১২ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-৩৬)


হনুমান এরপর আরোও অগ্রসর হল। দেখলো বিচিত্র সব অট্টালিকা। আর তাহাতে বিচিত্র সব জন বাস করছে । বড় বড় বৃক্ষ দেখলো। পর্বত প্রমান সেই উচ্চ বৃক্ষ তল বাঁধানো। সেখানে মানুষেরা বসে নানা গল্পগুজব করছে । মনে মনে হনুমান ভাবলেন এই পুরেই ত ভগবান শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ আছেন । কারণ এইস্থান রাক্ষসদের বস্তি । আর এখানেই মহীরাবণ রাজত্ব করে। অশ্ব, হস্তী, রথ সকল দেখলো। এই দেখে হনুমান একটি বৃক্ষের ওপরে উঠলো ।

মর্কট রূপেতে রহে বৃক্ষের উপর ।
বিচিত্র নির্মাণ ঘাট দেখে সরোবর ।।
বহু লোক আসি তথা করে স্নান দান ।
বানর দেখিয়া হয় চমৎকার জ্ঞান ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

হনুমান বৃক্ষের উপরে উঠে সমগ্র স্থান দেখছিলেন । ক্ষুধায় সেই বৃক্ষের ফল সেবা নিলেন । এই রাজ্যের রাক্ষসেরা ধর্ম কর্ম করে। দেখে আশেপাশে মন্দিরে রাক্ষসেরা পূজা দিচ্ছে। স্নান সেড়ে দানধ্যান আদি পুণ্যকর্ম করছে । কেউ কেউ আবার হনুমানের দিকে চেয়ে দেখছিলো। ভাবছিলো এমন বানর এখানে কোথার থেকে আসলো ? এই রাজ্যে বানর ত নেই। ঘাটে বসে বৃদ্ধারা সকলে গল্প করছিল। বৃদ্ধা বলছিল- “এই বানর এখানে কিভাবে এলো? মহারাজ মহীরাবণ জানলে একে শূলে চড়াবে।” অন্যরা বলল- “মনে হয় মহারাজ মহীরাবণ খুবুই বীর! তিনি কাউকে ভয় পান না।” বৃদ্ধা বলল- “কেনই বা ভয় পাবেন ? মহামায়ার কৃপায় তিনি অজেয়। বহু আগে তিনি মহামায়ার উপাসনা করে বর পেয়েছেন যে - দেবতা, নর, গন্ধর্ব, যক্ষ, পিশাচ, রাক্ষস, কিন্নর কেউই তাহাকে বধ করতে পারবে না। কেবল বনের পশুই তাহাকে বধ করতে পারবে।” এরপর বৃদ্ধা হেসে বলল- “বনের পশুর আর সাহস কি যে সে রাক্ষস রাজ মহীরাবণকে বধ করে? সে ত দেখেই ভয়ে পলায়ন করবে।” অন্যেরা তখন বলল- “রাজবাটিতে এত বাদ্য কেন বা বাজে? সেখানে সবাই কেন আনন্দিত হয়ে নৃত্য করছে? কিসের উৎসব?” বৃদ্ধা বলল- “তাহা আমি কি জানি বাপু! খানিক বাদেই রাজবাটির বৃদ্ধা দাসী এখানে স্নানে আসবেন। তোমরা তাহাকেই জিজ্ঞাসা করো।” সত্যই মহীরাবণের রাজ মহলে ঢাক, ঢোল, ন্যাকরা , দুন্দুভি, বাঁশী, শিঙা বাজছিলো। সেখান থেকে নৃত্যগীতের আওয়াজ আসছিলো ।

হনুমান সব শুনছিল। সে ভাবল এবার রাজ মহলের দিকে যেতে হবে । একটু পর রাজবাটির বৃদ্ধা দাসী স্নান করতে এলো। তাহাকে সবাই জিজ্ঞাসা করলো- “বলুন । রাজবাটিতে এত আনন্দ উৎসব কেন হচ্ছে ? কি এর কারণ?” বৃদ্ধা দাসী বললেন- “আমি তাহা বলিতে পারি না। বাতাসেরও কান আছে। যদি মহারাজ মহীরাবণের কানে এই সংবাদ যায় তাহলে আমার গর্দান যাবে।” তবুও সকলে নাছোড়বান্দা । সকলে জোর করলে বৃদ্ধা দাসী চারপাশে দেখলো যে কেউ আছে নাকি। তারপর বলল,

বৃদ্ধা নারী বলে শুন যতেক রূপসী ।
রাজার বাটীর কথা কৈতে ভয় বাসি ।।
কহিঁতে নিষেধ আছে কহিবারে নয় ।
প্রকাশ না কর কথা দণ্ড চারি ছয় ।।
জিজ্ঞাসা করিলে যদি সঙ্গোপনে বলি ।
মহামায়া- কাছে আজি হবে নরবলি ।।
আনিয়াছে দুটি শিশু পরম সুন্দর ।
না দেখি এমন রূপ অবনী ভিতর ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

বৃদ্ধা এরপর বললেন- “মহারাজ সেই রাম- লক্ষ্মণকে এনেছেন । যাদের সাথে এখন লঙ্কারাজ রাবণের যুদ্ধ চলছে। শুনেছি সেই দুই ভ্রাতা অযোধ্যার রাজকুমার। বিমাতার ইচ্ছায় বনে এসে থাকছিলো। তাঁহারা ক্ষত্রিয়। আজ তাহাদের বলি দেবেন নিশিপূজায়। তাই আজ এত ঢাক ঢোল বাজছে। এই কথা যেনো কাকপক্ষীও টের না পায়, তবে আমার প্রান যাবে।” হনুমান সব শুনে মাথায় হাত দিলো। সর্বনাশ! আজ রাত্রেই কি বলি দেবে। তবে যা করবার আজকেই করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে হনুমান আবার মক্ষী আকৃতি হয়ে চলল। মহীরাবণের রাজমহলে প্রবেশ করলো। সেখানে ঢুকে সে এক তাজ্জব ব্যাপার দেখলো। দেখলো যে হুবুহু তাঁর মতোন দেখতে এক কিশোর বানর মহলে প্রহরা দিচ্ছে। হঠাত সে দেখলো এক রাক্ষস এসে সেই বানরকে বলল- “সেনাপতি মকরধ্বজ ! তুমি অতি সতর্কে মহল প্রহরা দেবে। রাম, লক্ষ্মণ কে নিয়ে আসা হয়েছে। কারাগারে আটক করে রাখা হয়েছে। বানরেরা নিশ্চয়ই বসে নেই। তারা যেন এখানে না আসতে পারে।” হনুমান বুঝতে পারলো যে এই বানরের নাম মকরধ্বজ । সে পাতালে এসে রাক্ষসদের মাঝে এমন রাক্ষস অনুগত বানরকে দেখে যারপরনাই আশ্চর্য হল। এবার হনুমান খুঁজতে লাগলো, কোথায় রাম ও লক্ষ্মণ আছেন।

দুষ্ট মহীরাবণ কোথায় প্রভু শ্রীরাম ও লক্ষ্মণকে লুকিয়ে রেখেছে – তাই খুঁজে বেঁড়াতে লাগলো মহীরাবণ । রাক্ষসের মহল অতি সুন্দর ও সুশোভিত। বিচিত্র সব অট্টালিকা তে হীরা, মুক্তা, মণি দ্বারা নানা রকম নকশা খোদাই করা। জায়গা জায়গাতে ঝর্ণা । উদ্যানে নানা সুশোভিত সুগন্ধি ফুলের গাছ দেখলো। আর দেখলো বিচিত্র আকৃতি রাক্ষসেরা নানা অস্ত্র নিয়ে মহল প্রহরা দিচ্ছে । ক্ষুদ্রাকৃতি হনুমান কারোর নজরে এলো না । স্বেচ্ছায় হনুমান সর্বত্র ঘুরে বেড়াতে লাগলেন । সুন্দর, সুশোভিত মহলে গিয়ে মহীরাবণের স্ত্রীকে দেখতে পেলো। কোন কক্ষে মহীরাবণের পুত্র অহীরাবণকে দেখতে পেলো। এই ভেবে ঘুরতে ঘুরতে হনুমান কারাগারে প্রবেশ করলো। দেখলো ভগবান শ্রীরাম ও ভ্রাতা লক্ষ্মণ একটি কক্ষে আছেন। সাতটি লৌহ কপাট পার করে সেখানে যেতে হয় । হনুমান খুঁজতে খুঁজতে ভগবান শ্রীরামের কাছে ক্ষুদ্র শরীর নিয়ে কপাটের তলা দিয়ে প্রবেশ করে গেলেন। দেখলেন ভগবান শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ শয়ন করছেন। আর দেখলেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পিপীলিকাদল মুখে চিনি বয়ে এনে ভগবান শ্রীরাম ও লক্ষ্মণের মুখে দিচ্ছেন। হনুমানের খুব দয়া হল পিপীলিকাদের ওপর। হনুমানের স্পর্শে ভগবান রাম ও লক্ষ্মণ জেগে উঠলেন। জেগে উঠে বললেন- “আমরা কোথায়?” হনুমান তখন স্বাভাবিক রূপে এসে বললেন- “প্রভু! এ পাতাল পুরী। দুষ্ট মহীরাবণ আপানদের বলি দেবার জন্য এখানে মায়া দ্বারা এনেছেন। আপনারা সেই মায়া নিদ্রায় অচেতন ছিলেন। আপনারা চিন্তা করবেন না, মহীরাবণকে বধ করে আপনাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবো।” পরমেশ্বর ভগবান শ্রীরাম পিঁপড়েদের এমন ভক্তি দেখে অবাক হলেন। অচেতন অবস্থায় তারা সকল চিনি মুখে এনে দিয়েছে। ভগবান শ্রীরাম বললেন, “এই পিপীলিকার দল আমার সেবা করছে। হে পিপীলিকাগণ আমি তোমাদের আশীর্বাদ দিচ্ছি, আজ হতে পূজার যে সকল নৈবদ্য ভূমিতে পতিত হবে, তাহাতে তোমাদেরই অধিকার থাকবে। সর্ব অবস্থায় তোমরা জীবিত থাকতে পারবে। কদাপি তোমাদের বংশ নাশ হবে না।” এরপর ভগবান শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ বললেন- “কিন্তু সেই মায়াবী রাক্ষসের থেকে মুক্ত হবো কিভাবে?” হনুমান বলল- “এই উপায় আমিও জানি না। মহীরাবণ যাঁর চরণে আপনাদের বলি দেবে বলে স্থির করেছে, সেই দেবীকেই জিজ্ঞাসা করি। আশা করি সেই দেবী নিরাশ করবেন না। তিনি ধর্মের পক্ষই অবলম্বন করবেন।” এই বলে হনুমান পুনঃ মক্ষী রূপে কারাগার থেকে বের হল ।

( ক্রমশঃ )

Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।