১২ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-৬০)

এরপর প্রভাত হতেই পুনঃ সকলে বিদায় নিলেন। ভরদ্বাজ মুনি খুবুই প্রসন্ন ছিলেন। কারণ যোগীরা ভগবান বিষ্ণুর দর্শনের নিমিত্ত কত যোগ সাধনা অবলম্বন করেন। সেই বিষ্ণু আজ আশ্রমে এসেছেন । মুনির চোখ বেয়ে জলের ধারা নামলো। হাসি মুখে মুনি সকলকে বিদায় দিলেন। সকলে গিয়ে পুস্পক বিমানে উঠে বসলেন। পুস্পক বিমান আবার ধরিত্রী ছেড়ে আকাশে উঠলো । পুস্পক বিমান হাওয়ায় ভেসে চলল । আবার দেখা গেলো আশেপাশে সাদা মেঘের সাড়ি, বকের উড়ন্ত দল। সকলে যেনো আনন্দে বাতাসে ভেসে চলছে। প্রকৃতি নব শোভায় সেজেছে । এরপর এলো শৃঙ্গবেরপুর । এখানে নিষাদেরা রাজত্ব করে। নিষাদ দের রাজা গুহক চণ্ডাল আবার ভগবান শ্রীরামের প্রিয় বন্ধু । ভগবান শ্রীরাম নিষাদ দের দেখে বিভীষণকে বললেন- “মিত্র! এই স্থানে রথ ধরিত্রীতে নিয়ে চলো। এই স্থানে আমার প্রিয় সখা গুহক বাস। করেন। এই রাজ্যের নাম শৃঙ্গবেরপুর। আমার পরম মিত্র এই রাজ্যের রাজা। একবার তাহার সহিত দেখা করবো।” মিত্র বিভীষণের আদেশে পুস্পক বিমান ধরিত্রীতে নেমে এলো । বানর সেনা সহিত প্রভু শ্রীরাম, সীতাদেবী, লক্ষ্মণকে দেখে নিষাদেরা ছুটে গিয়ে গুহক কে সংবাদ দিলো ।

শ্রীরাম আইসে দেশে প’ড়ে গেল সাড়া ।
ঝা গুড় গুড় বাদ্য বাজে নাচে চণ্ডাল- পাড়া ।।
উভ করি ঝুঁটি বান্ধে টানি পরে ধড়া ।
নানা অস্ত্রে সাজে জাঠি শেল ও ঝকড়া ।।
চতুর্দিকে হাত তুলি বাজায় চামুচি ।
উফর ধাফর করি চণ্ডাল ফৌজ নাচি ।।
নাচয়ে চণ্ডাল সব আনন্দিত হয়ে ।
দেখিয়া আনন্দে নাচে চণ্ডালের মেয়ে ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

স্বয়ং শ্রীরামচন্দ্র আসছেন। এই শুনে নিষাদ দের রাজ্যে আনন্দ বয়ে গেলো । সাজো সাজো রব পড়লো । সকলে খুশীতে নানা বাদ্য বাজনা বাজাতে লাগলো। খুশীতে কেউ কেউ নৃত্য করতে লাগলো । শ্রীরামকে স্বাগত জানানোর জন্য মঙ্গল কলস, কদলী বৃক্ষ, নানা রঙের নেতের পতাকা দিয়ে নিষাদ পল্লী সাজানো হল। নিষাদেরা আনন্দে স্বাগত জানালো। মিত্র গুহক গিয়ে স্বাগত জানালেন। ভগবান শ্রীরাম তখন মিত্র গুহকে কে আলিঙ্গন করলেন । দুজনের চোখের জলে গাল ভেসে গেলো। এই বন্ধুত্ব দেখে উপস্থিত সকলের চোখ দিয়ে জল ঝড়তে লাগলো ।

শ্রীরাম বলেন মিত্র আছহ কুশলে ।
গুহ বলে রাম তুই এলি ভালে ভালে ।।
শুনিয়া গুহের কথা রামের সন্তোষ ।
ভক্তিমাত্র লন রাম নাহি লন দোষ ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

গুহক বললেন- “তোমার ন্যায় মিত্র পেয়ে আমি ধন্য। আমি শুনেছি দশানন রাক্ষসরাজ রাবণের সাথে তোমার যুদ্ধের কথা। একবার আমাকে বলতে মিত্র। তোমার কষ্ট করতে হতো না- আমার আশ্রিত নিষাদ চণ্ডালেরা রাবণকে বধ করে দেবী সীতাকে উদ্ধার করে এনে তোমাকে দিতো। এখন এখানে কিছুকাল বিশ্রাম করো সখা । ” শ্রীরাম বললেন- “মিত্র! তোমার ন্যায় এমন সখা ভাগ্য করে মেলে। রাবণ বধ হয়েছে । আর এখানে আমি এখন অবস্থান করতে পারবো না। কারণ রাজ্যে ভরত অবস্থান করছে। তুমি তো জানো আমার ভ্রাতা ভরত আমাকে কত না স্নেহ করেন। হয়তো দেরী হলে সে কিছু অনর্থ করে ফেলে।” গুহক তো নাছোরবান্দা। শেষে সামান্য ফলমূল গ্রহণের জন্য রাজী করিয়ে ছাড়লেন । তখন শ্রীরাম বললেন- “বেশ! তাহলে আমি কিঞ্চিৎ জলপান করবো মিত্রর কুটিরে। তবে হনুমানকে প্রেরণ করে ভরত করে সংবাদ প্রদান করতে হয়।” এরপর ভগবান শ্রীরাম , হনুমানকে বললেন- “মারুতি! তুমি বায়ুর বেগে গমন করতে সক্ষম । তুমি গিয়ে ভরতকে আমার আগমনের সংবাদ দাও। তাহাকে অপেক্ষা করতে বল। আমি এখানে কিঞ্চিৎ অবস্থান করেই প্রস্থান করবো।” শোনা মাত্রই হনুমান লম্ফ দিয়ে গগনে উঠে অযোধ্যা চলল। মিত্র গুহকের কুটীরে শ্রীরাম সহ সকলে ফলমূল গ্রহণ করলেন । নানা কথা বললেন। তারপর শ্রীরাম বললেন- “হে মিত্র গুহক! তুমি বহুদিন যাবত অযোধ্যা আসো নি। এবার আমার সহিত অযোধ্যায় চলো।” গুহক বললেন- “এতো পরম সৌভাগ্য। অবশ্যই তোমার সহিত যাবো।” এই বলে সকলে প্রস্থান করতে নিলেন। সীতাদেবী বললেন- “স্বামী! এইস্থানের কথা স্মরণ আছে। এখান থেকেই আপনি অযোধ্যার নরনারীকে রাজ্যে ফিরতে আদেশ দিয়েছিলেন?” শ্রীরামের সকল কথা মনে পড়লো। সেখানে গিয়ে দেখলেন কিছু লোক সেখানে তখনও অবস্থান করছেন। তাঁদের হাতের নখ, পায়ের নখ বিশাল- কেশ রাশি যেনো ভূমি স্পর্শ করছে। ভগবান শ্রীরাম বললেন- “তোমরা কারা? কেন এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছো?” তারা বললেন- “হে প্রভু শ্রীরাম! আপনার স্মরণ আছে বনবাসে যাবার আগে আপনি এখানে বলেছিলেন যে- হে অযোধ্যার নরনারী তোমরা সকলে রাজ্যে ফিরে যাও। হে দয়ানিধান- আমরা নারীও নই আবার পুরুষও নই । তাই আমরা ফিরে যেতে পারিনি। আপনার আদেশ কিভাবে অমান্য করবো? ” (অযোধ্যাকাণ্ড পর্ব –৭ পড়ুন । ) শুনে ভগবান শ্রীরাম বললেন- “আপনারা সেজন্য এখানে চতুর্দশ বৎসর অবস্থান করে এতো কঠিন জীবন যাপন করলেন? আপনাদের আমি আশীর্বাদ করছি আজ থেকে আপনারা কিন্নর নামে খ্যাত হবেন ধরিত্রীতে । আপনাদের মুখের বাক্য অক্ষরে অক্ষরে ফলিত হবে। যাহাকে যাহা বলবেন তাই হবে। আপনাদের মুখ থেকে নিঃসৃত আশীর্বাদ আর অভিশাপ সমান ভাবে ফলবে। শুভ কাজে আপনাদের অবস্থান মঙ্গলকারী হবে। ”

সেই থেকে এনারা আজ কিন্নর নামে খ্যাত। মুখের ভাষায় আমারা এদের ‘হিজড়া’ বলে ডাকি । এই জন্য হিজরারা কিছু চাইলে যথাসম্ভব দান করা উচিৎ । এই আশীর্বাদ স্বয়ং শ্রীরামচন্দ্র করে গেছেন। তাই নবোজাত শিশুকে আশীর্বাদ দিতে এনারা আসেন । শ্রীরাম সহ সকলে আবার পুস্পক বিমানে উঠলেন । পুস্পক বিমান আবার উড়ে চলল। ধীরে ধীরে অযোধ্যা রাজ্যে প্রবেশ করলো। ভগবান শ্রীরাম সহ সকলে আবার পুস্পক বিমান থেকে নেমে অযোধ্যার ভূমিকে প্রণাম জানালেন । আবার চললেন। হনুমানকে আসতে দেখে ভরত বলল- “পবন পুত্র! আমার অগ্রজ, বৌঠান আর ভ্রাতা কোথায় ?” হনুমান বলল- “ভরত দাদা! ওঁনারা অবিলম্বে আসছেন পুস্পক বিমানে। এখন ওঁনারা নিষাদ রাজ্যে আছেন।” সেখানে কৌশল্যা, কৈকয়ী, সুমিত্রা তিন রানী ছিলেন। ভরত তার গর্ভধারিণী কে খুব বকাঝকা করে বললেন- “তুমি এখানে কি মনে করে ? আজ শুভ দিন। আমার অগ্রজ, বৌঠান আর ভ্রাতা ফিরে আসছেন। আমি চাইনা তোমার অশুভ ছায়া এই শুভানুষ্ঠানে পড়ুক। তোমার মুখ দর্শন করলে নিজে অপরাধের গ্লানিতে ভুগতে থাকি। তোমার কারণেই আমার অগ্রজ, বৌঠান আর ভ্রাতা চতুর্দশ বৎসর অরণ্যে থেকে না জানি কত কষ্ট- দুর্ভোগ পেয়েছেন। আরে ওঁনাদের পদ্মের ন্যায় চরণ কণ্টকে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে । আর আমার বৌঠানের ওপর দিয়ে না জানি কত ঝড় বয়ে গেছে। রাবণের রাজ্যে বন্দিনী ছিলেন রাজা জনকের পুত্রী তথা অযোধ্যার কুলবধূ । আমার জীবিত থাকাই বৃথা। আমার জন্যই ওঁনারা এত ক্লেশ পেলেন । দয়া করে এখান থেকে প্রস্থান করুন রানী কৈকয়ী ।” কৈকয়ী বলল- “তুমি সত্য বলেছ পুত্র! আমি মহাপাপী। মাতা নামে কলঙ্ক। আমি ডাইনী রাক্ষসী। আমার ছায়া পড়লেও অপরাধ হয়। আমি চলে যাচ্ছি।” এই বলে ক্রন্দন করতে করতে কৈকয়ী বিদায় নিলেন। হনুমান বললেন- “ভরত দাদা! উনি আমার প্রভুর মাতা। আপনি জানেন কি বনবাস কালে প্রভু বারবার উনি এনার কথাই বলতেন । নিজেকে সর্বদা কৈকয়ীর পুত্র রূপেই পরিচয় দিতেন। ওনাকে বিতারিত করলে প্রভু কষ্ট পাবেন।” ভরত ক্ষেপে গিয়ে বলল- “তুমি চুপ করো হনুমান। তুমি জাতিতে পশু। মানবিক সম্পর্ক আর কিই বা বোঝো?”

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।