২৫ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব- ৪৩)



এই শুনে শ্রীরাম শান্ত হয়ে বিষন্ন হয়ে বসলেন। মনে হল সীতাদেবী তাহার কর্ণে এসে বলছেন- “প্রভু! এ আপনি কি করছেন ? আমার জন্য আপনি এই ধরিত্রী নাশ করতে চলেছিলেন ? আমি আপনাকে ছেড়ে কোথায় গিয়েছি ? আপনার চরণেই ত আমি আছি। আপনার অন্তরেই ত আমি আছি। আপনি আর আমি কি আলাদা? এখন কঠোর হয়ে মনকে শান্ত করে সকলকে সান্ত্বনা দিন। আপনার পুত্রদের দেখুন।” ভূমিতে পড়ে রোদন করতে করতে শ্রীরামচন্দ্রের কিরীট, কন্ঠের স্বর্ণ মালা , অঙ্গের উত্তরীয় সকল কিছুই ধূলাময় হয়েছিলো। শ্রীরামচন্দ্রের মনে হতে লাগলো এই রাজধর্ম কত কঠিন। সকল লোকে রাজা হতে চায় কেবল ভোগ সুখে জীবন যাপনের জন্য। কিন্তু রাজধর্ম যে কত কঠিন, কত জলন্ত অঙ্গার বিছানো- তাহা কেবল একজন আদর্শ রাজাই বুঝতে পারে। সেই সিংহাসনের তলায় শেষে সীতার বলিদান হয়ে গেলো। শ্রীরামচন্দ্র উঠে মাতৃহারা লব ও কুশকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন । ক্রোড়ে তুলে পুত্রদের সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। মাণ্ডবী, ঊর্মিলা, শ্রুতকীর্তি আদি সকলে লব ও কুশকে ক্রোড়ে নিয়ে আদর করতে লাগলেন। মহর্ষি বাল্মিকী বললেন- “হে শ্রীরাম! আমি আমার সাধ্যানুযায়ী সকল প্রকার শাস্ত্র, অস্ত্র- শস্ত্র, বেদাদি জ্ঞান, সঙ্গীত শিক্ষা লব ও কুশকে প্রদান করেছি। এখন আপনি ইহাদিগকে মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমে প্রেরণ করে বাকী সকল শিক্ষা প্রদান করিবেন। রামায়ণে দেবী সীতার অন্তিম যাত্রা এভাবেই উপস্থাপিত হতো- ইহা আমি জানিতাম। কিন্তু বিধিলিপি পরিবর্তনের শক্তি কাহারোও নেই।” এই বলে মহর্ষি বাল্মিকী বিদায় নিলেন। শ্রীরামচন্দ্র লব ও কুশকে রাজবেশ, রেশমি বস্ত্র, স্বর্ণ আভূষণ দ্বারা সাজিয়ে দিলেন । দুই রাজপুত্রকে দেখে সকলে আনন্দিত হল। অপরদিকে বৈকুণ্ঠে মাতা লক্ষ্মী দেবী পদার্পণ করলেন । তিঁনি ঐশ্বর্যের দেবী। দারিদ্র, অভাব দূর করেন তিঁনি । অপূর্ব শোভাময়ী তিঁনি। চঞ্চলা হয়ে থাকেন কিন্তু ভক্তের গৃহে স্থির হয়ে থেকে ধন সম্পদ বৃদ্ধি করেন ।

পদ্মালয়া, পদ্মহস্তা, পদ্মসুন্দরী দেবী সহস্র পদ্মে চরণ রেখে বৈকুণ্ঠে প্রবেশ করলেন। নানা আভূষণ ও দিব্য অলঙ্কারে তিঁনি ভূষিতা। কোটি তারকামালা যেনো অলঙ্কার হয়ে তাঁহার সর্বাঙ্গে শোভা পাচ্ছে। সহস্র কোটি শচী দেবীর সৌন্দর্য সেই লক্ষ্মী দেবীর রূপের কাছে পরাজিত হয় । অনুপমা দেবী পদ্ম ধারণ করে আছেন । বৈকুণ্ঠের অনুচরেরা নানা বিবিধ বাদ্য বাজিয়ে দেবী লক্ষ্মীকে স্বাগত জানালো। বৈকুণ্ঠপুরীর নিদারুন সৌন্দর্য লক্ষ্মী দেবীর আগমন ঠিক তেমন মনে হল, যেমন নক্ষত্রমালায় বিধু অবস্থান করে সেই সৌন্দর্য আরোও সুন্দর করে তোলেন। দেবীর সখীরা নানা সুগন্ধি দ্বারা দেবী লক্ষ্মীর অভিষেক করালেন। হিমালয়চূড়া সদৃশ চারিটি শ্বেত গজ স্বর্ণ কলসে দেবীর অভিষেক করলেন। সখীরা চামড়, পাখা, পুস্প প্রদান করতে লাগলেন। সেখানে দেবী লক্ষ্মী পদ্মাসনে বিরাজিতা হলেন। দেব দেবীরা স্তবাদি করতে লাগলেন । দেবী সরস্বতী, দেবী গৌরী সহ ভগবান শিব, প্রজাপতি ব্রহ্মা, শচী সহ মহেন্দ্র ও অনান্য দেবতারা সহধর্মিণী সহিত বিরাজিত ছিলেন । দেবী সরস্বতী বললেন- “দেবী হরিপ্রিয়া! আপনার এই সীতা রূপ ধন্য। বীরত্ব, ত্যাগ, মমতা, মাতৃত্বের একত্র সমন্বয় এই রূপে। জগত ধন্য হয়েছে আপনার আগমনে। আপনার সীতা অবতার জগতে সকল নারীদের কাছে আদর্শ উদাহরণ প্রস্তুত করেছে। ” দেবী গৌরী বললেন- “দেবী কমলা! আপনিই নারীর শ্রেষ্ঠত্ব জগতে স্থাপিত করেছেন আপনার নিজ জীবন দিয়ে। জগতের সকল নারী আপনাকেই অনুসরণ করে সতী রূপে দেবতাদের নমস্য হবেন। কারণ সতী নারীকে দেবতারাও শ্রদ্ধা করেন। আপনি প্রমান করেছেন নারীর আত্মত্যাগে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব। আপনিই শ্রীরামের সহায়িকা শক্তি হয়ে জগতে সকল পুরুষদের জীবনে স্ত্রীর ভূমিকা স্থাপন করেছেন। নারীজাতি সর্বদা আপনার এই সীতা রূপের কথা স্মরণে রাখবে। এই জগত যতদিন থাকবে ততদিন আপনার মাহাত্ম্য ঘোষিত হবে।” বৈকুণ্ঠের দ্বারপাল জয় বিজয় এসে বললেন- “মাতঃ! সনকাদি মুনির শাপে আমরা রাক্ষস হয়ে আপনার প্রতি কুনজর প্রদান করেছিলাম। আপনার অশেষ কৃপা আপনি আমাদের উদ্ধারের জন্য ভগবানের শক্তিরূপে অবতীর্ণা হয়েছিলেন।”

মাতা লক্ষ্মী দেবী বললেন- “নারী সৃষ্টির আধার। নারীই হলেন পুরুষের শক্তি। নারীই হলেন কল্যাণময়ী। জগতে এই সত্য যুগে যুগে নারীদের দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হবে । নারী ত্যাগেই পুরুষের বিজয়, শ্রেষ্ঠত্ব- ইহাই চরম সত্য। এই সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যই আমার মর্তে গমন। যুগে যুগে এভাবে নারীধর্ম প্রতিষ্ঠা, নারীর ভূমিকা প্রতিষ্ঠার জন্য আমি প্রভুর সহায়িকা শক্তি রূপে আগমন করবো।” এইভাবে বৈকুণ্ঠে মাতা লক্ষ্মীকে স্বাগত জানালো হল। ব্রহ্মা বললেন- “ত্রেতা যুগের বিদায়বেলা প্রায় উপস্থিত। এখন প্রভু শ্রীরামের মর্তলীলা সমাপনের পথে। খুব সত্বর তিঁনিও বৈকুণ্ঠে বিষ্ণু রূপে ফিরে আসবেন ।” শ্রীরামচন্দ্র খুব মন দিয়ে রাজ্য শাসন করলেন। রাম রাজত্বে ন্যায় বিচার হতো। কালের গর্ভে এক এক করে কৌশল্যা, কৈকয়ী, সুমিত্রা দেবী স্বর্গারোহণ করলেন । বৃদ্ধ মন্ত্রী সকলে পরলোক গমন করলেন । অয্যোধ্যার আট রাজকুমার এখন প্রায় কিশোর থেকে যুবক হওয়ার পথে । একদিনের কথা। কেকয় রাজা যুধাজিত মহর্ষি গার্গ্যমুনির সাথে দশ হাজার অশ্ব, কম্বল, চিত্র বস্ত্র , রত্ন ও নানাপ্রকার উপঢৌকণ নিয়ে অযোধ্যায় আসলেন। মহারাজ শ্রীরাম গার্গ্যমুনির চরণ পূজা করে বসতে আসন দিলেন । রাজা যুধাজিতকে যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শন করলেন । রাজা যুধাজিত বললেন- “হে শ্রীরাম। সিন্ধু নদের দুপাশে যে রমণীয় উদ্যান সহিত দেশ আছে। তাহা গন্ধর্বেরা দখল করে রেখেছে। সেখানে গন্ধর্ব রাজ লোমশের অনুগত তিন কোটি শক্তিশালী গন্ধর্ব সেই দেশ প্রহরা দেয়। আপনি সেই দুই রাজ্যকে আপনার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করুন। গন্ধর্বেরা সেই সুন্দর অঞ্চলের বাসিন্দাদের ওপর নির্যাতন নিপীড়ন চালাচ্ছে।” মহারাজ শ্রীরাম বললেন- “সেই গন্ধর্ব দের অত্যাচার থেকে অবশ্যই আমি মুক্ত করবো সেই নিরীহ প্রজাদের।”এরপর ভগবান শ্রীরাম ভরতকে বললেন- “ভ্রাতা ভরত। এবার তোমার যুদ্ধবিক্রম দেখানোর পালা। অবিলম্বে তুমি যুদ্ধযাত্রা করে লোমশের অনুগত তিন কোটি গন্ধর্ব কে বধ করবে। তোমার সাথে যুদ্ধে তোমার দুই পুত্র তক্ষ ও পুষ্কর যাবে। তুমি সেই রাজ্য জয় করে সেই রাজ্যকে দুভাগ করে তোমার দুই পুত্রকে দেবে। তাহারাই সেই দেশের রাজা হবে।”

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।