১২ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-৩৭)


হনুমান পুনঃ ক্ষুদ্রাকৃতি হয়ে মহীরাবণের রাজপ্রাসাদে ঘুরতে থাকলেন। সেই প্রাসাদ এত সৌন্দর্যে ভরা ছিলো যে অবাক হতে হয়। স্তম্ভে খোদাই করা মূর্তি গুলি অতি মূল্যবাণ রত্নাদি দ্বারা সজ্জিত ছিলো। এবং তাদের দ্যুতিতে জায়গা জায়গাতে আলোকিত হয়ে ছিলো । নানা রকম বাদ্য বাজনা আদি বেজে চলছে । একস্থানে দেখতে পেলো বলি দেবার জন্য নানা পশু ছাগ- মেষ- মহিষ এনে রাখা হয়েছে । তারপর সে দেখলো মহীরাবণের স্থাপিত সেই মন্দির। অপূর্ব সুন্দর মন্দিরের গাত্র গুলি সোনা, হীরা, মাণিক্য দ্বারা নির্মিত ছিলো। স্বর্ণ ইঁট দ্বারা মন্দিরের গাত্র তৈরী । এই দেখে হনুমান তাজ্জব হল। সামনে দেখতে পেলো মন্দিরের প্রবেশ পথ। দ্বার বন্ধ। হনুমান দ্বারের তল দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করলো। দেখলো প্রদীপের আলোকে চারপাশে ভরে থাকলেও কেমন একটা আলো আঁধারি পরিবেশ । ধূপের গন্ধ চতুর্দিকে ভরে গেছে। সামনে দেখতে পেলেন পাতালভৈরবীর বিগ্রহ । ভয়ানক রূপ সেই দেবীর । উগ্রা রূপিনী- এলোকেশী- কেশ রাশি চতুর্দিকে বিক্ষিপ্ত দেবীর। চরণে শায়িত মহাকাল । দেবীর কণ্ঠে নর করোটির মাল্য। চতুর্দিকে নর করোটি রাখা। দেবীর হস্তে খড়্গ- ত্রিশূল- ঢাল- গদা- চক্র- শঙ্খ – পদ্ম ধনুর্বাণ শোভা পাচ্ছে । দেবীর নয়ন ত্রয় অতি বৃহৎ ও গোলাকার। হনুমান গিয়ে দেবীর সামনে প্রথমে প্রণাম করলো। তাহার পর বললেন- “মাতঃ! এ তোমার কিরূপ লীলা? তুমি নিজেই অসুর বধ করে ধর্ম রক্ষা করেছো। কিন্তু মা তুমি পুনঃ কেন এই দানবিক শক্তিকে কৃপা করছ? মা তুমিই এইস্থানে মুক্তির উপায় প্রদর্শন করো। কিরূপে আমি মহীরাবণের বিনাশ করবো ? মা তুমিই বলে দাও। এই অধার্মিক মহীরাবণ আজ সফল হলে এই পৃথিবী থেকে ধর্ম, সত্য, পুণ্যের বিনাশ হবে।” এই বলে হনুমান , দেবী পাতালভৈরবীর কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন। কৈলাসে বসে হর গৌরী এই লীলা সকল দেখছিলেন। ভগবান শিব তখন মাতা পার্বতীকে বললেন- “দেবী! তুমি কার পক্ষ অবলম্বন করবে? ভক্তের না হনুমানের ? ঈশ্বর রূপে ভক্তের সঙ্গে থাকাই কর্তব্য। দেবী তুমি কার পক্ষ অবলম্বন করবে?” এই বলে মহাদেব , দেবীর পরীক্ষা নিচ্ছিল্লেন । মাতা ভবানী তখন সেই কৌতুকের জবাব দিলেন ।

দেবী বললেন- “স্বয়ং ভোলানাথ নিজেও নিজের ভক্ত রাবণকে ত্যাগ করেছেন ? তিঁনি যখন পাপের সঙ্গ দিলেন না, তাঁহার অর্ধাঙ্গিনী কিরূপে পাপীকে সহায়তা প্রদান করবে? প্রভু! আপনি সকল কিছুই জানেন। মহীরাবণ কদাপি আমার ভক্ত ছিলো না, সে কেবল স্বার্থান্ধ । ভক্ত তাঁহাকেই বলে যে ঈশ্বরকে ভালোবাসে, যে ঈশ্বরের সৃষ্ট সকল জীবে ঈশ্বরকে দর্শন করে তাহাদিগকে ভালোবাসে, ভক্ত তাহাকেই বলে যে ঈশ্বরলাভ ভিন্ন অপর কিছুই চায় না। মহীরাবণের মধ্যে এই সকল কোন গুনই নেই, যেমন তার পিতা রাবণের মধ্যেও নেই। এতকাল ধরে সে আমার উপাসনা করেছে, কেবল নিজ স্বার্থ সিদ্ধির নিমিত্ত । আমার প্রদত্ত শক্তিকে অসৎ কাজে প্রয়োগ করে এসেছে। এমন স্বার্থান্ধ ব্যক্তি কদাপি ভক্ত হতে পারে না। এই যুদ্ধে আমি মহীরাবনকে কোন সহায়তা প্রদান করবো না। আমি ধর্মের সঙ্গেই ছিলাম ও থাকবো।” অপরদিকে হনুমান সমানে মাকে ডেকে চলছে। ক্রোধে বললেন- “মাতঃ! যদি তুমি আজ নিশ্চুপ থাকবো- তবে বুঝবো তুমি পাষাণ। তোমার মূর্তি আমি চূর্ণ করবো।”

সবংশে মারিব মহী দেখিবে পশ্চাতে ।
ডুবাব তোমারে জলে মন্দির শিতে ।।
রামের কিঙ্কর আমি সুগ্রীবের দাস ।
এত শুনি দেবীর ঈষৎ হৈল হাস ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

হনুমান দেখলো হঠাত যেনো মন্দির ঝলমল করে উঠলো। দিব্য জ্যোতিতে মন্দির পূর্ণ হল। মায়ের বিগ্রহ থেকে দিব্য জ্যোতি বিচ্ছুরিত হতে লাগলো। সেই জ্যোতি ধরেই মহামায়া আবির্ভূত হলেন । দেবী হাস্য করে বললেন- “হনুমান! মহীরাবণের অন্তিম দিন আজ। আমি নিজে দুষ্ট দানব বধ করে ধর্ম সংস্থাপন করেছি। কদাপি আমি এই পাপীর বিজয় ইচ্ছা করি না। এই দুর্মতি আমার প্রদত্ত শক্তির অপব্যাবহার করে গেছে। পুত্র মারুতি! আমার বরে মহীরাবণ পশুর হাতেই বধ্য । আর তাকে বধ করবে তুমি। তাও এই মন্দিরে । আজ সেই দুরাচারীর বলি গ্রহণ করবো আমি। তুমি তাহাকে এই মন্দিরেই বধ করবে।”

হনুমান বলল- “মাতঃ! এতই যখন কৃপা করলে, তখন বলে দাও কিভাবে আমি মহীরাবণকে বধ করবো?” দেবী অম্বিকা বললেন- “হনুমান। এই সকল ঘটনা পূর্ব কল্পিত । আমার বরে মহী কেবল পশুর হাতেই বধ্য। শ্রীরাম এই সত্য জানতেন । তিঁনিই ইচ্ছা করে এই স্থানে এসেছেন, যাতে তাঁর অন্বেষণে তুমি এইস্থানে এসে মহীকে বধ করতে পারো। পুত্র হনুমান, শ্রীরাম স্বয়ং মায়াধীশ। তাঁর ওপর কোন মায়াই প্রভাব খাটাতে পারে না। এই সকল লীলা কেবল তোমার হস্তে মহীর নিধন করবার জন্য। কারণ মহী বধ না হলে, রাবণ বধ হওয়ার পর ধর্মাত্মা বিভীষণ নিষ্কণ্টক ভাবে রাজ্য পরিচালনা করতে পারবে না। পাতালে রাক্ষসদের রাজত্ব কেউই রোধ করতে পারবে না। তাই রাক্ষসদের গোড়া থেকেই নির্মূল করাই শুভ হবে। আমি তোমাকে বুদ্ধি দিচ্ছি, শ্রবণ করো।” এই বলে দেবী পাতালভৈরবী বুদ্ধি দিয়ে আশীর্বাদ করে অদৃশ্য হলেন । হনুমান ফিরে এসে ভগবান শ্রীরাম ও লক্ষ্মণকে সব বলে বললেন- “প্রভু! বলি দেবার আগে মহীরাবণ আপনাদের প্রণাম জানাতে বলবেন। আপনারা বলবেন , যে আমরা অযোধ্যার রাজকুমার। আমরা প্রনাম করতে জানি না। কিভাবে প্রণাম করতে হয়, দেখিয়ে দিতে। এই শুনে মহীরাবণ নিজেই প্রণাম করা দেখাতে গেলে আমি খড়্গ দিয়ে মহীরাবনের শিরোচ্ছেদ করবো। আমি পাতালভৈরবীর মূর্তির পেছনে আত্মগোপন করে থাকবো।” এই বলে হনুমান মন্দিরে গিয়ে ফলমূলাদি ভক্ষণ করলেন। তার পর মূর্তির পেছনে লুকালেন। রাত নেমে অন্ধকার নেমে আসলো। রাম, লক্ষ্মণকে স্নান করানো হল। মহীরাবণ পূজাতে বসলেন। তন্ত্র বিধানে পাতালভৈরবীর উপাসনা করে চলছেন। একে একে পশুগুলিকে বলি দিলেন। রক্ত নদীর ধারা দেবীর মন্দির থেকে নেমে এলো ।

( ক্রমশঃ )

Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।