১২ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব- ৪১ )

রাবণের আদেশে রাক্ষসেরা সমানে বানর, ভল্লুক, মর্কট দের বধ করতে লাগলো। লক্ষ লক্ষ রাক্ষসেরা বানর দলের দিগে আগুনের গোলা নিক্ষেপ করতে লাগলো। বানর সেনাদলে হাহাকার আর ক্রন্দন উঠলো। রাবণের নিক্ষেপিত দিব্যাস্ত্রের তাণ্ডবে মনে হল যেনো বসুমতী আজ সপ্ত পাতাল তলে নিমজ্জিত হবে। দিব্যাস্ত্র সকল প্রভাবে চতুর্দিকে অন্ধকার নেমে এলো আবার কখনো বা শত সূর্যের ন্যায় আলোকিত হয়ে উঠলো। এই সকল ঘাতক অস্ত্রের প্রভাবে সমুদ্রে উথালপাতাল অবস্থা হল । বানরেরা ছিন্নভিন্ন হয়ে চতুর্দিকে পড়তে লাগলো । রাবণ “শত্রুঘাতী” নামক রথ সকলকে নিজের চারেপাশে রেখেছিলো। এই সকল রথের চাকার সাথে অগণিত শর ছিলো। যখন অশ্বের আকর্ষণে এই রথের চক্র ঘুরতো, তখন এই শর গুলি চতুর্দিকে ছুটে যেতো। তাই এই রথ গুলি বানর সেনার মধ্যে যখন চলছিল, তখন বানর দের ছিন্নভিন্ন শব ও রক্ত ভিন্ন কিছুই দেখা যাচ্ছিল্ল না। কারণ তীক্ষ্ণ শরের সামনে কেউ টিকতে পারলো না । হনুমান ও অঙ্গদ মিলে প্রবল বিক্রম দেখালো। গদা প্রহারে রাক্ষস দের চূর্ণ করলো। লেজে পেঁচিয়ে আছার দিলো। পদতলে পিষ্ট করলো। বানরেরা সমানে প্রস্তর, বৃক্ষ নিক্ষেপ করে রাবণের রাক্ষস সেনাদের পিষ্ট করে দিলো। ক্রোধে উন্মত্ত রাবণ একের পর এক দিব্যাস্ত্র সকল ছুড়তে লাগলো। তাঁর অট্টাহস্যে দিগবিদিক কেঁপে উঠলো। রাবণের মদমত্ত হস্তী গুলি বানরদের শুণ্ডে তুলে ভূমিতে আছার দিলো। কাউকে পদ চাপে পিষ্ট করলো। রক্ত রক্তময় হল চতুর্দিক। এই দেখে বানরেরা হস্তীগুলির দিকে পর্বত শৃঙ্গ তুল্য প্রস্তর নিক্ষেপ করতে লাগলো । বিশাল বিশাল প্রস্তর আকাশ হতে হস্তী গুলির ওপর ঝড়ে পড়লো। হস্তী সহিত প্রস্তর গুলি যখন ভূমিতে পড়লো বারংবার ভূকম্পের ন্যায় কেঁপে উঠলো

। রাবণের রথ গুলি থেকে রাক্ষসেরা অগণিত বর্শা ও শর বানরদের দিকে নিক্ষেপ করতে লাগলো। লক্ষ লক্ষ বানর হতাহত হলে, ভল্লুকেরা তীব্র গর্জন করে ছুটে গেলো । ভল্লুকেরা গিয়ে প্রবল গর্জন করে রাক্ষস দের ওপর লম্ফ দিয়ে পড়ে আঁচর, কামড় বসাতে লাগলো । রথ গুলি তুলে তুলে আছরে ভূমিতে ফেলল। স্বর্ণ রথের টুকরো তে মেদিনী ঢাকা পড়লো । ভল্লুকদের থাবায় হতাহত হয়ে ভূমিতে শায়িত হল রাক্ষসেরা। চতুর্দিকে কেবল বানর ও রাক্ষসদের শব ভিন্ন কিছু দেখা গেলো না । সমুদ্র তট যেনো বালিকার বদলে শবদেহ দ্বারা রচিত হয়েছিলো । রাবণ তখন নানা দিব্যাস্ত্রে ভল্লুক দের নষ্ট করতে লাগলো। মণিমুকুট বাণ নিক্ষেপ করলো রাবণ। সেই অস্ত্রের থেকে লক্ষ লক্ষ জলন্ত শেল উৎপন্ন হয়ে ভল্লুকদের বুকে আঘাত হানলে, ভল্লুকেরা রক্তবমি করতে করতে মরল। লক্ষ্মণ এই দিকে এগিয়ে এলো। তাঁর সাথে আসলেন ভগবান শ্রীরাম । লক্ষ্মণ তখন বললেন- “ওরে তস্কর! ওরে মায়াবী! আয় আমার সহিত যুদ্ধ কর। কেন এই নীরিহ সেনাদের বধ করছিস?” রাবণ ক্রোধে বললেন- “ওরে লক্ষ্মণ! আমি তোকেই খুঁজে চলছি। তোকে দেখা মাত্রই আমার মনে পুত্র হারানোর শোক ও তার দরুন ক্রোধ উৎপন্ন হচ্ছে।” এই বলে রাবণ কালবাণ নিক্ষেপ করলেন। ভয়ানক শব্দ সহিত সেই অস্ত্র ছুটে আসতে দেখে লক্ষ্মণ হাস্য করে যমাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। দুটি অস্ত্রের প্রবল সংঘর্ষ হল। ক্রোধে রাবণ অর্ধচন্দ্র, বিনাশক, খড়্গ বাণ নিক্ষেপ করলেন। লক্ষ্মণ চোখের নিমিষে সূর্যবাণ, বজ্রবাণ, বায়ব্যবাণ নিক্ষেপ করলেন। দুজনের নিক্ষিপ্ত বাণ দুজনের দিকে ধেয়ে আসতে লাগলো। দিব্যাস্ত্র সকলের মুখোমুখিতে যেন জগত কাঁপতে লাগলো। দেখতে দেখতে রাবণের অস্ত্র সকল ধূলিসাৎ হল। তখন রাবণ লক্ষ্মণের দিকে শেল নিক্ষেপ করলে লক্ষ্মণ মূর্ছিত হল। হনুমান এসে তাঁহাকে ধরে শিবিরে নিয়ে গেলেন ।

এরপর বিভীষণ রাবণকে বললেন- “অগ্রজ! তুমি মন্দবুদ্ধি । তুমি অধর্মের আশ্রয় করে এতই দাম্ভিক হয়ে উঠেছো যে প্রভুর ভ্রাতাকে আঘাত করে সকল সীমা অতিক্রম করেছো। আজ আমি তোমার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবো।” এই বলে বিভীষণ গদা নিয়ে ধেয়ে গেলো। গদা প্রহারে রাবণের অনুগত রাক্ষসদের হত্যা করতে করতে রাবণের দিকে এগিয়ে গেলো। ভগবান রাম বললেন- “মিত্র বিভীষণ! তুমি আর অগ্রসর হয়ো না। এ রাবণের মায়া। সে তোমাকে বন্দী করবে। দেখো রাক্ষসেরা কিরূপে তোমাকে বুহ্যজালে নিয়ে যাচ্ছে।” বিভীষণ সমানে রাক্ষসদের অন্ত করতে করতে রাবণের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল্ল । রাবণ হাসছিল। কিন্তু শ্রীরাম হনুমান ও অঙ্গদ সহিত সামনে এগিয়ে গেলো। ভগবান শ্রীরামের বাণে রাক্ষসরা ছিন্নভিন্ন হল। রাক্ষসদের রক্ত যেনো নদীর আকার নিয়ে যুদ্ধভূমিতে প্রবাহিত হল । এই ভাবে ভগবান শ্রীরাম রাক্ষসদের বুহ্য গুলি ধ্বস্ত করে দিলেন । বিভীষণ যখন অতি সন্নিকটে তখন রাবণ হাস্য করে বললেন – “দুষ্ট! বিশ্বাসঘাতক ! তোর মতো ভ্রাতাকে বাঁচিয়ে রাখলে ক্ষতি হবে।” এই বলে রাবণ তখন ভয়ানক শক্তিঅস্ত্র হস্তে নিলো। বিভীষণের দিকে ছুড়লো ।

আবত দেখি সক্তি অতি ঘোরা ।
প্রণতারতি ভঞ্জন পন মোরা ।।
তুরত বিভীষণ পাছেঁ মেলা ।
সম্মুখ রাম সহেউ সোই সেলা ।।
( তুলসীদাসী রামায়ণ )

সেই শক্তি অস্ত্র স্বয়ং মহাদেবের প্রদত্ত। সেই অস্ত্রের ঘাতে বিভীষণের মৃত্যু অনিবার্য । শরণাগতকে প্রভু শ্রীরাম নিজ জীবন বিপন্ন করেও রক্ষা করেন । ভগবান রাম তখন বিভীষণকে ধাক্কা দিয়ে সড়িয়ে , তার আগে দাঁড়ালেন । শক্তিঅস্ত্র এসে ভগবান রামের বুকে বিদ্ধ হল। ভগবান রাম অচেতন হয়ে ভূমিতে পড়লেন । সকলে দেখলো ভগবান রামের নবদূর্বাদল অঙ্গকান্তি রুধিরে লিপ্ত হয়েছে । বিভীষণ এই দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে রাবণকে বললেন- “ওরে মন্দবুদ্ধি! তুই মহা মূর্খ ও অতিশয় অধম । তুই সর্বদা মুনি, ঋষি, দেবতা, মানব দের সাথে যুদ্ধ করেই যাচ্ছিস? ব্রহ্মার বরে দশমুখ পেয়ে এত দম্ভ তোর কিসের? রামবিমুখ হয়ে সম্পদ ভোগ করতে চাস ? তোর কাল তোর শিয়রে উপস্থিত ।” এই বলে বিভীষণ গদা নিয়ে ধেয়ে গিয়ে রাবণের বক্ষে প্রহার করলো। সেই আঘাতে রাবণ রথ থেকে ভূমিতে পতিত হল। তাঁর রক্তবমি হতে লাগলো। রাবণ আশ্চর্য হল বিভীষণের এত শক্তি দেখে। এই সেই বিভীষণ- যাকে পদাঘাত করে লঙ্কা থেকে তাড়ানো হয়েছিলো। যাই হোক আঁধার নেম আসতেই সেদিনের যুদ্ধ থেমে গেলো। ভগবান শ্রীরাম চেতন পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। সেই শক্তি অস্ত্রে তাঁর কিছু হল না ।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।