২৫ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব –৩৪ )

বাল্মিকী মুনির আশ্রমের তপোবনের সম্মুখে কচি কচি তৃণ ভক্ষণ করতে করতে অশ্ব একেবারে লব কুশের সামনে চলে গেলো। এত সুন্দর অশ্ব দেখে আশ্রমের বালকেরা অবাক হল। সেই স্থানে কেবল ছোটো ছোটো বালকেরা খেলা করছিলো। লব ও কুশ এসে অশ্ব চিনতে পারলো। ইহা সেই মহারাজ শ্রীরামচন্দ্রের অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব । দুই ভ্রাতা একত্রে ফন্দী আঁটলো। যুক্তি করে অশ্ব ধরল। বলল- “ইহা সেই কর্তব্য পরায়ণ নির্দয় মহারাজের অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব। যিঁনি কর্তব্য পালনের জন্য সতী নারী স্ত্রীকে ত্যাগ করেছেন। এবার ওঁনাকে এই অশ্বের মারফৎ এনে পরাস্ত করতে হবে।” আশ্রমের অনান্য বালকেরা অশ্ব দেখে তাহার পৃষ্ঠে, মস্তকে হস্ত বুলিয়ে দিতে লাগলো। এত সুন্দর অশ্ব তাহারা কেহই দেখেনি । লব ও কুশ লতা পাতা দ্বারা অশ্বকে লাগাম পড়িয়ে বৃক্ষের সাথে বেঁধে রাখলো। অশ্বের কপালে জয়পত্র লেখা দেখে দুভ্রাতা বলল- “এবার দেখবো কে আমাদের পরাজিত করে অশ্ব নিয়ে যায়।” অপরদিকে অয্যোধ্যার সেনারা ফিরতে প্রস্তুত হলে দেখা গেলো অশ্ব নেই। খোঁজবিন পড়লো। অশ্ব গেলো কোথায়। কেহ ভাবল অশ্ব না জানি গভীর বনে চলে গেছে, কেহ বলল ব্যাঘ্রে নিয়ে যেতে পারে। শত্রুঘ্ন সমস্ত কিছু শুনে সেনাদের ধমক দিয়ে অশ্ব খুঁজতে বলল। বলিল- “শীঘ্র অশ্ব খুঁজে আনো। সেই অশ্ব বিনা অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পূর্ণ হবে না। অসমাপ্ত যজ্ঞে মহারাজ শ্রীরামচন্দ্রের নামে কলঙ্ক লেপন হবে। দেবতারা রুষ্ট হবেন । এই স্থানে কোন রাজা নেই যে অশ্ব ধরবার দুঃসাহস করবে। নিশ্চয়ই অশ্ব গভীর বনে গেছে।” সেনারা খুঁজতে খুঁজতে সেই মুনির তপোবনে আসলো। লব , কুশ কে দেখে বলল অশ্ব ফিরিয়ে দিতে। লব ও কুশ ত নারাজ । বলিল- “মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র আসুন। তাঁর সহিত আমরা যুদ্ধ করবো। যদি তিঁনি বীর হন, তবে আমাদের পরাজিত করে অশ্ব নিয়ে যেতে পারেন।” সেনারা অনেক বুঝিয়ে বিফল হয়ে ফিরে এলো।

অপরদিকে মাতা সীতাদেবী, তিঁনিও কিছু জানতেন না। তিঁনি এসে পুত্রদের বললেন- “বাছা। আমি দুর্গা দেবীর ব্রত আরম্ভ করেছি। তোমরা শীঘ্র নীল কমল সংগ্রহ করে আনো।” লব কে প্রহরায় রেখে কুশ পদ্ম আনতে চলল। অপরদিকে শত্রুঘ্ন শুনে হাস্য করলো যে দুই তপস্বী বালক অশ্ব ধরেছে। শত্রুঘ্ন সেনা সমেত চলল। গিয়ে দেখলো এ সেই বালক, যারা অযোধ্যায় রামায়ন গান শোনাতে এসেছিলো। শত্রুঘ্ন বলল- “বালক। তুমি সেই, যাঁর কণ্ঠে দেবী বীণাপাণি বিরাজ করেন। নিশ্চয়ই তুমি ও তোমার ভ্রাতাই এই অশ্ব ধরেছে। তোমার ভ্রাতা কোথায় ? শোনো। শীঘ্র অশ্ব ফিরিয়ে দাও। আমি তোমাদিগকে অনেক ধন রত্ন অলঙ্কার প্রদান করবো। এই যজ্ঞের অশ্ব নিয়ে আমাকে এখন অযোধ্যা ফিরে যেতে হবে।” লব বলল- “আমি বনবাসী। ধন রত্নে কিবা প্রয়োজন! যতক্ষণ মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র নিজে না আসবেন, এই অশ্ব আমি ফিরিয়ে দেবো না। আপনি গিয়ে মহারাজ শ্রীরামচন্দ্রকে বলুন এখানে এসে অশ্ব নিয়ে যান। আপনি এখন প্রস্থান করুন।” শত্রুঘ্ন অনেক বোঝালো। লোভ প্রদর্শন করল। কিন্তু লব নারাজ । শত্রুঘ্ন ক্রুদ্ধ হয়ে বলল- “বালক! তুমি এতটা যোগ্য না যে মহারাজ শ্রীরামচন্দ্রের সাথে যুদ্ধ করবে। তুমি বোধ হয় অশ্বমেধ যজ্ঞের নিয়ম জানো না। যে অশ্ব ধরার দুঃসাহস করে, সে মিত্রতা গ্রহণ না করলে তাকে যুদ্ধে পরাজিত করাই এই যজ্ঞের নিয়ম। তুমি বালক। তোমার ওপর অস্ত্র নিক্ষেপ করলে নিজ বীরত্বের অপমান হবে। অন্তিম বার বলছি অশ্ব ফিরিয়ে দাও।” লব বলল- “তবে যুদ্ধই হোক!” অয্যোধ্যার সেনা বাহিনী সকল ছুটলে লব শিলা বাণ নিক্ষেপ করলো। প্রচণ্ড গর্জন করে শিলাবাণ ঊর্ধ্বে উঠে শত শত বৃহৎ শিলায় রূপান্তরিত হয়ে শত শত শিলা অয্যোধ্যার সেনাবাহিনীর মধ্যে পড়তে লাগলো। দেখতে দেখতে বৃহৎ হস্তী সকল ভূপতিত হল। রথ গুলি চূর্ণ হল। অশ্ব গুলি প্রস্তর চাপা পড়ে পিষ্ট হল। এত ক্ষতি দেখে শত্রুঘ্ন অবাক হল। অবাক হয়ে বালকের সাথে যুদ্ধ আরম্ভ হল।

বালকের দিকে নানা দিব্যাস্ত্র নিক্ষেপ করতে লাগলো। লব নানান দিব্যাস্ত্রে সেই সকল অস্ত্র চূর্ণ করলো। হঠাত লবের ধনুকের ছিলা ছিঁড়ে গেলো। সেই সময় শত্রুঘ্ন পাশবাণ নিক্ষেপ করে লব কে বন্দী করলো। সেনাদের বলল- “ইঁহাকে বন্দী করে যজ্ঞ অশ্ব নিয়ে অযোধ্যায় চলো। নিয়ম মতোন বন্দী করেই নিতে হয়। এই বালক সত্যি বীর ছিলো।” এই বলে শত্রুঘ্ন লবকে রথে তুলে অশ্ব নিয়ে চলল। অপরদিকে কুশ এসে সীতাদেবীকে পদ্ম সকল দিয়ে সেই স্থানে এসে দেখে অশ্ব ও লব নেই। আশ্রমের বালকেরা জানালো সব ঘটনা । কুশ তখন “আকর্ষণী বাণ” নিক্ষেপ করলো। সেই বাণ ছুটে গিয়ে শত্রুঘ্ন তাহার সেনা, যজ্ঞের অশ্ব সব কিছুকে আকর্ষণ করে সেই স্থানে নিয়ে এলো। সকলে অবাক হল। কেউ যেনো পেছন থেকে প্রবল আকর্ষণে নিয়ে এসেছে । কুশ বলল- “মথুরা নরেশ। এই আপনার বীরত্ব যে অস্ত্রহীন বালক কে বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছেন। এবার আমার বীরত্ব দেখুন।”বলে কুশ সবার প্রথমে লবকে পাশ মুক্ত করে উদ্ধার করলো। লব নিজ ধনুকে পুনঃ ছিলা জড়ালো। দুভ্রাতা ধনুক থেকে এত বাণ নিক্ষেপ করলো যেনো সেই সকল বাণ জলন্ত উল্কাপিন্ডের ন্যায় অযোধ্যার সেনার ওপর আছ্ড়ে পড়লো। হূলস্থূল পড়ে নিমিষে অযোধ্যার সেনা সকল নাশ হতে লাগলো। বীর শত্রুঘ্ন যক্ষবাণ, কালপাশ, বজ্রবাণ, মরুতবাণ নিক্ষেপ করলেন। লব ও কুশ গন্ধর্ববাণ, মহাপাশ, ইদ্রাস্ত্র, সূর্যবাণ নিক্ষেপ করলেন। দেখতে দেখতে শত্রুঘ্নের অস্ত্র গুলি চূর্ণ হল। লব ও কুশ বলল- “এই আপনার বীরত্ব ? কিভাবে এই সামান্য বল নিয়ে আপনি লবণ অসুরকে নাশ করেছিলেন ?” এই বলে লব কুশ বাণ দ্বারা শত্রুঘ্নের রথের দুই চক্র, ধ্বজা কেটে দিলেন । অশ্ব ও সারথি দিগকে বধ করলেন । বাণে বাণে এমন বিদ্ধ করলেন যে শত্রুঘ্ন নিদারুন ক্ষতবিক্ষত হয়ে মূর্ছা গেলো ।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।