১২ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব- ৪৩ )

পরদিনের কথা । শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ বানর সেনা সহিত অপেক্ষা করছিলেন। রাবণ পুনঃ অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সেনা নিয়ে যুদ্ধে আসলো। লঙ্কার দ্বার খুলতেই ভীমকায় হস্তী সকল বের হল। শুণ্ড তুলে দিগবিদক কাঁপিয়ে গর্জন করে হস্তীগুলি ধেয়ে এলো। হস্তীগুলি মর্কট, বানর দের পিষে বালুকার সাথে মিশিয়ে দিলো। আবার কাউকে শুঁড়ে তুলে সমুদ্রে নিক্ষেপ করলো। তাহাদিগকে সামুদ্রিক মাংসাশী প্রানী ভক্ষণ করলো। হস্তী গুলির ওপর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বর্শা আর শর ছুটে এসে বানরদের ছিন্নবিছিন্ন করলো। প্রতিশোধ স্পৃহায় রাবণ রাবন বানর দলের দিকে অতি সাংঘাতিক সকল দিব্যাস্ত্র ছুড়তে লাগলো। বড় বড় বানর বীরেরা মাটিতে মুখ থুবরে পড়ে হত হল। দিব্যাস্ত্র সকল প্রভাবে এক দুর্যোগ বয়ে আনলো। ভগবান শ্রীরামের সাথে রাবণের যুদ্ধ হল। ভগবান শ্রীরাম নানা দিব্যাস্ত্র সকল নিক্ষেপ করতে লাগলেন । ময়ুরাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু পুনঃ আবির্ভূতা হলেন ভদ্রকালী। ভীষণা জিহ্বা দ্বারা রাবণকে এমন ভাবে ঢেকে দিলেন যে কোন অস্ত্রই আর রাবণ কে স্পর্শ করলো না। রাবণ সেই জিহ্বার আড়াল থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বাণ নিক্ষেপ করলে বানর সেনাদলে হাহাকার উঠলো। বিধ্বংস হয়ে যেতে লাগলো কপি কটক । নল- নীল- কুমুদ- গয়- গবাক্ষ- সুগ্রীব- অঙ্গদ সকলে পলায়ন করলো। হনুমানের সমস্ত শরীরে শর বিঁধে রক্তময় হল। শ্রীরাম ও লক্ষ্মণের দেহেও বাণ বিঁধলো । সুগ্রীবের দলবলের অর্ধেক সেনা নাশ করলেন একাই রাবণ । সেদিনের যুদ্ধ শেষে রাবণ পুনঃ অট্টহাস্য করে লঙ্কায় চলে গেলো । ভগবান রাম ভাবলেন- “এ কি অবস্থা! ভগবতী সদয় থাকলে কি ভাবে বধ সম্ভব?” বিভীষণকে সব বললেন। বিভীষণ বলল- “প্রভু! এই সকল দেবীর কৃপা। আমার অগ্রজ বসন্ত ঋতুতে নিষ্ঠাচারে দেবী ভদ্রকালীর পূজা করেন । এই সকল তারই প্রভাব। দেবী যতদিন সদয় আছেন, ততদিন অগ্রজকে পরাস্ত করা যাবে না।”

এবার আসা যাক ‘অকাল বোধন’ সম্বন্ধে । অকাল বোধনের উল্লেখ বাল্মিকী রামায়ণ, তুলসীদাসী রামায়নে নেই। বাল্মিকী রামায়নে আছে ভগবান শ্রীরাম , রাবণ বধের পূর্বে ‘আদিত্য হৃদয়’ স্তব পাঠ করেছিলেন । কৃত্তিবাসী রামায়ণে ‘অকাল বোধন’ এর উল্লেখ আছে। উগ্র বৈষ্ণবেরা বলেন, কৃত্তিবাস জমিদার দের খুশী করার জন্য লিখেছিলেন এই ‘অকাল বোধন’ পর্ব । কৃত্তিবাস ওঝা যে সময়ের কবি ছিলেন সেই সময় ভারতবর্ষে জমিদারী প্রথা ছিলো না। কারণ ঐতিহাসিকদের মতে ভারতে জমিদারী ব্যবস্থা প্রবর্তন হয় মোগল দের হাত ধরে। মোগোলদের রাজধানী ছিলো দিল্লী। সুদুর বঙ্গে তাদের কর আদায় সম্ভব ছিলো না বলে- আঞ্চলিক গৌড়ের সুলতানের ওপর নির্ভর করতেন। গৌড়ের সুলতান এই সব জমিদার দের থেকে কর নিতেন- জমিদারেরা প্রজার থেকে। ইংরেজ আমলে ব্রিটিশ সরকার আস্তে আস্তে জমিদারী ব্যবস্থার বিলোপ করেন । কৃত্তিবাসের জন্ম ১৩৮৬- ১৩৯৮ এর মধ্যে । কৃত্তিবাসী রামায়নে কালিকাপুরাণের অনেক কিছু এ্যাড করা হয়েছে । যেমন মহীরাবণ প্রসঙ্গ । কিন্তু শ্রীরামচন্দ্রের দুর্গা পূজার কথা কালিকাপুরাণে নেই । তাহলে কৃত্তিবাস ওঝা এই সোর্স কোথার থেকে পেলেন ? কোন এক সময় কি রামচন্দ্রের দুর্গা পূজার কথা কি ‘কালিকা পুরাণ’ বা ‘বৃহৎ ধর্ম পুরাণ’ এ ছিলো ? একটু খেয়াল করুন দেখবেন যে জন্মসূত্রে ভগবান শ্রীরাম ছিলেন ক্ষত্রিয় আর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন বৈশ্য । আর বৈদিক পরবর্তী যুগ থেকে বর্ণাশ্রম প্রথা বংশকেন্দ্রিক হয়ে যায়। জন্মসূত্রে পৈতেধারীর সন্তান ব্রাহ্মণ বলে কথিত হয় আর চণ্ডাল- ডোমের ছেলে শুদ্র বলে অবহেলিত থাকে । এইসময় একজন ক্ষত্রিয় নিজে দুর্গা পূজা করছেন – এটাকে সমাজে চলতে দিলে সকলেই পূজার অধিকার দাবী করতেই পারতো। দুর্গা পূজাকে স্মার্ত পূজা বলা হয়। স্মৃতিবাদী ব্রাহ্মণ ছাড়া কেউই এই দুর্গা পূজা করতে পারবে না বলে বলা হয়। স্মৃতি শাস্ত্রে কি লেখা আপনারা ত সকলেই জানেন। সেখানে কঠোর ভাবে বংশকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে । সুতরাং একজন ক্ষত্রিয় দুর্গা পূজা করছেন দেখে- সকলেই করতে পারবেন এতে বর্ণাশ্রম নষ্ট হবে দেখে হয়তো ‘কালিকাপুরাণ’ বা ‘বৃহৎ ধর্ম পুরাণ’ থেকে এই অধ্যায় মুছে ফেলা হয়েছে। অসম্ভব কিছুই নেই। কারন এই সমস্ত পুরাণ বহুযুগ আগে লেখা। বর্ণাশ্রম বাদীরা বলেন রামচন্দ্র নিজের হাতে দুর্গা পূজা করেন নি, রাবণকে দিয়ে করিয়েছেন । রাবণ জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ, পুলস্তের বংশজ । ভাবুন তো, ধর্মাত্মা বিভীষণ থাকতে , ব্রহ্মার পুত্র জাম্বুবান থাকতে- ভগবান শ্রীরাম পাপাত্মা রাবণকে দিয়ে কেন পূজা করাবেন ? আর রাবণ কেনই বা নিজের ধ্বংসের কাজ করবে ? মেঘনাদ, বীরবাহু, অতিকায়, নরান্তক এই সব রাবণের পুত্রেরা জন্মসুত্রে ব্রাহ্মণ- তাহলে ভগবান রাম কেনই ব্রহ্মহত্যা করবেন আর করতে উৎসাহ দেবেন ? বর্ণ নির্ধারণ হয় গুনে, বংশে নয়। ভগবান বিষ্ণু কেনই বা কশ্যপ মুনির বংশজ হিরন্যখ আর হিরণ্যকশিপুকে বধ করবেন ? যুক্তি দিয়ে ভাবলেই বর্ণাশ্রম বাদীদের তর্ক খন্ডন করা যায় । পুরাণে কতকিছু যে এ্যাড হয়েছে আর কতকিছু যে বাতিল হয়েছে তার হিসাব নেই। কিন্তু এইগুলি বেদব্যাসের নামেই চলে।

আপনারা যদি কেউ “শ্রীশ্রীচণ্ডী” পড়ে থাকেন, দেখবেন যে সেখানে আছে চণ্ডী শ্রবণের পর রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য নিজেরা দুর্গা মূর্তি বানিয়ে পূজা করেছিলেন । রাজা সুরথ ছিলেন জন্মসূত্রে ক্ষত্রিয় আর সমাধি বৈশ্য ছিলেন জন্মসূত্রে বৈশ্য । এঁনাদের পূজায় কিন্তু মেধামুনি পৌরহিত্য করেন নি। এঁনারা নিজেই পূজো করেছেন। দেবী সন্তুষ্ট হয়ে দর্শন দিয়েছিলেন। দেবীর কৃপায় রাজা সুরথ যবন রাজাদের পরাজিত করে নিজ রাজ্য উদ্ধার করেন, আর সমাধি বৈশ্য ইপ্সিত ব্রহ্মজ্ঞান দেবীর কাছে পেলেন- তিঁনিই যথার্থ ব্রাহ্মণ । দেখুন বংশ নয়- সাধনাতেই দেবীর কৃপা সম্ভব। সাধনা সবাই করতে পারে। আজকাল চণ্ডী সবাই পরে- কিন্তু এগুলি কেউই মনে রাখে না। এমনকি দুর্গা মূর্তি স্পর্শের অনুমতি নেই। পুরোহিত দশমীতে দর্পণ বিসর্জন করে দেন, তার পর আমরা দেবীর কাঠামো তে সিঁদুর দেই, মুখে মিষ্টি দেই । আর একটা কথা বলা উচিৎ - আমরা অনেকেই ভাবি যে পূজা অর্চনা করলেই বুঝি ভগবান সন্তুষ্ট হয়ে দর্শন দেবেন। এটা সম্পূর্ণ সত্যি নয়। মূর্তির সামনে পূজা করে, ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজিয়ে ছাপান্নো ভোগ দিলেই ভগবান মূর্তি ছেড়ে প্রকট হয়ে আপনার সামনে বসে ভোগ খাবেন না। এত এত মন্দিরে এখন এত পুরোহিত আছে- জিজ্ঞেস করবেন ত কজনের সামনে ভগবান প্রকট হন ? পূজা ধর্মাচরণের একটা অঙ্গ। ঈশ্বর লাভের জন্য সাধনা- ত্যাগ- সংযম – ব্রহ্মচর্য – নিষ্ঠা – উপাসনা দরকার । এইগুলো সবাই করতে পারেন । কেউ কেউ বলবেন শ্রীরামকৃষ্ণ , বামাখ্যাপার সামনে মা মূর্তি থেকে বের হয়ে ভোগ খেয়েছেন। হ্যাঁ এটা সত্য। কিন্তু ওঁনারা কিন্তু অনেক সাধনাও করেছেন । ঐরকম আকুলতা আমাদের কোথায় ? পূজার সময় কার ঐ রকম আকুলতা আসে ? সুতরাং পৈতেধারীরা পূজা করছে, আমরা পারলাম না, আমাদের ঈশ্বর দেখা দেবেন না- এমন ভাবার কারণ নেই । উপযুক্ত গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়ে সাধনা- উপাসনাতে ঈশ্বর আমাদের কাছেও আসবেন। শুধু পূজাতে ঈশ্বর দয়া করে দেখা দিলে তাহলে প্রতি মন্দিরেই ঈশ্বর আবির্ভূত হয়ে ভোগ খেতেন বর্তমান যুগে । সুতরাং কুল নিয়ে দম্ভ বা দুঃখের কারণ নেই । যেই ভাবে যেই অবস্থায় থাকুন না কেন, ঐ অবস্থায় ঈশ্বরের আরাধনা করা কর্তব্য । যাই হোক আলোচ্য প্রসঙ্গে আসি। ব্রহ্মা বোধন করেছিলেন দেবী দুর্গা দেবীর। এখনও দুর্গা পূজাতে সেই মন্ত্রই পাঠ হয় বোধনের সময়। ‘বৃহৎ ধর্ম পুরাণ’ এর সেই ঘটনা থাকবে আগামী পর্বে ।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।