২৫ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব –৩৭ )



দেখতে দেখতে লব ও কুশ মিলে অয্যোধ্যার সেনা সংখ্যা কমিয়ে দিলো। তাহারা এত দিব্যাস্ত্র চালনা করলো যে আকাশে মেঘ জমে গেলো। সূর্য ঢাকা পড়লো। এক একটি অস্ত্র নিক্ষেপের সময় ধরণী কম্পমান হল। লক্ষ্মণ ঠাকুর দেখলেন এই বালকেরা বহু বীর । উহাদের সহিত এত সহজে পারবে না । এই ভেবে লক্ষ্মণ মন্ত্রপূত লক্ষশিরা বাণ ছুড়লেন। সকল বাণ সকল উল্কার ন্যায় লব কুশের দিকে ছুটে আসতে লাগলো। লব ও কুশ বজ্রবাণ নিক্ষেপ করলেন। লব ও কুশের বাণে লক্ষ্মণের সেই লক্ষশিরা বাণ ভস্ম হল। ইহা দেখে দুভ্রাতা হাস্য করলেন। লক্ষ্মণ ক্রুদ্ধ হয়ে যত রকম দিব্যাস্ত্র চালনা করলেন- সকল অস্ত্রই লব ও কুশ মিলে ধ্বংস করলো। লব বলল- “এখনও কি মনে হয় আমরা দুর্বল ? আমাদের হস্তে আপনার অনেক সেনার নাশ হয়েছে। আপনি দুর্বল হচ্ছেন। দয়া করে প্রস্থান করুন। আর মহারাজ শ্রীরামচন্দ্রকে যুদ্ধে আসতে অনুরোধ জানান। আমরা তাহাকে যুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছি।” লক্ষ্মণ বললেন- “ওরে বালক! তোরা লক্ষ্মণের পরাক্রম কি জানিস। তোদের ন্যায় উদ্ধত বালককে আজ অবশ্যই দণ্ডিত করবো। এবার আমি সেই অস্ত্র নিক্ষেপ করবো- যাহা দ্বারা মেঘনাদকে বধ করেছিলাম। দেখি তোরা কেমনে রক্ষা পাস!” এই বলে লক্ষ্মণ ধনুকে ইন্দ্রাস্ত্রের আহ্বান করলো। ইন্দ্রাস্ত্র প্রকট হতেই চতুর্দিকে যেনো প্রলয় আরম্ভ হল। অস্ত্রের ফলা দিয়ে ভীষণ গর্জন করে বজ্রপাত হতে লাগলো। ভীষণ আলো উৎপন্ন হল ইন্দ্রাস্ত্র দিয়ে । এই দেখে লব ধনুকে ইন্দ্রাগ্নি অস্ত্র জুড়লো। সেই অস্ত্র দিয়ে দিব্য জ্যোতি সকল উৎপন্ন হয়ে ভীষণ দাহক অগ্নিশিখা উৎপন্ন হল । লক্ষ্মণ ইন্দ্রাস্ত্র ছুঁড়লে, লব ইন্দ্রাগ্নি অস্ত্র ছুড়লো। দুই অস্ত্রের মুখোমুখি ধাক্কা তে যেনো ত্রিলোক কেঁপে উঠলো। লক্ষ্মণের অস্ত্র ধ্বংস হল। লব তখন কুশকে বললেন- “ভ্রাতা ! এঁনাকে বধ না করে মূর্ছিত করুন।”

কুশ তখন এমন গতিতে বাণ নিক্ষেপ করলো যে লক্ষ্মণের সাথে আগত বাকী হস্তী, অশ্ব, রথ টুকরো টুকরো করে ফেললো। লক্ষ্মণের সুরক্ষায় থাকা সেনারা ছিন্নবিছিন্ন হয়ে গেলো। রক্তের নদী প্রবাহিত হল। কুশের বাণে বাকী সেনারা রণে ভঙ্গ দিলো। জঙ্গল রক্ত, মাংস, কাটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গে ভরে গেলো। দেখতে দেখতে কুশের বাণে লক্ষ্মণের রথ ছিন্ন হল। সেই উল্কাবাণ লক্ষ্মণের বুকে আছড়ে পড়লো। যেনো মনে হল জলন্ত শেল এসে লক্ষ্মণের বুকে আছড়ে পড়েছে । লক্ষ্মণ মূর্ছিত হল। তাহাকে শিবিরে নিয়ে যাওয়া হল। দূত গিয়ে অযোধ্যায় সব জানালো। শ্রীরাম মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। এ কেমন বালক। যে মেঘনাদ নাশক কে মূর্ছিত করে দিলো। এরা কারা। এরা সাধারণ মানব বালক নয়। নিশ্চয়ই অপর কেও। তাহাদের সাথে যুদ্ধে বড় বড় সেনাপতি, মন্ত্রী, সেনারা যমালয়ে গেছে। সুগ্রীব, বিভীষণ, অঙ্গদ, নল, নীল, গবাক্ষ, জাম্বুবান , হনুমান সকলে অবাক হল। সকলে আশ্চর্য হল। এক বালকের হস্তে তিন মহাবীরের পরাজয় দেখে। বিশেষ করে লক্ষ্মণের পরাজয় বিশ্বাস হয় না। সকলে বলল- “এবার সেই বালক দ্বয়কে বন্দী করে যজ্ঞের অশ্ব আনা হোক।” ভগবান শ্রীরাম বললেন- “এই যজ্ঞে অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্বের সুরক্ষার ভার আমার ওপর। আমি নিজেই যাবো । দেখি তাহারা কেমন বীর। কেনই বা আমার সাথে যুদ্ধের অভিলাষ রাখে। যদি মহর্ষি বাল্মিকী উপস্থিত থাকতেন, তবে বিনা রক্তপাতে সমস্যার সমাধান করা যেতো। বোধ হয় এখন সেই অবকাশ নেই।” হনুমান বলল- “প্রভু! আদেশ দিন। সেই দুই উদ্ধত বালক কে এখুনি লাঙ্গুলে বন্দী করে আনি।” বিভীষণ বলল- “আমাকে আদেশ দিন মিত্র। আমি এখুনি রাক্ষস দের নিয়ে সেথায় যাবো। রাক্ষসদের বিকট চেহারা দেখে ভয় পেয়ে সেই বালক অস্ত্র ফেলে পলায়ন করবে।” ভগবান শ্রীরাম বললেন- “অবশ্যই তোমরা যাবে। তবে একাকী নয়। এবার আমিই সেস্থানে যাবো। তোমরা আমার সাথে যাবে।” এতেক শোনা মাত্রই অযোধ্যায় যুদ্ধসাজ আরম্ভ হল। হাজার রণ দামামা, শিঙা, তুরী- ভেরী, ঢাক- ঢোল, শঙ্খ, ন্যাকড়া , করতাল বাজতে লাগলো। ভগবান শ্রীরাম সেনা সমেত বের হলেন।

শ্রীরামের সেনা ঠাট কটক অপার ।
দেখিলে যমের চিত্তে লাগে চমৎকার ।।
সুগ্রীব অঙ্গদ চলে লয়ে কপিগণ ।
গবাক্ষ, শরভ গয় সে গন্ধমাদন ।।
মহেন্দ্র দেবেন্দ্র চলে বানর সম্পাতি ।
চলিল ছত্রিশ কোটি মুখ্য- সেনাপতি ।।
সত্তর কোটি বীরে চলে পবন নন্দন ।
তিন কোটি রাক্ষসে চলিল বিভীষণ ।।
মহাশব্দ করি যায় রাক্ষস কপিগণ ।
আর যত সেনা যায় কে করে গণন ।।
বিজয় সুমন্ত্র নড়ে কশ্যপ পিঙ্গল ।
শত্রাজিত মহাবল চলিল সকল ।।
রুদ্রমুখ চলে আর সুরক্ত – লোচন ।
রক্তবর্ণ মহাকায় ঘোর দরশন ।।
রথের উপরে রাম চড়েন সত্বর ।
মহাশব্দ করি যায় রাক্ষস বানর ।।
কটকের পদভরে কাঁপিছে মেদিনী ।
শ্রীরামের বাদ্য বাজে তিন অক্ষৌহিণী ।।
কৃত্তিবাস কবি কহে অমৃত- কাহিনী ।
দুই বালকের জন্য এতেক সাজনি ।।
(কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

অয্যোধ্যার লোকেরা হা করে দেখতে লাগলো। এত সেনা বের হল যে ধূলাময় হল চারপাশ । সাড়ি সাড়ি কেবল সেনা দেখা যায় যতদূর চোখ যায় । স্বর্ণ রথ গুলি চলল। হস্তীগুলি গর্জন করে শুণ্ড তুলে মেদিনী কাঁপিয়ে বের হল। যে রাক্ষস আর বানরেরা পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়েছিল , আজ তাহারা বন্ধুর ন্যায় হাতে হাত মিলিয়ে যুদ্ধ করতে বের হল । অস্ত্রাদি নিয়ে সকলে চলল। হনুমান গদা নিয়ে চলল। এত সেনা নিয়ে জঙ্গল কাঁপিয়ে চলল। অপরদিকে লব ও কুশ গল্প করছিলো। মায়ের কাছে গেলো। মা সীতাদেবী বললেন- “বাছা! গুরুদেব তোমাদের ওপরে আশ্রমের সুরক্ষা দিয়ে গেছেন। তোমরা কোন ভাবে কর্তব্যে অবহেলা করবে না। আর এত যুদ্ধের ধ্বনি কেন শুনি?” লব ও কুশ কিছুই বলল না। ভাবল শ্রীরামকে পরাজিত করে সকল কথা বলবে। খালি বলিল- “মা! এক দুষ্ট রাজা আমাদের সহিত যুদ্ধ করতে আসছেন।” সীতাদেবী বললেন- “নির্ভয় হয়ে যুদ্ধ করবে । আমার আশীর্বাদ তোমাদের সুরক্ষিত করবে। তোমাদের কেহ পরাজিত করতে পারবে না।” লব ও কুশ সীতাদেবীকে প্রণাম করে বিদায় নিলেন, সেই যুদ্ধের স্থানে গেলেন। দেখলেন আবার জঙ্গল কাঁপিয়ে ধূলা উড়িয়ে মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র আসলেন । পিতা ও পুত্রের মধ্যে যুদ্ধ দেখবার জন্য গগনে দেবতারা আসলেন। লব ও কুশ অনান্য আশ্রম বালক দের বলল- “তোমরা রাম নাম নিয়ে হনুমানকে মত্ত করে আশ্রমে নিয়ে গিয়ে রজ্জু দ্বারা আবদ্ধ করবে। কারণ রামনাম শ্রবণ করা মাত্রই হনুমান সব কিছু ভুলে যান।”

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।