২৫ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব –৩৩ )


যজ্ঞের অশ্ব নানাদিক ঘুরে বেড়ালো। নানা রাজ্যে বিচরণ করলো। অনেক রাজাই শ্রীরামের প্রস্তাব মেনে যজ্ঞে গেলো। কিন্তু দেখা গেলো ভগবান শ্রীরাম যেনো একেবারে দয়ালু মাটির মানুষ । এত আদর, আপ্যায়ন আর বিনয় স্বভাব দেখে সে সকল রাজারা অবাক হল। সকলকে যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শন করলেন । এমনকি যে সকল রাজা অশ্ব ধরে যুদ্ধে লিপ্ত হল, তাহাদের বন্দী করে অযোধ্যায় প্রেরণ করা হল। ভগবান শ্রীরাম তাহাদের যথাবিহিত আদর, যত্ন, আপ্যায়ন করে যথাযোগ্য সম্মান দিলেন। সে সকল রাজারা শ্রীরামের আনুগত্যে এসে শান্তি লাভ করলো। সেই সময়ে ক্ষত্রিয় রাজারা পরস্পরের মধ্যে এত যুদ্ধ করতো, যে সর্বদা মারমার কাটকাট লেগেই থাকতো। এই সকলকে একত্র করেছিলেন ভগবান শ্রীরাম। যেমন মহাভারতে আমরা দেখি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অশ্বমেধ যজ্ঞ করিয়েছিলেন রাজা যুঠিষ্ঠিরকে দিয়ে । সমগ্র ভারতবর্ষের রাজাদের এক শাসন ব্যবস্থার ছত্রতলে এনে শক্তিশালী ভারত রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন । যাই হোক এবার দেখি কোন কোন রাজা যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন । পূর্বদেশে ঘোড়া অনেক দূর গেলো। নদ নদী পার করে এক পর্বতের উপর উঠলো। সেই পর্বতের নাম বিরূপাক্ষ গিরি । সেখানকার রাজা অশ্ব ধরলেন । অশ্ব নিতে অয্যোধ্যার সেনারা যাহাতে রাজ্যে না ঢুকতে পারে, সেই জন্য রাজ্যের সীমানায় গড় কেটে অগ্নি সংযোগ করে দিলেন । শত্রুঘ্ন তাঁর দুই অক্ষৌহিণী সেনা সমেত সেখানে আসলেন । দেখলেন আগুন জ্বলছে ।

শত্রুঘ্নের কটক যে দুই অক্ষৌহিণী ।
নিভাইল সে সকল গড়ের আগুনি ।।
গড় মধ্যে প্রবেশ করেন শত্রুঘন ।
শত্রুঘ্নের সহিত রাজার বাজে রণ ।।
রাম সম শত্রুঘন বীর- অবতার ।
শত্রুঘ্নের বাণেতে রাজার চিৎকার ।।
মহাবল শত্রুঘ্ন বাণের জানে সন্ধি ।
হাতে গলে সে রাজারে করিলেন বন্দী ।।
বান্ধিয়া পাঠায় তারে বীর শত্রুঘন ।
রাম দরশনে তার বন্ধন মোচন ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

এইভাবে শত্রুঘ্ন জয়ী হলেন । পূর্ব দিক জয় করলেন । উত্তরদিকে অশ্ব ছুটলো। বায়ুবেগে যজ্ঞের অশ্ব ছুটে চলল। পেছন পেছন শত্রুঘ্ন সেনা কটক নিয়ে চলল। অনেক রাজা বশ্যতা স্বীকার করলেন। কেউ ভাবলেন অশ্ব বন্দী করবেন। কিন্তু লবণ অসুর বধ, হনুমানের বিক্রম শুনে আর সাহস পেলো না । এইভাবে অশ্ব হিমালয়ের দিকে গেলো।

ঘোড়া গেল হিমালয়- পর্বতের পার ।
সেই দেশী রাজা যেই বিক্রমে অপার ।।
ঘোড়া দেখি রাজার ধরিতে গেল সাধ ।
শত্রুঘ্ন রাজার সহিত লাগিল বিবাদ ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

সেই রাজার সাথে শত্রুঘ্নের যুদ্ধ আরম্ভ হল । দুজনের দিব্যাস্ত্র ঝঙ্কারে মেদিনী কাঁপতে লাগলো। একে একে রাজার সকল অস্ত্র ধ্বংস করে দিলেন বীর শত্রুঘ্ন । তার পর শত্রুঘ্ন বাণে বাণে রাজাকে আচ্ছাদিত করে দিলেন। শত্রুঘ্নের বাণে সেই রাজার রথ, চক্র, অশ্ব, ধ্বজা, সারথি, অশ্ব সকল ধ্বংস হল। বাণ ফুঁটে রাজা জর্জরিত হল।

না পারে কথা কহিতে অত্যন্ত কাতর ।
তারে বান্ধি পাঠাইল অযোধ্যা নগর ।।
দর্শন দিলেন তারে কমল লোচন ।
তাহাতে হইল তার বন্ধন মোচন ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

সেই রাজাকে শ্রীরামচন্দ্র সম্মান প্রদর্শন করে অত্যন্ত বিনয় প্রদর্শন করলেন। রাজাও ক্ষমা চাইলেন রাজা শ্রীরামের কাছে । এরপর অশ্ব পশ্চিম দিকে ছুটলো। সেখানে বিকৃতাকার ব্যাধেরা থাকতো। তাহারা এত অদ্ভুদ ছিলো যে দেখলেই ভয়ে ভীত হতে হত ।

বিকৃত আকার তারা হাতে চেরা বাঁশ ।
হস্তী ঘোড়া মারি খায় যত রক্ত মাস ।।
পিশাচ ভোজন আর পিশাচ আচার ।
জীব জন্তু মারি করে তাহারা আহার ।।
সকল ব্যাধেতে ঘোড়া ঘেরে চারিভিতে ।
কুপিল শত্রুঘ্ন বীর ধনুর্বাণ হাতে ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

শত্রুঘ্ন এরপর ব্যাধেদের সাথে যুদ্ধে মগ্ন হল। যুদ্ধ প্রচণ্ড হল। ব্যাধদের পরাজিত করে শত্রুঘ্ন অশ্ব মুক্ত করলো। ব্যাধের সর্দার কে বেঁধে অযোধ্যায় প্রেরণ করলো। তিন দিক জয় করে শত্রুঘ্ন অযোধ্যায় চলল। দক্ষিণে অশ্ব গেলো না। কারণ দক্ষিণের কিস্কিন্ধ্যা ও লঙ্কার রাজা মিত্রতা স্থাপন করেছে । অপরদিকে একদিনের কথা । মহর্ষি বাল্মিকী লব ও কুশকে ডেকে বললেন- “বতস্য! আমি কঠিন সাধনার নিমিত্ত চিত্রকূট গমন করবো। তোমরা তপোবন রক্ষা করো। আমার আসতে বিলম্ব হবে। আশ্রমের সকলের সুরক্ষার ভার তোমাদের ওপর।” এই বলে মহর্ষি বাল্মিকী বিদায় নিলেন । যজ্ঞের অশ্ব বাল্মিকী মুনির আশ্রমের খুব নিকটে ছিলো। দুভ্রাতা খেলা করতে লাগলো। অপরদিকে অয্যোধ্যার কাছাকাছি এসে শত্রুঘ্ন , পবন নন্দনকে বলল- “বীর হনুমান! এখন আমরা অয্যোধ্যার সমীপে। আর কেহ অশ্ব ধরার সাহস করবে না। তুমি অযোধ্যায় ফিরে সংবাদ প্রদান করো যে আমরা শীঘ্রই অশ্ব সমেত ফিরে আসবো। এখন আমাদের সেনারা ক্লান্ত। অশ্ব বড়ই ক্লান্ত। এখানে আমাদের সেনারা বিশ্রাম, আহার, স্নানাদি করবে। অশ্ব এখন তৃনাদি ভোজন করিবে।” হনুমান বিদায় নিলো। সেনারা সকলে যুদ্ধে ক্লান্ত। শিবির রচনা করে বিশ্রাম নিলো। অশ্ব এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে মহর্ষি বাল্মিকীর তপোবনে চলে গেলো।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।