২৫ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব –২২)

অসুরেরা নানা আনন্দ প্রকাশ করছেন। তাহারা নানা বাদ্য বাজনা বাজিয়ে নৃত্য করছে। মুনি ঋষিরা কপালে হাত দিয়ে ‘হায়,হায়’ করে রোদন করছেন। ঊর্ধ্বে দেবতা গণ শোক প্রকাশ করছেন । লবণ দানব এত উচ্ছ্বাস করছে যা দেখে মুনি ঋষিরা দুঃখের সাথে সাথে ভয়ে ভীত হয়েছিলো। কারণ শ্রীরামের কাছে যে নালিশ জানিয়েছেন তাহারা ইহা লবণ অসুর জানতে পেরেছে।এবার শোধ নেবে । হঠাত শত্রুঘ্নের শরীরে প্রাণের লক্ষণ সেখা গেলো। গা ঝাড়া দিয়ে শত্রুঘ্ন রথে উঠে দাঁড়ালো। তাহাকে উঠতে দেখে অয্যোধ্যার সেনারা আনন্দে জয়ধ্বনি করলো। মুনি ঋষি দেবতারা অতীব প্রসন্ন হল। শত্রুঘ্ন বললেন- “ওরে লবণ। মৃত্যুকে কেহ জয় করতে পারে না। কালকে কেহ বধ করতে পারে না। বিধাতা তোর জীবনপ্রদীপ নির্বাপণের কর্ম আমার ভাগ্যেই লেখেছেন। সুতরাং এই তোর অন্তিম সময়। একটু বাদেই তোর আত্মা তোর শরীর থেকে নির্গত হবে।” এই বলে শত্রুঘ্ন উঠে ধনুকে নারায়নাস্ত্র প্রকট করলেন। চতুর্দিক কেঁপে উঠলো সেই বাণের প্রভাবে, আকাশ থেকে উল্কা খসে পড়লো, আগ্নেয় গিরি জেগে উঠলো, সমুদ্রে উথালাপাতাল অবস্থা হল, বসুমতী ঘন ঘন কম্প হল, প্রলয় ঝড় বইতে লাগলো । নারায়নাস্ত্রের ফলা দিয়ে সপ্ত মুখে বহ্নি দেখা দিলো- এমনই আগুনের হুল্কা ছিলো যেনো সমগ্র ত্রিলোক ভস্ম করবে। আর বজ্রপাত হতে লাগলো । এই প্রলয় সমান অস্ত্র দেখে অসুরদের ভয়ে প্রাণ উরে গেলো। এই অস্ত্র যদি নিক্ষেপিত হয় তবে মরণ নিশ্চিত ।

বিষ্ণুবাণ শত্রুঘ্ন যুড়িল ধনুকে ।
স্থাবর জঙ্গম মেরু দিকপাল কাঁপে ।।
উল্কাপাত হয় যেন সেই বিষ্ণুবাণে ।
প্রলয় হইল দেখি ভাবে দেবগণে ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

মন্ত্র পড়ে শত্রুঘ্ন সেই মহাস্ত্র নিক্ষেপ করলো। বিকট গর্জন করে বিষ্ণুবাণ ছুটে গেলো । সেই অস্ত্রের ফলা দিয়ে যে আগুন, বজ্রপাত হচ্ছিল্ল তাতে কোটি কোটি অসুরেরা পুরে ভস্ম হল। উল্কাপাত হয়ে অসুরদের দেহ ঝলসে গেলো। চারপাশে এত আলোকিত হয়ে ছিলো যেনো সেই তেজে কিছুই দেখা গেলো না । ভয়ে লবণ অসুর নানা বাণ ছুড়তে লাগলো। কিন্তু নারায়নাস্ত্র বিফল হল না। সেই অস্ত্র এসে লবণ অসুরের বুকে বিদীর্ণ হওয়া মাত্রই লবণ রথ থেকে ছিটকে বসুমতী কাঁপিয়ে ভূমিতে পতিত হল। অস্ত্রের প্রভাবে লবণ অসুরের সমস্ত শরীর ঝলসে গেলো। লবণ নিহত হল। মুনি ঋষিরা জয়জয়কার করতে লাগলো। দেবতারা পুস্প বর্ষণ করতে লাগলেন শত্রুঘ্নের উপরে। কিন্তু এবার সেই নারায়নাস্ত্রের বিপরীত প্রভাব দেখা গেলো। বসুমতী কাঁপতে লাগলো, ভূমি ফেটে যেতে লাগলো, পাহার পর্বত সব ভেঙ্গে চুড়ে পড়তে লাগলো, নদী এসে দুকুল ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো। সমুদ্র যেনো ভীষণ ঢেঊ ধারন করে তির ভেঙ্গে চুড়ে দিলো। গাছপালা সব উপরে উপরে পড়তে লাগলো। পর্বত দিয়ে জ্বালামুখী বিস্ফোরণ হয়ে জলন্ত লাভা নেমে আসতে লাগলো। দেবতারা বললেন- “হে বিরিঞ্চিদেব। এই অস্ত্রকে সংবরণ করার ব্যবস্থা করুন। নচেৎ এইঅস্ত্র এখুনি বসুমতী ধ্বংস করবে।” ব্রহ্মা বললেন- “হে দেবগণ ! এই অস্ত্র কেবল শ্রীনারায়ণ নিজেই সংবরণ করতে পারবেন। এখন উনিই যা করবার করবেন।” শ্রীরাম সব দেখলেন। আকাশ কালো। কেবল ভস্ম রাশি চতুর্দিকে উড়ছে । আকাশে উল্কা, ধূমকেতু দেখা দিচ্ছে। ভগবান শ্রীরাম তখন সব দেখলেন । তিঁনি তখন সেই নারায়নাস্ত্রকে সংবরণ করলেন। প্রলয় থামল। সব অসুরেরা নিহত হয়েছে দেখা গেলো। মুষ্টিমেয় কিছু অসুর ও রাক্ষস পলায়ন করলো । অযোধ্যার সেনারা নানা রকম বাদ্য বাজাতে লাগলো। মুহুর্মুহু মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র ও শত্রুঘ্নের নামে জয়ধ্বনি করলো ।

শত্রুঘ্ন মথুরা পুরীতে প্রবেশ করলো। মথুরা পুরী আজ শান্ত। সেখানে কোন আতঙ্ক নেই। মনে হয় এখানকার সব লোক বহুদিন পর কয়েদ থেকে মুক্ত হয়েছে। পক্ষী যেমন খাঁচা থেকে পলায়ন করে আকাশে পাখনা মেলে উড়ে যেমন আনন্দ পায়- তেমনি মনে হল। মথুরার সকল লোক বের হয়ে এসে মহারাজ শ্রীরামচন্দ্রের নামে ধন্য ধন্য করলেন। শত্রুঘ্নের প্রশংসা করলেন । শত্রুঘ্ন বললেন- “হে মথুরাবাসীগণ! আজ হতে আমি আপনাদিগের রাজা। এখানে অযোধ্যার ন্যায় শাসন ব্যবস্থা আরম্ভ হবে। সেই শাসন ব্যবস্থায় রাজা হবেন প্রজার সেবক। প্রজার দাবী মানাই হবে এই শাসন ব্যবস্থার মুখ্য লক্ষ্য। আজ হতে আপনারা মুক্ত ও স্বাধীন। কোন আসুরিক আতঙ্কে আর আপনাদের ভুগতে হবে না। ন্যায়- নীতি – ধর্ম মেনে আমি এই রাজ্য মহারাজ শ্রীরামচন্দ্রের আদেশে পালন করবো।” এরপর শত্রুঘ্ন সেই মহাদেব প্রদত্ত দিব্য ত্রিশূলের পূজা করলেন। সেই দিব্য ত্রিশূল পুনঃ মহাদেবের কাছে ফিরে গেলো। অযোধ্যায় এই সংবাদ প্রেরণ করা হল। অযোধ্যায় উৎসব হল। তিন ভ্রাতা খুশী হয়ে দূত মারফৎ শত্রুঘ্ন কে মথুরায় থেকে প্রজাদের সেবা করতে বললেন । দেবতারা প্রকট হয়ে শত্রুঘ্ন কে অনেক অভিবাদন জানিয়ে বললেন- “বতস্য! তুমিও তোমার অগ্রজের ন্যায় বীর। এখন মথুরা নগরীকে মনুষ্য কুলের বসবাসের উপযোগী করো। এখানে ধ্বংস প্রাপ্ত মহল গুলির পুনঃ নির্মাণ করো। মন্দির স্থাপনা করো। বিদ্যা শিক্ষার প্রসারের ব্যবস্থা করো।” শত্রুঘ্ন তাই করলো। ইতি মধ্যে দেখতে দেখতে দ্বাদশ বৎসর কেটে গেলো। এর মধ্যে ভরতের দুটি পুত্র সন্তান হল। তাহাদের নাম তক্ষ ও পুষ্কর । লক্ষ্মণের দুটি পুত্র হল- নাম অঙ্গদ ও চন্দ্রকেতু। শত্রুঘ্নের দুটি পুত্র হল – নাম সুবাহু ও শত্রুঘাতী । রাজাবাড়ীতে আনন্দের সীমা ছিলো না । সকলে আনন্দে উৎসবে সামিল হল। একে একে ষষ্ঠীপূজো, অন্নপ্রাশন ও কুলগুরু বশিষ্ঠ মুনির আশ্রমে বিদ্যা শিক্ষা আরম্ভ হল। অপরদিকে শ্রীরামের দুই পুত্র লব ও কুশ মহর্ষি বাল্মিকীর কাছে বিদ্যা শিক্ষা গ্রহণ করতে লাগলেন ।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।