পেয়েছেন । কৌশল্যা দেবী আক্ষেপ করেন, শুধু তিনি নয়, মাতা কৈকয়ী, মাতা সুমিত্রা দেবীও আক্ষেপ করে বলেন- “হায় যদি আজ সীতা থাকতো এখানে তবে শ্রীরামের সন্তান কে ক্রোড়ে লইয়া কত আদর বাৎসল্য প্রদান করতাম। না জানি তাহারা আদৌ বেঁচে আছে কি ?” শ্রীরাম সব শুনে চুপ থাকেন। দুঃখে অন্তর ফেটে চৌচির হলেও রাজধর্মের দায়িত্ব স্বরূপ পাথর বুকে চেপে আবেগ, পিতৃ ধর্ম, স্বামী ধর্ম কে রুদ্ধ করে রাখেন । গোপোনে অশ্রুপাত করেন আর সীতার কথা ভাবেন । অপরদিকে লব কুশের বীরত্ব দেখে অবাক সকলে। বনে গিয়ে সিংহ, ব্যাঘ্রের পৃষ্ঠে আরোহিত হয়ে খেলা করে। কোন ভয় নাই। একদিনের কথা। মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র রাজসভায় বসে আছেন । এক ব্রাহ্মণ একটি বালকের শবদেহ নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে এসে বলল- “ হে রাম! আমরা তোমার রাজ্যে থাকি । রাজার অত্যাচারেই প্রজাদের অকালমৃত্যু হয় অথবা প্রজারা অধর্ম করছে, রাজা তাহা দেখেও না, ইহা থেকে অধর্ম হয় আর তা থেকে হয় অকালে শিশুর মৃত্যু । তোমার রাজ্যে ঠিক অনাচার হয়েছে, তাই আমার পুত্রের অকালমৃত্যু হয়েছে। এই ব্রহ্মহত্যার দায়ী তুমি। তোমার কারণেই আমার পুত্র অকালে যমের ভবন চলে গেছে। এর বিচার চাই।”
( ক্রমশঃ )
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন