সেই বালকদের বিক্রম দেখে রাজা রামচন্দ্র বিস্মিত হলেন। ইহারা একাই যেনো গোটা ধরণীকে পরাস্ত করবার ক্ষমতা রাখে। একের পর এক তাহাদের ধনুক থেকে দিব্যাস্ত্র সকল নিক্ষেপিত হয়ে সহস্র সহস্র সেনার নাশ করছে। বজ্রবাণ, ইন্দ্রাস্ত্র, সূর্যবাণ, কালাগ্নি আদি দিব্যাস্ত্র সকল চালনা করছিলেন । দেখতে দেখতে সেনা সকলের দেহ ছিন্নবিছিন্ন হয়ে গেলো লব ও কুশের শরে। তখন ভগবান শ্রীরাম আদেশ দিলেন হস্তীবাহিনী আর অশ্বারোহী দের। তাহারা দুই বালক কে চারপাশে ঘীরে ধরে বন্দী করবে। কোটি কোটি হস্তী, অশ্বারোহী সেই দিকে চলল। হস্তীকুলের পদচালনায় মেদিনী কাঁপতে লাগলো। অশ্বের খুঁড়ের আঘাতে যেনো ধূলা ঝড় বয়ে চলল। হৈ হৈ আর হস্তী, অশ্বের গর্জনে চতুর্দিকে আচ্ছাদিত হল । লব ও কুশ দুজনে মিলে যুক্তি করলেন । ঠিক করলেন আজ শ্রীরামের সমস্ত সৈন্য ধ্বংস করে দেবো।
দুই ভাই কুপিয়া ধনুকে বাণ যোড়ে ।
হস্তী ঘোড়া কাটিয়া গগনে বাণ উড়ে ।।
লব এড়িলেন বাণ নামেতে আহুতি ।
এক বাণে কাটিয়া পড়িল কোটি হাতী ।।
কুশ বাণ এড়িল নামেতে অশ্বকলা ।
কাটিল তিরাশী কোটি তুরঙ্গের গলা ।।
চারিভিতে সৈন্য যুঝে লব কুশ মাঝে ।
নানা অস্ত্র লইয়া সে দুই ভাই যুঝে ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )
শ্রীরাম দেখলেন লব ও কুশের বাণে চতুর্দিকে কেবল অশ্ব ও হস্তীর কাটা মস্তক শোভা পাচ্ছে। ধ্বজ, ছত্র, রথের টুকরো তে মেদিনী শোভা পাচ্ছে । স্রোতস্বিনী নদী যেমন প্রস্তরে ক্রমাগ্রত ধাক্কা খেয়ে প্রবল স্রোত নিয়ে প্রবাহিত হয়, তেমনি এইস্থানে রক্তনদীর ধারা ভাঙা রথে ধাক্কা খেয়ে প্রবাহিত হচ্ছে । লব ও কুশ একের পর এক বলশালী সেনা, সেনাপতি দিগকে যমালয় প্রেরণ করছে । তাহারা শিলাবাণ নিক্ষেপ করলো। গগন থেকে শিলা পড়ে শ্রীরামের সেনা দলে হাহাকার উঠলো। দুই বালক উল্কাবাণ নিক্ষেপ করলো। চোখের পলকে লক্ষ জলন্ত বাণ এসে অয্যোধ্যার সেনার ওপরে আছড়ে পড়লো । এমনকি সেনারা ঢাল নিয়ে বাঁচলো না । ক্ষিপ্রগামী সেই সকল শর ঢাল বিদ্ধ করে সেনাদিগের বুকে বিঁধলো । আবার পবন বাণ নিক্ষেপ করলো। কত হস্তী, অশ্ব, রথী উড়ে গিয়ে ভূমিতে সশব্দে পতিত হয়ে মৃত হল। অয্যোধ্যার সেনারা চারপাশ থেকে বর্শা, ছোড়া, শর, পট্টিশ বর্ষণ করলো। লব ও কুশ অগ্নিবাণে সেই সকল ভস্ম করলো। দুই বালকের বিক্রম দেখে শ্রীরামের সেনারা রণে ভঙ্গ দিলো। কেহ কেহ আবার অঙ্গহীন হয়ে যুদ্ধে পড়ে থাকলো। লব ও কুশ হাস্য করে বরুণ বাণ নিক্ষেপ করে তাহাদিগকে নিমজ্জিত করে বধ করলেন । এই ভাবে যুদ্ধ চলল।
অপরদিকে তখন বিভীষণ ও তার রাক্ষস বাহিনী এগিয়ে গেলো। রাক্ষসেরা বিকট রূপ ধরে ভয় দেখাতে লাগলো। কিন্তু লব ও কুশ ভয় না পেয়ে কেবল হাস্য করতে লাগলো। বিকট চেহারার রাক্ষসেরা মুগুর নিয়ে চারপাশ কম্পিত করে এগিয়ে গেলো। সকলে ভাবল এবার বুঝি লব আর কুশের নিস্তার নেই । লব ও কুশ রুদ্রবাণ নিক্ষেপ করলেন। প্রচণ্ড সেই বাণ সশব্দে এগিয়ে গিয়ে সেই সকল রাক্ষসদের মুণ্ড গুলো কেটে ফেলল। মনে হল যেনো বিশাল তাল বৃক্ষ ভূমিতে পড়লো। কাটা ধড় থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটলো । রক্তে যেনো অকালে বন্যা হল। ইহার পর লব কুশ জ্বালাবান নিক্ষেপ করলেন। আকাশ থেকে অনেক প্রকাণ্ড আগুনের গোলা রাক্ষসদের ওপর ঝড়ে পড়লো। রাক্ষস দলে হাহাকার উৎপন্ন হল। প্রকাণ্ড আগুনের গোলায় রাক্ষসেরা ঝলসে গেলো। হস্তী, অশ্ব ঝলসে গেলো। রথ গুলি গলে যেনো সোনার নদীর ন্যায় প্রবাহিত হল । প্রকাণ্ড আগুনের গোলাতে ভীত হয়ে রাক্ষসেরা পলায়ন করতে লাগলো। ইহা দেখে বিভীষণ কুপিত হয়ে যুদ্ধ আরম্ভ করলো। বিভীষণ যত অস্ত্র নিক্ষেপ করলো লব ও কুশ সব ধ্বংস করলো। লব ও কুশ মিলে তখন চোখ চোখ শর নিক্ষেপ করলো। বিভীষণের রথ টুকরো টুকরো হল। বাণ ফুটে জর্জরিত হল বিভীষণ। সকলে তাকে ধরাধরি করে নিয়ে গেলো। জাম্বুবান হুঙ্কার দিয়ে ভল্লুক বাহিনী নিয়ে এগিয়ে এলেন । লব কুশ ভল্লুক বাহিনীর দিকে অর্ধচন্দ্র বাণ নিক্ষেপ করলেন। তাহার পর মহাপাশ অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। অর্ধচন্দ্র বাণে ভল্লুকেরা ছিন্নভিন্ন হল। মহাপাশ বাণে দফারফা সাড়লো । জাম্বুবাণ হুঙ্কার দিলেন। ভল্লুকেরা বৃহৎ প্রস্তর নিক্ষেপ করতে লাগলো। লব ও কুশ তত বাণ দ্বারা সেই সকল প্রস্তর চূর্ণ করলেন। বজ্রশক্তি বাণ নিক্ষেপ করলেন । এই বাণে ইন্দ্রদেবতার বজ্রের সমান শক্তি আছে। সেই বাণের থেকে সশব্ধে বজ্রপাত হয়ে ভল্লুকেরা সব ঝলসে গেলো। জাম্বুবান কে লক্ষ করে লব ও কুশ শর সন্ধান করলে জাম্বুবান পলায়ন করলেন । এরপর অঙ্গদ, সুগ্রীব, নল, নীল, গবাক্ষ, কেশরী, কুমুদ আদি বানরেরা সব এগিয়ে এলো। বানরেরা হৈ হৈ করে সব গদা, প্রস্তর নিয়ে ধাবমান হল।
মন্ত্র পড়ে কুশ তখন সূচীমুখ বাণ নিক্ষেপ করলো। লক্ষ বাণ উৎপন্ন হয়ে বানর , মর্কট দের উদর ছিন্ন করে দিলো। সাড়ি সাড়ি সেনা সকল মুখ থুবরে পড়লো। চারপাশে যেনো দেহের স্তূপ জমেছে । ঝড় হলে যেমন কদলী বৃক্ষ পড়ে, ঠিক সেই রকম ভাবে বানরেরা পড়লো। সকলে হায় হায় করে উঠলো। নল , নীল বাণ ফুটে ভূমিতে পড়লো । গবাক্ষ কেশরী আদি বানরেরা রক্তাক্ত হয়ে ভূমিতে পড়লো। রক্তে রক্তময় হল চারপাশে । গাছপালা গুলি অবধি সবুজ বর্ণ হারিয়ে রক্তিম আভা প্রাপ্তি করেছিলো। অঙ্গদ যুদ্ধ করতে যেতেই লব মণিবাণে ধরাশায়ী করলেন। রক্তবমি করতে করতে অঙ্গদ ভূমিতে পড়লো। সুগ্রীব গর্জন করে যুদ্ধে এসে বিশাল পর্বতের চূড়ার ন্যায় এক প্রস্তর তুলে নিলো। সেই প্রস্তর তুলে নিক্ষেপ করা মাত্রই লব ও কুশ তাহা কেটে ফেললেন। দেখতে দেখতে দুভ্রাতা সূর্যবাণ নিক্ষেপ করলেন। সুগ্রীব ভূপতিত হল। এবার শ্রীরামচন্দ্রের সাথে লব ও কুশের যুদ্ধ আরম্ভ হল। শ্রীরামের সেনা সকল অর্ধেকের বেশী নিহত হয়েছেন। বাকীরা সকলে আহত হচ্ছেন সমানে। ভগবান শ্রীরাম অগ্নিবাণ ছুড়লে কুশ বরুণ বাণে ধ্বংস করলেন। শ্রীরাম পর্বত বাণ নিক্ষেপ করলে কুশ বায়ুবানে ধ্বংস করলেন। শ্রীরাম নাগাস্ত্র ছুড়লে কুশ গরুর বাণে ধ্বংস করলেন। শ্রীরাম মহাপাশ, মহাশিরা অস্ত্র ছুঁড়লেন । দুই বাণ গর্জন করে ছুটে গেলো। লব ও কুশ অমোঘবাণ, শলাকাবাণ দ্বারা শ্রীরামের বাণ ধ্বংস করলেন । শ্রীরামের যক্ষবাণ, খড়্গবাণ, কৌমুদিনী শক্তি, চক্রবাণ, বায়ব্যবান, আধারবাণ, মায়াবান, কালপাশ আদি সকল অস্ত্রই লব ও কুশ মিলে ধ্বংস করলেন । এরপর বহু দিব্যাস্ত্রের সংঘর্ষ হল। মেদিনী কেঁপে উটলো, পর্বতে ধস নেমে গেলো, সমুদ্র উত্থাল পাতাল হল এই সকল অস্ত্রের প্রয়োগে। এমন সময় মহারাজ শ্রীরাম বললেন- “বালক ব্রহ্মাস্ত্র থেকে কেহ মুক্তি পায় না। আজ সেই বাণ প্রয়োগ করবো।” এই বলে শ্রীরাম ব্রহ্মাস্ত্র আহ্বান করতে উদ্যত হলেন। দুই বালক পাশুপাত অস্ত্র আহ্বান করতে লাগলেন। তখন মহর্ষি বাল্মিকী এসে বললেন- “লব ও কুশ তোমরা যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হও। একি অনর্থ করছ?”
( ক্রমশঃ )
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন