
অন্তরধান ভয়উ ছন একা ।
পুনি প্রগটে খল রূপ অনেকা ।।
রঘুপতি কটক ভালু কপি জেতে ।
জহঁ তহঁ প্রগট দসানন তেতে ।।
দেখে কপিনহ অমিত দসসীসা ।
জহঁ তহঁ ভজে ভালু অরু সীসা ।।
ভাগে বানর ধরহিঁ ন ধীরা ।
ত্রাহি ত্রাহি লছিমন রঘুবীরা ।।
দহুঁ দিসি ধাবহিঁ কোটিনহ রাবন ।
গর্জহিঁ ঘোর কঠোর ভয়াবন ।।
( তুলসীদাসী রামায়ণ )
অর্থাৎ- কিছুক্ষণ অদৃশ্য দেখে দুষ্ট রাবণ এক থেকে বহু হল মায়া দ্বারা । শ্রীরঘুবীরের সেনাদলে যত ঋক্ষ , বানর ছিল রাবণ ততগুলি হয়ে চারপাশে দেখা দিলো । বানরেরা অসংখ্য রাবণ দেখে এদিক ওদিক পালাতে লাগলো । তারা ‘হে রঘুবীর! হে লক্ষ্মণ ! রক্ষা করো’ বলে চতুর্দিকে পলায়ন করতে লাগলো । কোটি কোটি রাবণ চতুর্দিকে গর্জন করে বেড়াতে লাগলো।
দেবতারা এই দেখে ভাবলেন, এখানে দেখছি বহু রাবণের আগমন ঘটেছে। আমাদের পর্বত কন্দরে লুকিয়ে থাকাই শ্রেয় । কিন্তু ব্রহ্মা, শঙ্কর ও সিদ্ধ মুনি ঋষি গণ এমন ভাবলেন না। তাঁরা জানতেন মায়াধীশ শ্রীরাম । রাবণের সকল মায়া সমাপ্ত করবেন । বানরেরা রাবণের সেই মায়াকে ভয় পেয়ে ‘হে কৃপালু! রক্ষা করুন’ বলে পলায়ন করতে লাগলেন । শ্রীরাম রথে চড়ে তখন রাবণের সম্মুখে আসলেন ।
সুর বানর দেখে বিকল হঁস্যো কোসলাধীস ।
সজি সারঙ্গ এক সর হতে সকল দসসীস ।।
( তুলসীদাসী রামায়ণ )
অর্থাৎ- দেবতাদের ও বানরদের বিহ্বল চিত্ত হতে দেখে শ্রীরামচন্দ্র মৃদ্যু হাস্য করে শার্ঙ্গ ধনুকে শর সন্ধান করে সকল মায়া রাবণকে একটি শরেই বধ করলেন ।
তখন আসল যে রাবণ, শুধু সেই থাকলো । সূর্য উদয় হলে যেমন অন্ধকার দূর হয়- তেমনি দেবতা গণ একটি রাবণকে দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। শ্রীরামের ওপর পুস্প বর্ষণ করলেন । রাবণ মনে মনে ভাবল – এরা আমাকে একটি দেখে আনন্দ করছে। কিন্তু এরা জানে না, আমি একাই এদের বিনাশ করতে পারি। রাবণ তখন বলল- “ওরে মূর্খ বানর দল। তোরা আমাকে একটি দেখে আনন্দিত হচ্ছিস ? এই এক রাবণ তোদের বিনাশ করবে।” এই বলে রাবণ তখন বানরদের দিকে অগ্নিবাণ ছুড়লেন। ভগবান শ্রীরাম বরুণ বাণ নিক্ষেপ করে রাবণের অস্ত্রকে বিধস্ত করে দিলেন । এরপর ভগবান শ্রীরাম কালচক্র বাণ নিক্ষেপ করলেন। সেই বাণ থেকে অসংখ্য চক্র উৎপন্ন হয়ে রাক্ষসদের শিরোচ্ছেদ করলো। রক্তে ঢাকল মেদিনী। সমুদ্রের নীল জলরাশি রক্ত বর্ণ হল । মুণ্ডের পাহার জমল। কীরিট শোভিত মুকুট সহ ছিন্ন মুণ্ডগুলি নিয়ে গৃধ, বায়স ও অনান্য মাংসাশী পক্ষীরা যখন আকাশে উড়ে যাচ্ছিল্ল, মনে হল পক্ষীদের মুখে উজ্জ্বল মণি শোভা পাচ্ছে । রাবণ তখন ক্রোধে গর্জন করে বজ্রবাণ, মণিবাণ শ্রীরামের দিকে নিক্ষেপ করলো। ভগবান শ্রীরাম তখন ইন্দ্রাস্ত্র ও সূর্য বাণ নিক্ষেপ করলেন। রাবণের অস্ত্র ধ্বংস করলো। রাবণ পুনঃ ধূম্রাস্ত্র নিক্ষেপ করলে ভগবান শ্রীরাম বৈজয়ন্তী শক্তি নিক্ষেপ করলেন। গগনে দুটি অস্ত্রের মুখোমুখি সংঘর্ষে জগত কেঁপে উঠলো । এই যুদ্ধ দেখে সকলে আশ্চর্য হল । রাবণ চোখের পলকে এত শর নিক্ষেপ করলেন, মনে হল যুদ্ধভূমি একটি অন্ধকার কবচে ঢাকা পড়েছে। ঘোর শব্দে সেই বাণ আকাশ অন্ধকার করে এগিয়ে আস্তে লাগলো । ভগবান শ্রীরাম জ্বালা বাণ নিক্ষেপ করে সকল শর ভস্ম করলেন । দুজন দুজনের দিকে নানা ঘাতক অস্ত্র নিক্ষেপ করতে লাগলেন । রাবণের সকল অস্ত্র ধ্বংস হতে লাগলো । দেখতে দেখতে সূর্য অস্তের সাথে সাথে সেদিনের যুদ্ধ সমাপ্ত হল ।
পরদিন প্রভাত নামলো । শুক্লা নবমী তিথি । রাবণ যুদ্ধে বের হবে । প্রথমে শিবমন্দিরে গেলো । মহাদেবের পূজো করে বলল- “হে পিনাকপাণি! জন্ম হতে আমি তোমারই সেবক । রাবণের ইষ্ট তুমি । একদিন তোমারই আশীষে আমি ত্রিলোকবিজয়ী হয়েছিলাম । জানি তুমি আমাকে ত্যাগ করেছো। কিন্তু আমার আত্ম সম্মান অনেক বড়। সীতাকে আমি বিবাহের জন্য নিয়ে এসেছিলাম ঠিকই, কিন্তু এখন সে আমার সম্মান। সেই সম্মানকে আমি রামের হাতে কদাপি দিতে পারবো না । যদি যুদ্ধে আজ আমার মৃত্যু হয়- তবে তাই শ্রেয়। প্রান থাকতে আমি কাহার নিকট কোনদিন মাথা নোয়াবো না। আমার মস্তক থাকুক আর না থাকুক। হে সদাশিব! জানিনা আজ যুদ্ধের ফল কি হবে ! যদি আজ আমার অন্তিম দিন হয়, তাহলে আমার অন্তিম পূজো স্বীকার করুন। আর যদি আমি রামকে বধ করতে পারি, তবে জয়ী হয়ে এসে আপনার পূজা দেবো।” এই বলে রাবণ বের হল। শত রানী এসে রাবণকে অনেক বোঝালো। রাবণ মানলো না । মন্দোদরী এসে অনেক কাকুতি মিনতি করে বলল- “প্রভু ! জানিনা আজ কেন মন এত শঙ্কিত! এই ভয় পূর্বে ছিলো না। কেন জানি না নিশিথে স্বপ্নে যমরাজকে দর্শন করলাম । কেন জানি না মার্জার, শ্বাপদেরা আজ এত ক্রন্দন করছে ! হে নাথ! আজ আপনি যুদ্ধে যাবেন না । পুত্র হারিয়ে এখন আমি অনাথ- কেবল আপনিই ভরসা। আজ বড়ই ভয়ার্ত লাগছে এই পরিবেশকে। আজ আপনি যুদ্ধে যাবেন না। সীতাকে ফিরিয়ে দিন। আপনি একটিবার বলুন, আমি নিজে সীতাকে তাঁর স্বামীর হস্তে দিয়ে আসবো। এই যুদ্ধের ফল যে লঙ্কার পক্ষে নয়- এর প্রমান আপনি ত পেয়েছেন। দয়া করে আজ যুদ্ধে যাবেন না।” রাবণ বলল- “মন্দোদরী! তুমি আমার বীরত্বে কেন সংশয় করছ? সীতাকে এই সময় ফিরিয়ে দেওয়ার অর্থ রামের নিকট পরাজয় স্বীকার করা। রাবণ পরাজিত হয় না । পরাজিত হয়ে দীর্ঘ জীবনের থেকে যুদ্ধে বরং নিহত হওয়াই শ্রেয়। যুদ্ধভূমিতে মৃত্যুলাভ করা বীর যোদ্ধাদের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার । হয় বীরের ন্যায় যুদ্ধে জয় করে ফিরবো, নচেৎ যুদ্ধভূমিতে বীরগতি প্রাপ্ত করবো। কিন্তু শ্বাস থাকতে সীতাকে ফিরিয়ে দেবো না। এই বলে রাবণ কুড়ি অক্ষৌহিণী সেনা নিয়ে প্রস্থান করলো। রানীদিগের কোন বারণ মানলো না ।
( ক্রমশঃ )
আজ 'রামচরিতমানস' তথা হিন্দি রামায়নের লেখক সন্ত শ্রীল তুলসীদাস গোস্বামী মহারাজের আবির্ভাবের তিথি । আসুন প্রনাম জানাই তাঁহার চরণে । ওঁনাকে বাল্মিকী মুনির অবতার বলা হয় ।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন