১২ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-৪০ )

ব্রহ্মা এরপর দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা কে আদেশ দিলেন- “হে বিশ্বকর্মা! আপনি একটি দিব্য রথ প্রস্তুত করুন। সামনেই ভগবান শ্রীরাম ও রাবণের মধ্যে অন্তিম সংঘাত উপস্থিত হবে। প্রভু শ্রীরাম সেই রথে চেপে যুদ্ধ করবেন। ইন্দ্রের অশ্ব সকল সেই রথের অশ্ব হবেন। মাতলি হবেন সেই রথের সারথি।” বিশ্বকর্মা বললেন- “আমি রথ নির্মাণ করবো। কিন্তু ভগবান শ্রীরাম প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আছেন যে তিনি চতুর্দশ বৎসর কোন রাজকীয় সেবা গ্রহণ করবেন না। এই অবস্থায় তিনি কি রথে আরোহণ করে যুদ্ধ করতে সম্মত হবেন?” ব্রহ্মা বললেন- “আপনার যুক্তি যথার্থ। কিন্তু দেবতা প্রদত্ত দ্রব্য রাজকীয় সম্পদে ধরা হয় না। সেই সূত্রে দেবতাদের প্রদত্ত রথ পার্থিব রথের মধ্যে গণ্য হবে না। সেই রথ অবশ্যই গ্রহণ করবেন প্রভু শ্রীরাম।” অপরদিকে রাবণ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হল। ক্রোধে সে সমস্ত লঙ্কাপুরীর যত রাক্ষস সেনা ছিলো সবকে ডেকে আনলো। এমনকি আহত রাক্ষসদের ডেকে আনলো। মন্দোদরী অনেক বুঝালেন। রাবণ শুনলো না। রাবণ ভদ্রকালী মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করলো- “মাতঃ! কদাপি আমি তোমার পূজায় অবহেলা অনাচার করিনি । বসন্ত ঋতুতে বিবিধ বলি দ্বারা তোমার পূজা করেছি । শাস্ত্র নিয়মে প্রত্যহ তোমার সেবা করেছি। মাতঃ তুমি আশীর্বাদ দিয়েছিলে যে যতদিন আমি তোমায় ত্যাগ না করি, ততদিন তুমি আমাকে রক্ষা করবে। হে অম্বিকা! আমি রামের সাথে অন্তিম যুদ্ধ করতে যাচ্ছি। আমার বংশ নাশ হয়েছে। আমি বড়ই সঙ্কটে। রামকে যতটা শক্তিহীন জ্ঞান করেছিলাম, সে ততটা নয়। সে রাক্ষস কূল উজার করেছে। হে জগদম্বা ! আমি অতি সঙ্কটে নিমগ্ন হয়ে তোমাকে শরণ করছি। হে ভবানী! যুদ্ধকালে আমাকে তুমি রক্ষা করো। রামের কোন অস্ত্র যেনো আমার শরীর স্পর্শ না করে।” এই বলে রাবণ ভবানীর কাছে স্তবস্তুতি করলো। কৈলাস হতে মহেশ্বর ও মহেশ্বরী সকল কিছুই দেখছিলেন । মহাদেব ত তাহাকে ত্যাগ করেছেন । মহাদেব বললেন- “দেবী! তুমি কি রাবণের পক্ষ অবলম্বন করবে নাকি শ্রীরামের পক্ষ? তুমি ধর্ম না অধর্মের পক্ষ গ্রহণ করবে? তুমি নিজেই অস্ত্র ধারণ করে অসুর বধ করে দেবতাদের স্বর্গ রাজ্য অসুরমুক্ত করেছিলে । এবার তুমি কি সেই অসুরদের পক্ষ নেবে?”

দেবী বললেন- “প্রভু! মহীরাবণের পক্ষ কি আমি গ্রহন করেছিলাম ? রাবণ ঐ মহীরাবণের ন্যায় স্বার্থান্ধ । কিন্তু আমি রাবণের আরাধনাতে সন্তুষ্ট হয়ে তাহাকে বর প্রদান করেছিলাম যে সে যতদিন আমাকে ত্যাগ না করবে ততদিন আমি তাকে কৃপা করবো। রাবণ একদিন আমাকে ত্যাগ করবে। সেই দিন অতি নিকটে আসছে। সেইদিন রাবণের বিনাশ হবে। প্রভু আমি জানি অসুর জাতি ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা নিয়ে আস্ফালন করে অসৎ কর্মে লিপ্ত হয়। কিন্তু ঈশ্বরের কর্তব্য সকাম ও নিস্কাম উভয় ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করা। সেই কারনেই পিতামহ ব্রহ্মা অসুরদিগকে বর প্রদান করেন। এই রাবণ পূর্বেও আপনার ও পিতামহ ব্রহ্মার বর পেয়েছে। হে মহেশ্বর! আপনি নিজেও স্বয়ং ভস্মাসুরকে বর প্রদান করেছিলেন, আপনি কি জানতেন না অপাত্রে উত্তম বস্তু দেবার পরিণাম কি? সেইরূপ রাবণের ওপর আমি কৃপাদৃষ্টি ততদিন রাখবো, যতদিন সে না আমাকে ত্যাগ করে।” মহেশ্বর বললেন- “হে অম্বিকা! এই যুদ্ধে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হবে। সেই ইতিহাসের মধ্যমণি হবে তুমিই। বিশ্ব সংসারে এক পরিবর্তন আসবে।” ব্রহ্মা স্বয়ং জানতেন দেবী সদয় আছেন রাবণের পর। যাই হোক রাবণ যুদ্ধে বের হল । এক বিশাল সংখ্যক সেনাবাহিনী নিয়ে আসলো।

চলেউ নিসাচর কটকু অপারা ।
চতুরঙ্গিনী অনী বহু ধারা ।।
বিবিধি ভাঁতি বাহন রথ জানা ।
বিপুল বরন পতাক ধ্বজ নানা ।।
চলে মত্ত গজ জূথ ঘনেরে ।
প্রাবিট জলদ মরুত জনু প্রেরে ।।
বরন বরন বিরদৈত নিকায়া ।
সমর সূর জানহিঁ বহু মায়া ।।
অতি বিচিত্র বাহিনী বিরাজী ।
বীর বসন্ত সেন জনু সাজী ।।
চলত কটক দিগসিন্ধুর ডগহীঁ ।
ছুভিত পয়োধি কুধর ডগমগহীঁ ।।
( তুলসীদাসী রামায়ণ )

অর্থাৎ-“ বিপুল রাক্ষস সৈন্যবাহিনী এগিয়ে গেল। চতুরঙ্গ সেনারাই কত দল ছিল। বহু রকমের বাহন, রথ ও যান ব্যবহৃত হল । ধ্বজা পতাকাও বহু রঙের ছিল । দলে দলে মদমত্ত হস্তীসকল এগিয়ে চলল । মনে হল যেন পবনের প্রেরণায় বর্ষার মেঘের মিছিল । চিত্রবিচিত্র সাজসজ্জায় বীর সকল চলছিল ; তারা অতিশয় রণকুশল বহু আবার মায়াযুদ্ধে নিপুণ । অতি বিচিত্র ছিল সেই সৈন্যবাহিনীর শোভা । মনে হচ্ছিল যেন বসন্ত সৈন্যবাহিনী সুসজ্জিত করে অগ্রসর হচ্ছে । সৈন্যবাহিনীর পদ্ভারে দিগগজ সকল টলমল হল, সমুদ্র বিক্ষুব্ধ হল আর পর্বত দুলে উঠলো।”

উঠী রেনু রবি গয়উ ছপাঈ ।
মরুত থকিত বসুধা অকুলাঈ ।।
পণব নিসান ঘোর রব বাজহিঁ ।
প্রলয় সময় কে ঘন জনু গাজাহিঁ ।।
ভেরি নফীরি বাজ সহনাঈ ।
মারূ রাগ সুভট সুখদাঈ ।।
কেহরি নাদ বীর সব করহীঁ ।
নিজ নিজ বল পৌরুষ উচ্চরহীঁ ।।
( তুলসীদাসী রামায়ণ )

অর্থাৎ- সৈণ্যবাহিনীর পদভারে দিগবিগন্ত ধূলিময় হল । যাতে সূর্যের আলোক ধূলায় ঢাকা পড়লো , বসুধা বিহ্বল চিত্ত হয়ে পড়লো । উচ্চগ্রামে ঢোল, নাকরা বেজে উঠল ; তখন তাকে প্রলয়ঙ্কর মেঘের গর্জন মনে হচ্ছিল্ল। ভেরী, তূরী ও সানাই বেজে উঠল । তাতে যোদ্ধাদের প্রিয় মারিবেহাগ বাজছিল । বীরেরা সিংহনাদ করে উঠছিল ; তারা নিজ বলবত্তা জাহির করে উদ্বুদ্ধ করছিল নিজেদের।

রাবণ বলল- “রাক্ষস বীরেরা ! তোমরা ঐ বানর, ঋক্ষ , মর্কট দলকে বধ করো। আমি ঐ দুই রাজকুমার ভ্রাতাকে হত্যা করবো।” লঙ্কার দ্বার খুলতেই রাক্ষসেরা ঝাঁপিয়ে পড়লো। বানরেরা জবাব দিল। ভগবান শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ শরে শরে রাক্ষস বাহিনীকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে লাগলেন ।

( ক্রমশঃ )

 — 
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।