১২ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-৫৮)

এবার বনবাস সমাপনের দিন সমাগত এলো। ভগবান শ্রীরাম , বিভীষণের সাথে রাবণের লঙ্কা নগরী পরিক্রমা করতে গেলেন। বিভীষণ বললেন- “প্রভু! আপনি চিন্তা করবেন না। ব্রহ্ম দেবের প্রদত্ত পুস্পক বিমান হাওয়ার গতিতে ছোটে। তাহাতে অল্প সময়ে আপনি অযোধ্যা পৌছে যাবেন ।” এরপর বিভীষণ, প্রভু শ্রীরামকে নানা স্থান দেখালেন। রাবণের আরাধিত শিব, ভদ্রকালী মন্দির দেখালেন । সব দেখে ভগবান শ্রীরাম , রাবণের প্রশংসা করে বললেন- “রাবণ যদি অধার্মিক না হয়ে শাস্ত্র মার্গ অবলম্বন করতো- তবে ত্রিলোকে তিঁনি পূজা পেতেন। আহা দুর্বুদ্ধির জন্যই ধ্বংস হয়েছেন।” সকলে ঘুরে ফেরবার পর ভগবান শ্রীরাম, সীতাদেবী ও লক্ষ্মণ একত্রে গেলেন বানর সেনার কাছে । বানরেরা সব দেশে ফিরবার জন্য তৈরী । ভগবান শ্রীরাম তখন বানর সেনাদের প্রনাম জানিয়ে বললেন- “হে বীর! এই যুদ্ধে আপনাদের অবদান যুগে যুগে অমর হয়ে থাকবে। আপনারা ভিন্ন এই দাশরথি রাম কদাপি সীতা উদ্ধার করতে পারতো না। এই যুদ্ধে শ্রীরাম নয় এই যুদ্ধে আদতে জয়ী হয়েছেন সমগ্র বানর সেনারা। ইতিহাস তাই ব্যাখান করবে। আপনাদিগের ঋণ কদাপি বিস্মৃত হবো না। এবার আপনারা ধীরে ধীরে দেশে প্রস্থান করুন।” সকল বানরেরা ধীরে ধীরে প্রণাম করে সেঁতু দিয়ে যেতে লাগলেন। যে যার দেশে ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নিলেন। ভগবান শ্রীরাম তখন সুগ্রীব, অঙ্গদ, জাম্বুবান, হনুমানকে আলিঙ্গন করে অনেক ধন্যবাদ জানালেন । এবার দেশে ফিরবার পালা । ভগবান শ্রীরাম ও সীতাদেবী পুস্পক বিমানে উঠে বসলেন। লক্ষ্মণ, হনুমান, অঙ্গদ, জাম্বুবান, সুগ্রীব, বিভীষণ ও কিছু বানর বীর তাতে বসলেন । পুস্পক বিমান মেঘের রাজ্য দিয়ে ভেসে উঠলো। সীতাদেবী ভাবতে লাগলেন, এই বিমানেই পাপী রাবণ তাহাকে হরণ করে এনেছিলো। আবার এই বিমানেই স্বামীর সাথে ফিরে যেতে পেরেছে। খুশীতে দেবী সীতার চোখে জল আসলো । ভগবান শ্রীরাম , সীতাদেবীকে সব দেখাতে লাগলেন, কোথায় যুদ্ধ হয়েছে। কোথায় কুম্ভকর্ণ বধ হয়েছে । কোথায় মেঘনাদ বধ হয়েছে। ইত্যাদি ইত্যাদি । বিভীষণ বললেন “প্রভু! এবার সেঁতু ভঙ্গ করুন। বানরেরা সকলে সেঁতু পার করে যে যার দেশে ফিরে গেছে।” সমুদ্র দেবতা উঠে সেই অনুরোধ জানালেন । বললেন- “প্রভু ! আমি বচন রেখেছি। কথা দিয়েছিলাম যতদিন না আপনি সীতা উদ্ধার করে ফেরেন, আমি এই সেঁতু রক্ষা করবো। আমি তাই করেছি। প্রভু! এই সেঁতু এবার ভঙ্গ করুন।”

লক্ষ্মণ বলল- “অগ্রজ! আদেশ দিন। এখুনি এই সেঁতু ভঙ্গ করি।” ভগবান শ্রীরাম আদেশ দিলেন।

সাগরের বোলে রাম লক্ষ্মণে নেহালে ।
লক্ষ্মণ লইয়া ধনু নামিল জাঙ্গালে ।।
ধনুহুলে তিনখানি পাথর খসায় ।
করি দশ যোজন একেক পথ হয় ।।
জাঙ্গাল ভাঙ্গিল জল বহে খরস্রোতে ।
লাফ দিয়া লক্ষ্মণ উঠিল গিয়া রথে ।।
কৃত্তিবাস পণ্ডিতের লঙ্কাকাণ্ড সার ।
অনায়েসে সকলে সাগর হৈল পার ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

এইভাবে লক্ষ্মণ সেই রামসেঁতু ভাঙ্গলেন। যাতে লঙ্কার নিরাপত্তা থাকে। এখনও এই সেঁতুর ধ্বংসাবশেষ দেখা যায় ভারতবর্ষ থেকে শ্রীলঙ্কার মধ্যে কিছু কিছু জায়গাতে । কিছু জায়গায় একরাশ পাথরের সাঁড়ি, কিছু জায়গায় সমুদ্রে নিমজ্জিত । এই সেই সেঁতু যাহাতে করে লঙ্কা গিয়েছিলেন ভগবান শ্রীরাম । বিশাল সমুদ্র পার করলেন । হনুমান দেখালো কোথায় নাগদেবী পরীক্ষা নিয়েছিলেন, কোথায় মৈনাক পর্বত উদয় হয়েছিলো, কোথায় সিংঘিকা রাক্ষসী বধ করেছিলো । এভাবে সমুদ্র পার করে ভগবান শ্রীরাম সহ পুস্পক বিমান রামেশ্বরে নামলো। ভগবান শ্রীরাম জানালেন এখানেই তিঁনি শিব উপাসনা করেছিলেন । পুনঃ ভগবান শ্রীরাম, মাতা সীতাদেবী, ভ্রাতা লক্ষ্মণ শিব উপাসনায় বসলেন । সকলে ধ্যানস্থ হলেন । ভগবান শ্রীরাম একে একে বিল্বপত্র , সমুদ্রের জল দ্বারা ভগবান শিবের পূজা করলেন। বনের মিষ্ট ফল নিবেদন করলেন । বললেন- “ হে মহেশ্বর। পুরাকালে তোমার আরাধনা করে সকলে পাপ মুক্ত হয়েছেন। ব্রাহ্মণ পুত্র বৃত্রাসুরকে বধ করে ইন্দ্রদেবতা তোমার কৃপায় ব্রহ্মহত্যার পাপ থেকে মুক্ত হয়েছেন। এই যুদ্ধে আমার হস্তে রাবণ, কুম্ভকর্ণের ন্যায় ব্রহ্মহত্যা হয়েছে। লক্ষ্মণের হস্তে ব্রাহ্মণ সন্তান মেঘনাদের বধ হয়েছে । ব্রাহ্মণ রাবণের অনেক সন্তানকে বধ করেছি। কৃপা করে ব্রহ্মহত্যার পাপ থেকে মুক্ত করুন প্রভু।” এই ভাবে শ্রীরাম প্রার্থনা করতে লাগলেন । রাবণ আর তার সন্তান রা জন্মসূত্রে ব্রহ্মার বংশজ হলেও, তাহাদিগের মধ্যে রাক্ষস স্বভাব ছিলো । কিন্তু ভগবান শ্রীরাম সৃষ্টির নিয়ম পালন করলেন । যেমন সব সর্প বিষাক্ত হয় না- কিন্তু সর্প দেখা মাত্রই আমরা মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে পলায়ন করি। ঠিক সেই রূপ সব জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ ব্রহ্মতেজ না রাখলেও, তাহাদিগকে সম্মান করাই যে ধর্ম- তাঁহাই শ্রীরাম প্রমান করলেন । এজন্য বারংবার বলা হয়- ব্রাহ্মণ- ব্রহ্মতেজ না রাখলেও, তাহাকে সম্মান করা উচিৎ । আমাদের কাজ আমরা করবো। এখন সেই ব্রাহ্মণ ভোগী না ত্যাগী- সেই বিচার ঈশ্বরের হাতে। এজন্যই ব্রাহ্মণ নিন্দা অনুচিত ।

আজকাল একটা ফ্যাশণ হয়ে গেছে – যে যেমন ভাবে পারে ব্রাহ্মণ দের নিন্দা করে। কিন্তু ব্রাহ্মণের কাছে আমরা একদিক হতে কৃতজ্ঞ । শতাব্দী কাল ধরে ভারতে সুলতান, মোগল, ব্রিটিশরা রাজত্ব করেছে। সেই সময় সনাতন হিন্দু ধর্ম টিকিয়ে রাখা কিংবা বেদাদি পুরাণ শাস্ত্র এই ব্রাহ্মণেরাই সংগ্রহ করে রেখেছেন । নাহলে হিন্দু ধর্মের বহু ইতিহাস ধ্বংস হয়ে যেতো । নিজেকে ‘খাঁটি হিন্দু’ বা ‘উদারমনস্ক’ চিহ্নিত করবার জন্য ব্রাহ্মণদের নিন্দা করে লাভ নেই । বরং তাঁহাদিগকে নুন্যতম সম্মান দিলে আমাদের কিছু ক্ষতি হবে না । যাই হোক হর গৌরী প্রসন্ন হয়ে দর্শন দিলেন । বললেন- “হে শ্রীরাম! রাবণ বধের নিমিত্তই আপনার আগমন। আপনি সেই কর্তব্যই করেছেন । আপনি ত সকল পাপ পুণ্যের ঊর্ধ্বে। কোন পাপ আপনাকে স্পর্শ করতে পারে না । রাবণের ভেতর কোন রূপ ব্রাহ্মণ সংস্কার ছিলো না। সুতরাং তাঁহাকে বধ করে আপনার কদাপি ব্রহ্মহত্যার পাপ হতে পারে না । বরং আপনার হস্তে নিধন হয়ে রাবণ সহ রাক্ষসেরা মুক্তি পেয়ে আপনারই ধাম প্রাপ্ত করেছে ।” এই সমস্ত কথা বলে হর গৌরী কৈলাসে ফিরলেন । পুনঃ সকলে উঠে পুস্পক বিমানে বসলেন । পুস্পক বিমান হাওয়ার গতিতে মেঘের রাজ্য ভেদ করে উড়ে চলল। আশেপাশে দেখা গেলো চতুর্দিকে বক, চিল নানা পাখী উড়ে উড়ে যাচ্ছে। নিম্নে তাকিয়ে দেখা গেলো কোথাও রাক্ষসের উৎপাত নেই। সকলে নির্ভয়ে বিচরণ করছে। মুনি- ঋষিরা আনন্দে যজ্ঞাদি করছেন । কত শত পুস্পে বৃক্ষ গুলি সেজে আছে । ভগবান শ্রীরাম সব দেখাতে লাগলেন । কোথায় বিভীষণের সাথে দেখা হয়েছে, কোথায় পম্পা সরোবরে ভক্তিমতী নারী শবরীর সাথে দেখা হয়েছে , কোথায় জটায়ুর সাথে দেখা হয়েছে , কোথায় মারীচ বধ হয়েছে । সীতাদেবী সব শুনতে লাগলেন । তাঁরা যখন পঞ্চবটির ওপর দিয়ে উড়ছিলেন, তখন সেই কুটির দেখতে পেলেন । দেখলেন সেই কুটীর লতা পাতায় আচ্ছাদিত হয়েছে । সীতা দেবীর এই কুটির দেখে পূর্বের কথা স্মরণ হল। এখানেই রাবণ সাধুর বেশে এসেছিলেন, লক্ষ্মণ রেখা পার করতেই রাবণ হরণ করলো। ভয়ে সীতাদেবী মুখ ঢাকলেন । বিভীষিকার মতো সেই স্মৃতি তাহাকে গ্রাস করলো। ভগবান শ্রীরাম অভয় দিলেন । তখন সীতাদেবী মনে করলেন- সেই দুঃস্বপ্নের রাত্রি কেটে গেছে । রাবণও মারা গেছে। প্রভু শ্রীরাম আছেন। আর ভয় কি!

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।