১২ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব –১৪)

ভগবান শ্রীরাম বললেন- “ইহা সত্য যে স্বামী রূপে আমি অপরাধী। পিতা হিসাবে অপরাধী। কারণ আমি নিস্পাপ স্ত্রীকে গর্ভস্থ অবস্থায় ত্যাগ করেছি। এই সকল গালমন্দ আমার প্রাপ্য। কিন্তু আমার কর্তব্য কেহই দেখছে না। অযোধ্যার নরেশ শ্রীরাম ব্যক্তিগত স্বার্থ সুখ বিসর্জন দিতে পারে কিন্তু প্রজার দাবীকে কদাপি বিসর্জন দিতে পারে না। রঘুবংশজ রূপে আমি যাহা করেছি আমার তা কর্তব্য ছিলো। প্রজার মতামত না মান্য করলে আমি সেই যোগ্য রাজা হতে পারতাম না- যেরূপ প্রজারা আশা রাখেন । অতএব প্রজাদের দাবী পূর্ণ করে আমি যতটা নিজেকে যোগ্য বলে বিবেচিত করেছি, সীতার স্বামী রূপে ততটাই নিজেকে অযোগ্য বলে বিবেচোনা করি। যে সীতা এই রাম ভিন্ন আর কিছুই জানে না, তাকে ত্যাগ করে অপরাধী আমি।” কৈকয়ী বলল- “পুত্র! আমি তোমাকে আমার সন্তান বলেই জানি। তুমিও আমাকে তিন মাতার মধ্যে অত্যাধিক সম্মান ও শ্রদ্ধা করো। আমাকেই মাতা বলে মানো। কিন্তু পুত্র এই প্রথম আমি তোমার এই কর্মের বিরোধিতা করছি। এই সকল কিছুর কারণ আমি। আমিই ত বনবাস দিয়েছি তোমাকে, সীতাকে। না আমি তোমাদের বনে প্রেরণ করতাম- না এই সকল হত। মূল দোষী আমি। তোমার উচিৎ ছিলো আমাকে ত্যাগ করা। কিন্তু পুত্র তুমি তাহা না করে নির্দোষী স্ত্রীকেই ত্যাগ করলে ? পুত্র রাম! তোমার মাতা হয়ে আমি তোমাকে আদেশ করছি যে সীতাকে ফিরিয়ে আনো। আমার একবাক্যে তুমি বনবাসে চলে গিয়েছিলে। আজ এই মুহূর্তে তুমি সীতাকে অরণ্য থেকে নিয়ে আসো। যদি অযোধ্যার প্রজারা না চায়-আমি তাহলে সীতাকে নিয়ে পিত্রালয় কেকয় রাজ্যে চলে যাবো। সীতাকে পুত্রীর ন্যায় দেখাশোনা করবো। যে পাপ আমি করেছি তাহার ফল তোমরা কেন ভোগ করবে? আমাকেই বরং অযোধ্যা থেকে নিষ্কাশন করো।”

শ্রীরাম বললেন- “মাতা! পুত্র হয়ে মাতাকে বহিষ্কার করবো- ইহা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। এই সব বিধিলিপি। কেন নিজেকে তুমি দোষী জ্ঞান করছ ? মা আমি তোমার সব আদেশ মান্য করতে তৈরী। তুমি বললে এই মুহূর্তে আমি পুনঃ বনবাসে যেতে রাজী। কিন্তু সীতাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। কারণ আমি অযোধ্যার রাজা। যখন আমি রাজসিংহাসনে বসি তখন নাতো আমি কারোর পুত্র, নাতো কারোর স্বামী, নাতো কারোর অগ্রজ, নাতো কারোর পিতা। রাজধর্ম তখন আমার দায়িত্ব । সমস্ত রাজ্য আর রাজ্যবাসী তখন আমার দায়িত্ব, রাজ্যপরিচালনা আমার কর্তব্য, সমগ্র রাজ্যবাসী আমার আত্মীয় । আত্মীয়- সম্বন্ধ- আবেগ এই সকলের ঊর্ধ্বে হল কর্তব্য। আমি তাহাই করেছি। আমি জানি সীতা পবিত্রা। সে শুদ্ধা। সেই সতী নারী যেইস্থানে গমন করে তাহার চতুর্দিক অবধি পবিত্র শুদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আমি কর্তব্যে বদ্ধ , কর্তব্য আমার শিরে মুকুট হয়ে শোভা পাচ্ছে। ইহা আমি এড়িয়ে যেতে পারি না । যদি কখনো অযোধ্যাবাসী নিজের ভুল বুঝতে পারে সেইদিনই আমি সীতাকে ফিরিয়ে আনবো। কিন্তু তার পূর্বে নয়।” এরপর শ্রীরাম লক্ষ্মণ কে বললেন- “ভ্রাতা লক্ষ্মণ! তুমি সীতাকে মহর্ষি বাল্মিকীর তপোবনে ছেড়ে রেখে এসেছো ত?” লক্ষ্মণ মুখ ভার করে বলল- “ইহা জেনে আপনার কি অগ্রজ? আপনি ত রাজা। রাজার আবেগ ভালো নয়। বৌঠানকে আমি তাঁহার ভাগ্যের ওপরে ছেড়ে রেখে আপনার কর্তব্যের পূজায় বলি দিয়েছি। তিঁনি কোথায় আছেন- তা তিঁনিই জানেন। আমি তাহাকে সেই অরণ্যেই রেখে এসেছি। কিন্তু আমার পাপের ফল আমাকেই ভুগতে হবে তাই বুঝি বিধাতা আমাকে মুক্তি দিলেন না।” হনুমান এসব শুনে অনেক ক্রন্দন করলো। বলল- “প্রভু! মাতাকে এই দিন দেখানোর জন্য কি আপনি রাবণ বধ করে মাতাকে উদ্ধার করেছিলেন ? আমার অভাগিনী মায়ের অদৃষ্টে কেন এত দুঃখ ? মিথিলার রাজকণ্যা হয়েও চতুর্দশ বৎসর বনে কাটালেন। রাবণের রাজ্যে দশমাস কি অত্যাচার সহ্য করে রইলেন । আপনার কথায় অগ্নিপরীক্ষা দিলেন- তার পরেও এত দুঃখ ? আমি এখনই মাতার কাছে চলে যাবো। মায়ের সেবা করবো। ”

শ্রীরাম বললেন- “পবনপুত্র! অবশ্যই তোমার সাথে সীতার সাক্ষাৎ হবে। তুমিই ত প্রথম সীতার সংবাদ এনেছিলে লঙ্কা হতে। কিন্তু সে সময় এখনও আসেনি। যখন আসবে, তখন।” অযোধ্যা রাজপ্রাসাদে শোক নেমে এলো। অযোধ্যার সেই সকল প্রজা যারা মাতা সীতার চরিত্রে সংশয় প্রকাশ করছিলো- তারা এই বার্তা শুনে অতীব প্রসন্ন হয়ে মহারাজা শ্রীরামচন্দ্রের প্রশংসা করতে লাগলেন । বললেন- “এতদিন উচিৎ কর্ম হয়েছে।” অপরদিকে মহর্ষি বাল্মিকীর আশ্রমে সীতাদেবী থাকতে লাগলেন। দিন যেতে লাগলো। সীতাদেবী সেখানেই থাকতেন । আশ্রমের কাজ করতেন । রাজরানী হয়েও ছড়া দিয়ে লেপা, ঝাড় দিতে লাগলেন । ঐশ্বর্যের দেবী ভগবতী মাতা লক্ষ্মী মানবী রূপে সামান্য বস্ত্রতে সেই আশ্রমে অনান্য আশ্রম কন্যাদের মতো কাজ করতে লাগলেন । কোন কাজে না নেই। আশ্রম বালিকাদের সাথে তমসা নদী থেকে জল আনা, রন্ধনের জন্য জ্বালানী কাষ্ঠ সংগ্রহ, পূজার জন্য পুস্প চয়ন । মাঝে মাঝে বৃদ্ধা মা কাবেরী দেবী মানা করতেন যে গর্ভস্থ অবস্থায় এত কাজ ঠিক না । একদিনের কথা । সীতাদেবী মহর্ষি বাল্মিকীর কাছে রামায়ন পাঠ শুনতে লাগলেন। সীতাদেবী বললেন- “মহর্ষি আপনি প্রজাপতি ব্রহ্মার কৃপায় ভব্যিষত দেখতে সমর্থ। আপনি বলুন এর অন্তিম পাঠ কি হবে ?” বাল্মিকী বললেন- “পুত্রী! ভব্যিষতের ঘটনা প্রজাপতি আমাকে বলতে বারণ করেছেন । যখন যা ঘটবে তা নিজেই দেখতে পাবে। কিন্তু এই পরিণতি সুখ দায়ক হবে না। তবে আমি চেষ্টা করবো ইহাকে সুখদায়ক ঘটনায় পরিণত করতে । যাহা হবার তাহা হবেই। তবে তুমি সংশয় করো না।” এই শুনে সীতা দেবী অনেক কিছু ভাবলেন । একদিনের কথা। ‘রাম’ নামের সর্বোত্তম মহিমা এবার উদ্ঘাটন হবার সময় আগত হয়েছিলো ।

( ক্রমশঃ ) 
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।