১২ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব –১১)

অরণ্য প্রবেশ করলো শ্রী লক্ষ্মণের রথ। সীতাদেবী প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে লাগলেন । তিনি খুবুই প্রসন্না ছিলেন । অরন্যের শোভা চতুর্দিকে দেখে তাঁর মন প্রাণ আনন্দে ভরে গেলো । বৃক্ষের শাখায় শাখায় সুশোভিত পুস্প দেখলেন। তাহার মিষ্ট গন্ধে আমোদিত হয়ে আছে সমগ্র কানণ । ফুলে ফলে শোভিত সেই অরন্য অতীব শোভা বিস্তার করেছিলো। সেই অরন্য নানান পুস্প সুবাসে অতি মনোহর পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলো। মধু ভরা পুস্প গুলিতে ভ্রমর ভ্রমরী গুঞ্জরন করে মধু পান করছিলো। নানা রঙ্গে রঙ্গীন প্রজাপতি পেখম মেলে পুস্প হতে পুস্পে গমন করতে লাগলো। অতীব সৌন্দর্যময় সেই বনে প্রাকৃতিক শোভা চিত্ত আকর্ষিতের ন্যায় নিজেকে সুন্দর করেছিলো । ফুলে ঢাকা তরু শাখায় বৃহঙ্গ যুগল সুমধুর ধ্বনিতে ভরিয়ে তুলেছিলো। ঝর্না হতে পতিত সলিল ধারা স্রোতের নিজস্ব কলতানে প্রকৃতিকে আরোও প্রাকৃতিক শোভা প্রদান করিতেছিল । সেই অরণ্যের মাটি ও চলার পথ সবুজ তৃন ও বৃক্ষ হতে পতিত কোমল পুস্পে নিজেদের সাজিয়েছিলো। নিদারুন ছায়াভরা চলার পথে মিষ্ট সুগন্ধে ভরা শীতল বাতাস খেলা করছিলো। নানা রকম পুস্প বৃক্ষ হতে সীতাদেবীর ওপর ঝরে পড়ছিলো। লক্ষ্মণ অশ্রু বিসর্জন করতে করতে রথ চালনা করে যেতে লাগলেন। লক্ষ্মণ ভাবতে লাগলেন কিভাবে সেই দেবীকে এইসব কথা বলবে যে- শ্রীরাম কর্তব্য পালনের জন্য তাঁকে ত্যাগ করেছেন । সীতাদেবী বললেন- “ভ্রাতা লক্ষ্মণ! তুমি কেন এত স্তব্ধ মূর্তির ন্যায় হয়ে রথ চালনা করছ? কেনই বা তুমি এই সুন্দর প্রকৃতিকে দর্শন করছ না ? এরূপ তোমাকে ইত পূর্বে কদাপি দেখি নাই।” সত্যই লক্ষ্মণ নিশ্চুপ হয়ে ছিলো। কিভাবে সে উত্তর দেবে কিছুই বুঝতে পারলেন না ।

লক্ষ্মণ বলল- “বৌঠান! আপনি অরন্য দেখুন। আমি এখন কেবল সারথি। রথ চালানোই আমার ধর্ম । যেরূপ সারথি নিজের কষ্ট ভুলে কেবল রাজার আজ্ঞা মেনে অবিরত রথ চালান, আমিও সেইরূপ।” লক্ষ্মণের চোখের অশ্রু সীতাদেবী প্রত্যক্ষ করেন নি। ধীরে ধীরে লক্ষ্মণ রথ নিয়ে শ্রীরামের আদেশ মতো তমসা নদীর তীরে মহর্ষি বাল্মিকীর তপোবনে প্রবেশ করলো। সেই স্থানে অতি মনোহর পরিবেশ দেখলেন। ফুলে ফলে শোভামান বৃক্ষ রাশি, ঠাণ্ডা ছায়া ভরা অরণ্য চতুর্দিকে, শীতল জলে ভরা সরোবরে হংস হংসী জলকেলি, পক্ষীর মধুর কলরব প্রত্যক্ষ করলেন। সীতাদেবী রথ থেকে নেমে এলেন। বললেন- “লক্ষ্মণ! তোমার চোখে অশ্রু কেন ভ্রাতা? বুঝেছি তুমি কর্তব্যপরায়ণ । তোমাকে আমার কারণেই কর্তব্য ছেড়ে বনে আসতে হল। এতে তুমি তোমার অগ্রজের সেবা করতে পারছো না। তাই বুঝি আমার ওপর অভিমান বশত রোদন করছ। ঠিক আছে লক্ষ্মণ আমি খানিকক্ষণ বণ ভ্রমণ করে পুনঃ তোমার সাথে অযোধ্যায় প্রস্থান করবো। সত্যই অযোধ্যা থেকে বড় দূরে এসে পড়েছি।” এই বলে সীতাদেবী বনে খানিকক্ষণ ঘুরলেন । পুস্প লয়ে সুগন্ধ গ্রহণ করলেন। মিষ্ট ফল সংগ্রহ করলেন । বনে আপন মনে গুনগুন করে মধুর সুরে গাইলেন। তারপর পুনঃ এসে রথে উঠতে চাইলে লক্ষ্মণ মানা করে বলল- “বৌঠান! আপনাকে আমি অযোধ্যা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবো না। আমার অগ্রজ নয়, স্বয়ং অযোধ্যার রাজা শ্রীরামচন্দ্রের এই আদেশ।” সীতাদেবী প্রথমে ভাবলেন লক্ষ্মণ পরিহাস করছেন। কিন্তু লক্ষ্মণ বলল- “বৌঠান এ আমার পরিহাস নয়, এ অদৃষ্টের পরিহাস। আর সেই পরিহাসের বলি হই আমি আপনি আর আমাদের মতো সাধারণ মানবেরা।”

এই বলে লক্ষ্মণ ক্রন্দন করতে লাগলেন । সীতাদেবী এই কথা শ্রবণ করে মূর্ছা গেলেন। পরে চেতন ফিরে পেয়ে বললেন- “কি আমার অপরাধ ? কি এমন করেছি যে আমাকে গর্ভবতী অবস্থায় উনি ত্যাগ করলেন?” লক্ষ্মণ বলল- “বৌঠান! বিধাতা সহস্র বছর আপনার জীবনচরিত বারংবার পর্যবেক্ষণ করেও একটি অপরাধও বের করতে পারবেন না। আপনি নির্দোষ, আপনি রঘুকুলের কুলবধু যারা কিনা নিজের সংসার ভাসিয়ে দিয়েও প্রজার দাবী পূর্ণ করেন, আপনি সতী শিরোমণি উপরন্তু আপনি একজন নারী- এটাই আপনার অপরাধ । যুগে যুগে সমাজ, ধর্ম এইভাবেই নারীদের দণ্ড দেয়। আর একে আজ স্বীকৃতি দিলেন স্বয়ং অযোধ্যার সম্রাট শ্রীরামচন্দ্র। আমার অগ্রজ রূপেও নয়, আপনার স্বামী রূপেও নয়- রাজা হিসাবে কর্তব্য করেছেন উনি। কারন অযোধ্যার লোকেরা আপনাকে অসতী জ্ঞান করে। কারণ আপনি লঙ্কায় দশমাস বন্দিনী ছিলেন। তাই আপনাকে ত্যাগ করার দাবী গোপোনে জানাতে থাকে। আর মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র সেটাই করলেন ।” এই শুনে সীতাদেবীর দুচোখ দিয়ে শ্রাবনের ধারা নেমে এলো। বুকে কে যেনো প্রস্তরের ভার স্থাপন করে দিলো। চতুর্দিকে অন্ধকার দেখলেন তিনি। কানে যেনো সহস্র বজ্রপাত হল। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। লক্ষ্মণ বলল- “বৌঠান! কখনো কখনো আমি ভাবি এই রঘুকুলের রাজারা সত্যই কি মহান? প্রজাদের দাবী মানতে গিয়ে নিজের সংসার ভাসিয়ে দিচ্ছেন। গৃহে থাকা একজন স্ত্রী, সন্তানের কথাও ভাবছেন না। এ কেমন দায়িত্ব- যে নির্দোষ গর্ভবতী নারীকে ত্যাগ করতে শেখায়। যে অত্যাচার করে সেই রাবণের মতো পুরুষদের কেন সমাজ ত্যাগ করতে বিধান দেন না, কেনই বা সেই সকল লাঞ্ছিতা নারীদের ত্যাগ করতে বলা হয়? আমি নিজেও আজ এই অন্যায়ের সমান ভাগীদার। বৌঠান আমাকে ক্ষমা করবেন না। আমাকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করে জগতে নারীজাতির জন্য অধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করুন।”

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।