শ্ত্রুঘ্নের কথা শুনে সকলে আশ্চর্য হল। লবণ অসুরকে সে কিভাবে বধ করবে। তিন ভ্রাতা মিলে বললেন- “শত্রুঘ্ন ! তুমি এই কর্মে সফল হবে না। কারণ লবণ মায়াবী ও শক্তিশালী। তার কাছে ভগবান মহাদেবের ত্রিশূল আছে । তোমার কিছু হলে আমরা কিভাবে নিজেদের সান্ত্বনা দেবো। ভুলেও তোমাকে যুদ্ধে যেতে আদেশ করতে পারি না।” এই বলে তিন ভ্রাতা মিলে কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে অনেক বোঝালেন । কিন্তু শত্রুঘ্ন নারাজ। সে বলল- “আমি কি বীর নই ? আমি এই বীর সূর্য বংশে জন্মেছি। আমার স্বর্গীয় পিতা অসুরদের পরাজিত করেছিলেন, এমন কি শণিদেবের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন – তাঁহার সন্তান হয়ে আমি কি ভাবে নির্বল হব ? আমার অগ্রজ মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র রাক্ষস নাশ করে দশাননকে বধ করেছেন, সেই বীরপুরুষের ভ্রাতা কি দুর্বল হয় ? আমার অপর অগ্রজ শ্রীভরত চতুর্দশ বৎসর সন্ন্যাস জীবন পালন করে অখণ্ড ব্রহ্মচর্য পালন করেছেন, সেই ব্রহ্মচারীর ভ্রাতা হয়ে আমি কি দুর্বল হইব? আমার অগ্রজ শ্রীলক্ষ্মণ লঙ্কার অনেক রাক্ষস বধ করে দেবজয়ী মেঘনাদকে বধ করেছেন, তার ভ্রাতা হয়ে আমি দুর্বল কি ভাবে হই ? কনিষ্ঠ বলে কি আমি সব সময় সুযোগহীন হয়ে থাকবো? এ কেমন বিচার। কনিষ্ঠ ভ্রাতা জীবিত থাকতে যদি অগ্রজ ভ্রাতা কষ্ট করে তবে সেই কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে ধিক। আপনারা কেউ যাবেন না। আমি গিয়ে লবণ অসুরকে বধ করবো। আপনাদের মুখ উজ্জ্বল করে ফিরবো।” এই বলে শত্রুঘ্ন জেদ ধরে বসলো। সকলে বুঝিয়ে নিস্ফল হল। তখন শ্রীরাম বললেন- “আচ্ছা বেশ। শত্রুঘ্নকে সুযোগ দেওয়া হোক। সেইই লবণ বধ করুক।” এই শুনে শত্রুঘ্ন তখন ভগবান শ্রীরামের চরণে প্রনাম জানিয়ে বললেন- “অগ্রজ! আমার ওপরে বিশ্বাস রাখুন। আমি আপনার ভ্রাতা। এই ক্ষুদ্র কর্ম করতে আমি সমর্থ। কেবল আপনি আশীর্বাদ করুন যেনো বংশের মান রাখতে পারি। আপনার বিজয় ধ্বজ যেনো মথুরায় উত্তোলন করতে পারি।” ভগবান শ্রীরামচন্দ্র তখন কনিষ্ঠ ভ্রাতা শত্রুঘ্ন কে আলিঙ্গন করে আশীর্বাদ করলেন ।
সূর্য উদয়ের সাথে সাথে শত্রুঘ্ন যুদ্ধযাত্রার জন্য প্রস্তুত হলেন। শ্রুতকীর্তি প্রভাতে কুলদেবতা সূর্যনারায়ণের পূজা করে শত্রুঘ্ন এর কপালে বিজয় তিলক দিলেন। হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে মঙ্গল কামনা ও যুদ্ধ জয়ের প্রার্থনা জানালেন । পুস্প দ্বারা পূজা ও মঙ্গল প্রদীপ দিয়ে আরতি করলেন। এরপর বিদায় জানালেন। শত্রুঘ্ন তিন মাতার চরণে প্রনাম জানালে মাতারা বিজয়ী হবার আশীর্বাদ দিলেন । এরপর দুই অগ্রজের আশীর্বাদ নিয়ে ভগবান শ্রীরামের চরণে প্রণাম জানালেন । ভগবান শ্রীরাম তখন নারায়নাস্ত্র শত্রুঘ্ন কে দিয়ে বললেন- “শত্রুঘ্ন! এই অস্ত্র গ্রহণ করো। এই অস্ত্রের খুবুই বিধ্বংসী ক্ষমতা। ত্রিলোক ধ্বংস করে দিতে পারে এই অস্ত্র । এই অস্ত্রকে খুবুই সাবধানতার সহিত প্রয়োজন পড়লেই ব্যবহার করবে, অন্যত্থায় নয় । বিজয়ী হয়ে আসো। আমি তোমার বিজয়ের জন্য ভগবান শঙ্করের কাছে প্রার্থনা জানাবো। লবণ কে বধ করার পর তুমিই হবে মথুরার রাজা। সেখানে ন্যায়- নীতি- ধর্ম প্রতিষ্ঠা করবে। আমি তোমাকে মথুরার রাজা রূপে অভিষিক্ত করলাম।”
এক লক্ষ রথ নড়ে এক লক্ষ হাতী ।
এক লক্ষ ঘোড়া নড়ে পবনের গতি ।।
লবণে মারিতে বীর করিল সাজনি ।
শত্রুঘ্নের নিজ বাদ্য, সাত অক্ষৌহিণী ।।
লিখনে না যায় ঠাট কটক অপার ।
শুনিয়া বাদ্যের শব্দ লাগে চমৎকার ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )
সাত অক্ষৌহিণী সেনা নিয়ে শত্রুঘ্ন চলল। তুরী- ভেরী- দুন্দুভি- ন্যাকরা- বাঁশী- ঢাক- ঢোল- করতাল আদি বাদ্য বাজতে লাগলো। ধনুর্বাণ, গদা, তরবারি, শত শর ভর্তি তূন, তীক্ষ্ণ বর্শা, ঢাল, খড়্গ ইত্যাদি ঘাতক অস্ত্র ধারণ করে শত্রুঘ্ন রথে উঠলেন । ধ্বজ উত্তোলিত হল চারপাশে । সকলে শ্রীরামের জয়ধ্বনি করলেন। একে একে সাত অক্ষৌহিণী কটক বের হল। হস্তী গুলি মেদিনী কাঁপিয়ে প্রচণ্ড গর্জন করে চলতে লাগলো। অশ্ব গুলি ধূলা উড়িয়ে চলল। রথ, পদাতিক সেনা সকল ঘাতক অস্ত্র উচিয়ে শ্রীরামের জয়ধ্বনি করতে করতে বের হল ।
ধীরে ধীরে শত্রুঘ্ন বাল্মিকী মুনির আশ্রমের দিকে আসলো। বাল্মিকী মুনিকে দর্শন করে আশীর্বাদ নেবে ভাবল। এখানে যে সীতাদেবী আছেন তাহা জানতেন না শত্রুঘ্ন । অপরদিকে সীতাদেবীর গর্ভ যন্ত্রনা আরম্ভ হল। প্রসব বেদনায় সীতাদেবী কাতর হলেন । ধাইমা, কাবেরীদেবী ও আশ্রমের কন্যারা সীতাদেবীর সেবা করতে লাগলেন । আগত হল সেই সময় যখন শ্রীরামের সন্তান ভূমিষ্ঠ হবেন । শ্রাবনের পূর্ণিমা তিথি সেইদিন । অবশেষে এলো সেই সময়। সীতাদেবী প্রবল যন্ত্রনা সহ্য করে শ্রীরামের প্রথম পুত্র সন্তান কে জন্ম দিলেন। কিন্তু তখনও প্রসব বেদনা দূরীভূত হয় নাই। কিছু ক্ষণ করে পুনঃ সীতাদেবী অপর একটি পুত্রের জন্ম দিলেন। ধাইমা নাড়ীচ্ছেদন করলেন। এবার প্রসব বেদনা দূরীভূত হল । সুন্দর উজ্জ্বল শিশু দ্বয়ের মুখ দেখে সকলে প্রসন্ন হল। দুই শিশুর রূপে যেনো ভুবন আলোকিত হয়ে আছে। অপূর্ব দিব্য ছিলেন তাহারা। অঙ্গ থেকে যেনো জ্যোতি নির্গত হচ্ছে। শঙ্খ ধ্বনি, উলু ধ্বনিতে মহর্ষির আশ্রম মুখরিত হল। কাবেরীদেবী এসে বললেন- “বনদেবী দুইজন পুত্রের জন্ম দিয়েছেন। তাহারা যমজ ভ্রাতা কুশলে আছে, তাহাদের মাতা বনদেবী নিজেও কুশলে আছেন।” সীতাদেবী দুই যমজ পুত্রকে ক্রোড়ে নিয়ে স্তন্যদান করলেন । আর ভাবলেন যদি এসময় তিঁনি অযোধ্যাতে থাকতেন, তবে কতই না আনন্দ হত। রঘুবীর দুই পুত্রকে দেখতে পেলেন না, ক্রোড়ে নিলেন না- ইহা ভাবতেই সীতাদেবীর অশ্রু নির্গত হল । আহা অযোধ্যায় থাকলে এই সময় গোটা রাজ্য আনন্দে মেতে উঠতো। পুত্রদের মস্তকে হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগলেন । আর অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন । মনে মনে প্রার্থনা করলেন- “স্বামী আপনি আপনার দুই পুত্রকে আশীর্বাদ করুন। তাহারা যেনো আপনার নাম উজ্জ্বল করতে পারে। রঘুবংশের মান গরিমা বজায় রাখতে পারে। তারা যেনো আপনার ন্যায় শক্তিমান, নীতি পরায়ণ হতে পারে।”
( ক্রমশঃ )
সূর্য উদয়ের সাথে সাথে শত্রুঘ্ন যুদ্ধযাত্রার জন্য প্রস্তুত হলেন। শ্রুতকীর্তি প্রভাতে কুলদেবতা সূর্যনারায়ণের পূজা করে শত্রুঘ্ন এর কপালে বিজয় তিলক দিলেন। হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে মঙ্গল কামনা ও যুদ্ধ জয়ের প্রার্থনা জানালেন । পুস্প দ্বারা পূজা ও মঙ্গল প্রদীপ দিয়ে আরতি করলেন। এরপর বিদায় জানালেন। শত্রুঘ্ন তিন মাতার চরণে প্রনাম জানালে মাতারা বিজয়ী হবার আশীর্বাদ দিলেন । এরপর দুই অগ্রজের আশীর্বাদ নিয়ে ভগবান শ্রীরামের চরণে প্রণাম জানালেন । ভগবান শ্রীরাম তখন নারায়নাস্ত্র শত্রুঘ্ন কে দিয়ে বললেন- “শত্রুঘ্ন! এই অস্ত্র গ্রহণ করো। এই অস্ত্রের খুবুই বিধ্বংসী ক্ষমতা। ত্রিলোক ধ্বংস করে দিতে পারে এই অস্ত্র । এই অস্ত্রকে খুবুই সাবধানতার সহিত প্রয়োজন পড়লেই ব্যবহার করবে, অন্যত্থায় নয় । বিজয়ী হয়ে আসো। আমি তোমার বিজয়ের জন্য ভগবান শঙ্করের কাছে প্রার্থনা জানাবো। লবণ কে বধ করার পর তুমিই হবে মথুরার রাজা। সেখানে ন্যায়- নীতি- ধর্ম প্রতিষ্ঠা করবে। আমি তোমাকে মথুরার রাজা রূপে অভিষিক্ত করলাম।”
এক লক্ষ রথ নড়ে এক লক্ষ হাতী ।
এক লক্ষ ঘোড়া নড়ে পবনের গতি ।।
লবণে মারিতে বীর করিল সাজনি ।
শত্রুঘ্নের নিজ বাদ্য, সাত অক্ষৌহিণী ।।
লিখনে না যায় ঠাট কটক অপার ।
শুনিয়া বাদ্যের শব্দ লাগে চমৎকার ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )
সাত অক্ষৌহিণী সেনা নিয়ে শত্রুঘ্ন চলল। তুরী- ভেরী- দুন্দুভি- ন্যাকরা- বাঁশী- ঢাক- ঢোল- করতাল আদি বাদ্য বাজতে লাগলো। ধনুর্বাণ, গদা, তরবারি, শত শর ভর্তি তূন, তীক্ষ্ণ বর্শা, ঢাল, খড়্গ ইত্যাদি ঘাতক অস্ত্র ধারণ করে শত্রুঘ্ন রথে উঠলেন । ধ্বজ উত্তোলিত হল চারপাশে । সকলে শ্রীরামের জয়ধ্বনি করলেন। একে একে সাত অক্ষৌহিণী কটক বের হল। হস্তী গুলি মেদিনী কাঁপিয়ে প্রচণ্ড গর্জন করে চলতে লাগলো। অশ্ব গুলি ধূলা উড়িয়ে চলল। রথ, পদাতিক সেনা সকল ঘাতক অস্ত্র উচিয়ে শ্রীরামের জয়ধ্বনি করতে করতে বের হল ।
ধীরে ধীরে শত্রুঘ্ন বাল্মিকী মুনির আশ্রমের দিকে আসলো। বাল্মিকী মুনিকে দর্শন করে আশীর্বাদ নেবে ভাবল। এখানে যে সীতাদেবী আছেন তাহা জানতেন না শত্রুঘ্ন । অপরদিকে সীতাদেবীর গর্ভ যন্ত্রনা আরম্ভ হল। প্রসব বেদনায় সীতাদেবী কাতর হলেন । ধাইমা, কাবেরীদেবী ও আশ্রমের কন্যারা সীতাদেবীর সেবা করতে লাগলেন । আগত হল সেই সময় যখন শ্রীরামের সন্তান ভূমিষ্ঠ হবেন । শ্রাবনের পূর্ণিমা তিথি সেইদিন । অবশেষে এলো সেই সময়। সীতাদেবী প্রবল যন্ত্রনা সহ্য করে শ্রীরামের প্রথম পুত্র সন্তান কে জন্ম দিলেন। কিন্তু তখনও প্রসব বেদনা দূরীভূত হয় নাই। কিছু ক্ষণ করে পুনঃ সীতাদেবী অপর একটি পুত্রের জন্ম দিলেন। ধাইমা নাড়ীচ্ছেদন করলেন। এবার প্রসব বেদনা দূরীভূত হল । সুন্দর উজ্জ্বল শিশু দ্বয়ের মুখ দেখে সকলে প্রসন্ন হল। দুই শিশুর রূপে যেনো ভুবন আলোকিত হয়ে আছে। অপূর্ব দিব্য ছিলেন তাহারা। অঙ্গ থেকে যেনো জ্যোতি নির্গত হচ্ছে। শঙ্খ ধ্বনি, উলু ধ্বনিতে মহর্ষির আশ্রম মুখরিত হল। কাবেরীদেবী এসে বললেন- “বনদেবী দুইজন পুত্রের জন্ম দিয়েছেন। তাহারা যমজ ভ্রাতা কুশলে আছে, তাহাদের মাতা বনদেবী নিজেও কুশলে আছেন।” সীতাদেবী দুই যমজ পুত্রকে ক্রোড়ে নিয়ে স্তন্যদান করলেন । আর ভাবলেন যদি এসময় তিঁনি অযোধ্যাতে থাকতেন, তবে কতই না আনন্দ হত। রঘুবীর দুই পুত্রকে দেখতে পেলেন না, ক্রোড়ে নিলেন না- ইহা ভাবতেই সীতাদেবীর অশ্রু নির্গত হল । আহা অযোধ্যায় থাকলে এই সময় গোটা রাজ্য আনন্দে মেতে উঠতো। পুত্রদের মস্তকে হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগলেন । আর অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন । মনে মনে প্রার্থনা করলেন- “স্বামী আপনি আপনার দুই পুত্রকে আশীর্বাদ করুন। তাহারা যেনো আপনার নাম উজ্জ্বল করতে পারে। রঘুবংশের মান গরিমা বজায় রাখতে পারে। তারা যেনো আপনার ন্যায় শক্তিমান, নীতি পরায়ণ হতে পারে।”
( ক্রমশঃ )
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন