দুর্মুখ এই সকল সংবাদ শুনে মাথা হেঁট করে রাজপ্রাসাদে গেলো। এই সকল ঘটনা কিভাবে রাজাকে জানবে ভাবতে লাগলো। এই সকল পাপের কথা উচ্চারণ করলেই জিহ্বা ছিন্ন হবে। এই সকল অপবাদ মস্তকে আসলেই কুবুদ্ধি উৎপন্ন হবে। আর সেই সকল প্রজারা কিনা মাতা সীতার নামে কলঙ্ক দিচ্ছে । দুর্মুখ কি করবে ভাবতে লাগলো। ভগবান শ্রীরাম দুর্মুখ কে ডেকে জিজ্ঞেস করে বললেন- “বল দুর্মুখ! রাজ্যের প্রজারা সবে সুখে আছে ত ? তাঁহাদিগের মনে কোনপ্রকার অসন্তোষ নেই ত ? আমি কি যথাযোগ্য রাজা হতে পেরেছি ? আমি কি প্রজাদের ঠিকঠাক পালন করতে পেরেছি ? তাহারা আমার সম্বন্ধে কি বলে?” দুর্মুখ বলল- “মহারাজ! প্রজারা সব কুশলে ও সুখে আছে। কোথাও কোন কষ্টের সংবাদ নেই। কিন্তু কিছু প্রজা আপনার সম্বন্ধে যা বলছেন, তা আমি মুখেও আনতে পারবো না। সেই সকল কথা আমি বলতে পারবো না মহারাজ।” মহারাজ শ্রীরাম কঠোর হয়ে বললেন- “কি বলে দুর্মুখ! শীঘ্র আমাকে বল। আমি প্রজাদের মনের কথা জানার জন্যই তোমাকে নিযুক্ত করেছিলাম। তুমি সবিস্তারে নির্ভয় হয়ে বল। নচেৎ রাজধর্ম মেনে রাজার আদেশ অমান্য করবার জন্য তোমাকে দণ্ড প্রদান করবো।” দুর্মুখ আর কি করে, বলল- “মহারাজ! আমি আজ যে সকল কথা শ্রবণ করলাম- তাহাতে নিজের কর্ণকেও বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি কি জাগ্রত না নিদ্রিত হয়ে স্বপ্ন দেখছি তাহাও অনুমান করতে পারছি না। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা ইহা যেনো স্বপ্ন হয়। কেবলই দুঃস্বপ্ন । মহারাজ , কিছু প্রজা মাতা সীতার চরিত্রে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। তাহারা বলাবলি করছে যে রাবণের রাজ্যে দশমাস থেকে দেবী জানকী তাঁর সতীত্ব হারিয়েছেন। তিঁনি অসতী রমণী, তাহার সহিত আপনার সংসার করা তাহারা মেনে নিতে পারছেন না।” এই শুনে যেনো শ্রীরামের মণে সহস্র বজ্রপাত হল। সীতার সহিত যে সোনার সংসার রচনা করেছিলেন তাহা যেনো ঝড়ে ভেঙ্গে উড়ে গেলো। প্রবল বানের স্রোত এসে যেনো মুহূর্তে শ্রীরামের মন থেকে সকল আনন্দ কে ধুয়ে নিয়ে গেলো। শ্রীরাম একেবারে স্তব্ধ হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ । মনের ভেতরে কেমন যেনো একটা ভার অনুভব করলেন ।
শ্রীরাম কিছুক্ষণ বসে থাকলেন। দুর্মুখ বলল- “মহারাজ! আমি সেই সকল মহাপাপীর মুখ চিনে রেখেছি। আদেশ দিন এখুনি সেনা নিয়ে তাহাদের বন্দী করে আনি। যেই রাজ্যে এত সুখে আছে, সেই রাজ্যের রাজার স্ত্রীকে এত বড় অপবাদ? সতী লক্ষ্মী রানীমাতা সীতাদেবীর নামে যাহারা অপবাদ দেয়, তাহাদের এই অযোধ্যায় থাকার অধিকার নেই।” ভগবান শ্রীরাম মানা করলেন। বললেন- “ক্ষান্ত হও দুর্মুখ ! এভাবে বন্দী করে বল প্রয়োগ করে সব সমস্যার সমাধান হয় না। আমি আজ রাত্রিতে নিজে ছদ্দবেশে বের হবো। দেখি প্রজাদের মনে কি দাবী প্রকট হচ্ছে।” রাত্রিকালে আহারে বসলেন শ্রীরাম। চার ভ্রাতা একত্রে আনন্দে ভোজন করলেন। সবাই দেখলেন কি শ্রীরাম চুপচাপ বসে আছেন। স্বল্প আহার করে জলপান করে উঠে গেলেন। সকলে অবাক হল। তিন ভ্রাতা, তিন মাতা এসে এর কারণ জানতে চাইলো। শ্রীরাম কিছুই বললেন না । কক্ষে গিয়ে দেখলেন দেবী সীতা বিশ্রাম নিচ্ছেন । গর্ভ লক্ষণ প্রস্ফুটিত। গর্ভধারণের পর সীতাদেবীর রূপ শতগুণে বিকশিত হয়েছে । তনু থেকে অপূর্ব তেজ রাশি নির্গত হচ্ছে। সীতাদেবী স্বামীকে দেখেই উঠে বসতে গেলে শ্রীরাম বাধা দিলেন। বললেন- “হে সীতা! আজ আমাকে রাত্রিকালে নগর পরিক্রমায় বের হতে হবে। আমি ছদ্দবেশে নির্গত হবো। সব সময় গুপ্তচরদের প্রেরণ করে প্রজাদের মনের কথা জানা যায় না। রাজাকে নিজে যেতে হয়।” এই বলে শ্রীরামচন্দ্র সকল অলঙ্কার, রাজপোষাক ত্যাগ করে সাধারণ পোষাক পরিধান করে চাঁদর দিয়ে মস্তক ঢেকে বের হলেন । সমগ্র রাজ্যে ঘুরতে লাগলেন । দেখলেন জায়গায় জায়গায় প্রজারা গল্প করছে । তাদের দেখে মনে হল তাহাদের কোন প্রকার দুঃখ নেই । সকলে আনন্দে শান্তিতে আছেন । এরপর দেখলেন স্থানে স্থানে সকল বৃদ্ধ, যুবা একত্রে বসে গল্প করছেন । তাহার বলছেন- “এ ত ঠিক কথা! দশমাস লঙ্কায় থাকার পর কোন নারী কি আর সতী থাকে ? রাবণ ছিলেন দুশ্চরিত্র । তাঁর রাজ্যে কোন বন্দিনী নারী কিভাবে সতীত্ব নিয়ে থাকে ? যেমন চোরের গ্রামে রত্ন ভর্তি সিন্দুক তালা না দিয়ে রেখে গেলে- চুরি হবে না, এমন কি হয় ? কদাপি হয় না। আর সেই ভ্রষ্টা নারীকে নিয়েই মহারাজ সংসার করছেন। ঘোর অনাচার। কলিকাল না আসতেই এত অনাচার। আমাদের গৃহে এমন হলে অমন বৌকে দূরদূর করে তাড়িয়ে দিতাম ।”
শুনে শ্রীরাম যেনো নিজের কর্ণকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। মাথা ঘুরতে লাগলো। এমন বাক্য শোনার পরে মনে হল কেউ যেনো কর্ণে উষ্ণ তৈল ঢেলে দিয়েছে। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। বিশ্বাস করতেই পারলেন না যে এরা অযোধ্যার নাগরিক। যারা চতুর্দশ বৎসর কেবল অপেক্ষা করে গেছেন। সীতাকে নিজের পুত্রী জ্ঞান করতেন । আজ এরাই তাঁহার নামে এই সকল কথা বলছে । এরা কি বুদ্ধিশুদ্ধি হারিয়েছে । আরোও এগিয়ে গেলেন। দেখলেন কিছু লোক এই সম্বন্ধে আলোচনা করে সীতাকে অসতী বলে আলোচনা করছে। এরপর শ্রীরাম বিষন্ন মনে টলতে টলতে সরয়ূ নদীর তীরে গেলেন। দেখলেন এক রজক কাপড় পরিষ্কার করছে। আর এক বৃদ্ধর সাথে তর্ক করছে । বৃদ্ধ বলছে- “শোনো বাবাজীবন! তুমি আমার জামাতা। আমার কন্যার স্বামী। আমার কন্যাকে যদি তুমি ত্যাগ করো, তাহলে সে যাবে কোথায় বল ত?” রজক বলল- “চুলোয় যাক, আমার দেখার দরকার নেই । যে স্ত্রী একরাত স্বামীকে ত্যাগ করে বাহিরে রাত্রি যাপন করে, তার আবার চরিত্র বলে কিছু থাকে নাকি? সেই ভ্রষ্টা নারীর সাথে আমি সংসার করতে পারবো না। তাহাকে আমি গ্রহণ করবো না।” বৃদ্ধ ক্রন্দন করে বলল- “এমন বল না বাবাজী! আমার মেয়ে সতী নারী। তার মনে তুমি ভিন্ন আর কেউ নেই। সে পতিব্রতা । এক রাত কোন মেয়ে বাহিরে থাকলেই কি অসতী হয় ? এই অযোধ্যার রানী সীতাদেবীও ত দশমাস লঙ্কায় বন্দিনী ছিলেন । তিঁনি ত সতী নারী আর মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম তাঁহার সহিত সংসার করছেন। তুমি তোমার রাজ্যের রাজাকে দেখে শেখো।” রজক বলল- “ওনারা ধনী মানুষ! ওনাদের গৃহে এই সব অনাচার শোভা পায়। কারণ ওনাদের অন্যায় কেউ দেখিয়ে দিলে তাহাকে শূলে চড়াবে। কিন্তু আমি সাধারণ রজক। আমি সমাজে থাকি। আমার কাছে সমাজ, ধর্মই সব । আমি এই অনাচার করতে পারি না। যে স্ত্রী স্বামীকে ছেড়ে এক নিশি বাহিরে থাকে তার ধর্ম নষ্ট হয়। কোনমতেই সেই দুশ্চরিত্রা কে আমি গৃহে ঠাঁই দেবো না। এমন নারীকে ত্যাগ করাই শ্রেয়। মহারাজ শ্রীরামচন্দ্রেরও তাই করা উচিৎ। আমিও আপনার কন্যাকে ত্যাগ করলাম।” এইসকল শুনে শ্রীরামচন্দ্রের চোখ দিয়ে অশ্রুপাত হতে লাগলো। মাথায় হাত দিয়ে অবসন্ন , অসুস্থ মনে রাজমহলে ফিরে এলেন ।
( ক্রমশঃ )
শ্রীরাম কিছুক্ষণ বসে থাকলেন। দুর্মুখ বলল- “মহারাজ! আমি সেই সকল মহাপাপীর মুখ চিনে রেখেছি। আদেশ দিন এখুনি সেনা নিয়ে তাহাদের বন্দী করে আনি। যেই রাজ্যে এত সুখে আছে, সেই রাজ্যের রাজার স্ত্রীকে এত বড় অপবাদ? সতী লক্ষ্মী রানীমাতা সীতাদেবীর নামে যাহারা অপবাদ দেয়, তাহাদের এই অযোধ্যায় থাকার অধিকার নেই।” ভগবান শ্রীরাম মানা করলেন। বললেন- “ক্ষান্ত হও দুর্মুখ ! এভাবে বন্দী করে বল প্রয়োগ করে সব সমস্যার সমাধান হয় না। আমি আজ রাত্রিতে নিজে ছদ্দবেশে বের হবো। দেখি প্রজাদের মনে কি দাবী প্রকট হচ্ছে।” রাত্রিকালে আহারে বসলেন শ্রীরাম। চার ভ্রাতা একত্রে আনন্দে ভোজন করলেন। সবাই দেখলেন কি শ্রীরাম চুপচাপ বসে আছেন। স্বল্প আহার করে জলপান করে উঠে গেলেন। সকলে অবাক হল। তিন ভ্রাতা, তিন মাতা এসে এর কারণ জানতে চাইলো। শ্রীরাম কিছুই বললেন না । কক্ষে গিয়ে দেখলেন দেবী সীতা বিশ্রাম নিচ্ছেন । গর্ভ লক্ষণ প্রস্ফুটিত। গর্ভধারণের পর সীতাদেবীর রূপ শতগুণে বিকশিত হয়েছে । তনু থেকে অপূর্ব তেজ রাশি নির্গত হচ্ছে। সীতাদেবী স্বামীকে দেখেই উঠে বসতে গেলে শ্রীরাম বাধা দিলেন। বললেন- “হে সীতা! আজ আমাকে রাত্রিকালে নগর পরিক্রমায় বের হতে হবে। আমি ছদ্দবেশে নির্গত হবো। সব সময় গুপ্তচরদের প্রেরণ করে প্রজাদের মনের কথা জানা যায় না। রাজাকে নিজে যেতে হয়।” এই বলে শ্রীরামচন্দ্র সকল অলঙ্কার, রাজপোষাক ত্যাগ করে সাধারণ পোষাক পরিধান করে চাঁদর দিয়ে মস্তক ঢেকে বের হলেন । সমগ্র রাজ্যে ঘুরতে লাগলেন । দেখলেন জায়গায় জায়গায় প্রজারা গল্প করছে । তাদের দেখে মনে হল তাহাদের কোন প্রকার দুঃখ নেই । সকলে আনন্দে শান্তিতে আছেন । এরপর দেখলেন স্থানে স্থানে সকল বৃদ্ধ, যুবা একত্রে বসে গল্প করছেন । তাহার বলছেন- “এ ত ঠিক কথা! দশমাস লঙ্কায় থাকার পর কোন নারী কি আর সতী থাকে ? রাবণ ছিলেন দুশ্চরিত্র । তাঁর রাজ্যে কোন বন্দিনী নারী কিভাবে সতীত্ব নিয়ে থাকে ? যেমন চোরের গ্রামে রত্ন ভর্তি সিন্দুক তালা না দিয়ে রেখে গেলে- চুরি হবে না, এমন কি হয় ? কদাপি হয় না। আর সেই ভ্রষ্টা নারীকে নিয়েই মহারাজ সংসার করছেন। ঘোর অনাচার। কলিকাল না আসতেই এত অনাচার। আমাদের গৃহে এমন হলে অমন বৌকে দূরদূর করে তাড়িয়ে দিতাম ।”
শুনে শ্রীরাম যেনো নিজের কর্ণকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। মাথা ঘুরতে লাগলো। এমন বাক্য শোনার পরে মনে হল কেউ যেনো কর্ণে উষ্ণ তৈল ঢেলে দিয়েছে। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। বিশ্বাস করতেই পারলেন না যে এরা অযোধ্যার নাগরিক। যারা চতুর্দশ বৎসর কেবল অপেক্ষা করে গেছেন। সীতাকে নিজের পুত্রী জ্ঞান করতেন । আজ এরাই তাঁহার নামে এই সকল কথা বলছে । এরা কি বুদ্ধিশুদ্ধি হারিয়েছে । আরোও এগিয়ে গেলেন। দেখলেন কিছু লোক এই সম্বন্ধে আলোচনা করে সীতাকে অসতী বলে আলোচনা করছে। এরপর শ্রীরাম বিষন্ন মনে টলতে টলতে সরয়ূ নদীর তীরে গেলেন। দেখলেন এক রজক কাপড় পরিষ্কার করছে। আর এক বৃদ্ধর সাথে তর্ক করছে । বৃদ্ধ বলছে- “শোনো বাবাজীবন! তুমি আমার জামাতা। আমার কন্যার স্বামী। আমার কন্যাকে যদি তুমি ত্যাগ করো, তাহলে সে যাবে কোথায় বল ত?” রজক বলল- “চুলোয় যাক, আমার দেখার দরকার নেই । যে স্ত্রী একরাত স্বামীকে ত্যাগ করে বাহিরে রাত্রি যাপন করে, তার আবার চরিত্র বলে কিছু থাকে নাকি? সেই ভ্রষ্টা নারীর সাথে আমি সংসার করতে পারবো না। তাহাকে আমি গ্রহণ করবো না।” বৃদ্ধ ক্রন্দন করে বলল- “এমন বল না বাবাজী! আমার মেয়ে সতী নারী। তার মনে তুমি ভিন্ন আর কেউ নেই। সে পতিব্রতা । এক রাত কোন মেয়ে বাহিরে থাকলেই কি অসতী হয় ? এই অযোধ্যার রানী সীতাদেবীও ত দশমাস লঙ্কায় বন্দিনী ছিলেন । তিঁনি ত সতী নারী আর মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম তাঁহার সহিত সংসার করছেন। তুমি তোমার রাজ্যের রাজাকে দেখে শেখো।” রজক বলল- “ওনারা ধনী মানুষ! ওনাদের গৃহে এই সব অনাচার শোভা পায়। কারণ ওনাদের অন্যায় কেউ দেখিয়ে দিলে তাহাকে শূলে চড়াবে। কিন্তু আমি সাধারণ রজক। আমি সমাজে থাকি। আমার কাছে সমাজ, ধর্মই সব । আমি এই অনাচার করতে পারি না। যে স্ত্রী স্বামীকে ছেড়ে এক নিশি বাহিরে থাকে তার ধর্ম নষ্ট হয়। কোনমতেই সেই দুশ্চরিত্রা কে আমি গৃহে ঠাঁই দেবো না। এমন নারীকে ত্যাগ করাই শ্রেয়। মহারাজ শ্রীরামচন্দ্রেরও তাই করা উচিৎ। আমিও আপনার কন্যাকে ত্যাগ করলাম।” এইসকল শুনে শ্রীরামচন্দ্রের চোখ দিয়ে অশ্রুপাত হতে লাগলো। মাথায় হাত দিয়ে অবসন্ন , অসুস্থ মনে রাজমহলে ফিরে এলেন ।
( ক্রমশঃ )
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন