২৫ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব- ৩৮)


শ্রীরাম সহ সেনারা যখন আসছিলেন, দেখতে পেলেন চতুর্দিকে কেবল অযোধ্যার সেনাদিগের ছিন্নবিছিন্ন দেহ পড়ে আছে। আর আছে খণ্ড খণ্ড হওয়া রথ, হস্তী, অশ্বের টুকরো। ধ্বজ, ছত্র তে মেদিনী ঢাকা পড়ে আছে। চতুর্দিকে ছিন্নবছিন্ন কেয়ুর, বাজু কীরিট নক্ষত্রের ন্যায় ভূমিতে পড়ে আছে । স্থানে স্থানে রক্তের সরোবর সৃষ্টি হয়েছে। এই সকল যে সামান্য দুই বালক করেছে- ইহা কেহই যেনো বিশ্বাস করবে না। মনে হয় যেনো এই স্থানে দেবরাজ ইন্দ্রের সেনার সহিত অসুরদের যুদ্ধ হয়েছে । শ্রীরামচন্দ্র গিয়ে সেই যুদ্ধ স্থানে দাঁড়ালেন । বালক দিগকে দেখে পুনঃ তিঁনি স্নেহাসক্ত হলেন । মনে হতে লাগলো বালক দিগকে ক্রোড়ে লইয়া অনেক স্নেহ প্রদান করি। বালক দিগকে দেখলে মন হতে সমস্ত ক্রোধ কর্পূরের ন্যায় উবে যায় । সেই মায়া ভরা বালক দের চাউনি দেখলে অন্তরে অন্তরে ইহাদের পুত্ররূপে পাইতে ইচ্ছা করে । এমনই ছিলো তাহারা। ইহাদের দেখিলে অস্ত্র চালনা করতে ইচ্ছা হয় না। এই ভেবে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র আপন পুত্রদের দেখতে লাগলেন । কিন্তু পিতা নাতো পুত্রকে চেনে, পুত্র নাতো পিতাকে চেনে । লব ও কুশ বলল- “হে মহারাজ শ্রীরাম আপনাকে প্রণাম জানাই। আমাদিগের অশেষ ভাগ্য যে আপনি যুদ্ধে এসেছেন । আপনার সাথে যুদ্ধ করা সৌভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু মহারাজ শ্রীরাম আপনি জগতের নিকট মর্যাদা পুরুষোত্তম রূপে কীর্তিত হলেও, যোগ্য পতি কদাপি হতে পারেন নি। আপনি কেন নির্দোষী সীতাদেবীকে ত্যাগ করলেন ? কি ছিলো তাঁহার অপরাধ।! আপনার রাজ্যের প্রজারা ওঁনাকে সন্দেহ করার সাহস কিরূপে পান ? আর আপনিই বা কেমন যে তাহাদের বিচার না করে নিরাপরাধ স্ত্রীকেই ত্যাগ করে দিলেন। আপনি ঘোর অন্যায় কর্ম করেছেন।” মহারাজ শ্রীরাম বললেন- “হে বালক ! আমি সূর্যবংশী। আমরা ব্যক্তিগত সুখ অপেক্ষা প্রজার দাবীকেই অধিক মান্যতা দেই। ইহাই রাজার কর্তব্য। ইহা ভিন্ন আমার উপায় ছিলো না।”

লব ও কুশ বলল- “মহারাজ! আপনি কর্তব্য কর্ম করতে গিয়ে কেন নীরিহকে শাস্তি দিলেন ? দেবী সীতা গর্ভস্থ অবস্থায় জেনেও আপনি আপনার সন্তানের সহিতও অধর্ম করলেন ? যে ব্যক্তি ভূমিষ্ঠ হয় নি- তাহাকে শাস্তি দিলেন কোন অপরাধে ? এ কেমন বিচার?” মহারাজ শ্রীরাম অনেক কিছু বলে বললেন- “বালক! তোমরা জ্ঞানী। তোমরা যুদ্ধবিদ্যায় পারঙ্গদ । নিশ্চয়ই তোমরা কোন শক্তিমান ও তেজস্বিনী পিতামাতার সন্তান । কিন্তু বালক। এই স্থানে আমি তোমাদিগের প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য হয়ে আসিনি। তোমরা যজ্ঞের অশ্ব উন্মুক্ত করে দাও ।” লব ও কুশ বলল- “কদাপি নয় মহারাজ! বরং আপনাকে যুদ্ধে পরাজিত করে সীতামাতার ওপরে হওয়া অন্যায়ের প্রতিকার করবো। যজ্ঞের অশ্ব নিতে হলে আমাদিগকে পরাস্ত করুন।” ভগবান শ্রীরাম বললেন- “বালক! তোমরা বয়সে অনেক কনিষ্ঠ। তোমাদিগের সাথে যুদ্ধ করলে তাহা হাস্যকর হবে। অবুঝ না হয়ে অশ্ব ফিরিয়ে দাও। আমি বল পূর্বক তোমাদিগকে বন্দী করে অশ্ব উদ্ধার করতে পারি। তোমরা অয্যোধ্যার বহু সেনা নাশ করে আমার তিন ভ্রাতাকে আহত করেছো। আমি তবুও তোমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারন করতে মনকে বোঝাতে পারছি না। কারণ তোমাদের দেখে আমার স্নেহ উৎপন্ন হচ্ছে। তোমরা চাইলে অর্ধ রাজত্ব, বিশাল রাজপুরী, বহু স্বর্ণ রথ, হস্তী নিতে পারো। তাহার পরিবর্তে যজ্ঞের অশ্ব ফিরিয়ে দাও।” লব ও কুশ বললেন- “আমরা সে সকল কিছুই চাই না। আপনি যুদ্ধ করুন। দেখি আপনার বীরত্ব। কোন শক্তিতে আপনি দশানন রাবণকে বধ করেছিলেন তাহা দেখতে চাই।” ভগবান শ্রীরাম অনেক বোঝালেন, লব কুশ শুনলো না । অপরদিকে বাল্মিকী মুনি দিব্যদৃষ্টিতে সব কিছুই দেখেছিলেন। তিঁনি দ্রুত গতিতে আশ্রম অভিমুখ চললেন। অপরদিকে হনুমান দুই বালকের দিকে রে রে করে গদা নিয়ে ছুটে গেলো। লব ও কুশ দিব্যাস্ত্র দ্বারা হনুমান কে বন্দী করতে চাইলেন । কিন্তু হনুমানের কোন অস্ত্রেই ক্ষতি হল না ।

তখন লব ও কুশ আশ্রম বালক দের ইশারা করলেন। আশ্রমের বালকেরা এসে “জয় সীতারাম- জয় জয় রাম” বলে হনুমানের চারপাশে তালি দিয়ে ঘুরে ঘুরে নৃত্য করতে লাগলেন । ‘সীতারাম’ নাম শুনতে শুনতে হনুমান সব কিছুই বিস্মৃত হলেন। এমন কি প্রভু যে স্বয়ং এখানে উপস্থিত – তাহাও বিস্মৃত হলেন । হনুমান করতালি দিয়ে ‘সীতারাম’ কীর্তন করে ঘুরে ঘুরে আশ্রমের বালক দের সাথে নাচতে লাগলেন । রাম নাম শুনে তিঁনি এতটাই মত্ত হয়ে গেছিলেন। আশ্রমের বালকেরা হনুমানকে বন্দী করে আশ্রমে নিয়ে গেলো। একেবারে সীতাদেবীর সামনে। আশ্রম বালকেরা সীতাদেবীকে বললেন- “দেবী আপনার পুত্র দ্বয়ের সাথে মহারাজ শ্রীরামচন্দ্রের ঘোরতর যুদ্ধ হতে চলছে। অজ্ঞান বশত লব ও কুশ অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব ধরেছিলেন। লব ও কুশের হাতে শত্রুঘ্ন, লক্ষ্মণ, ভরত পরাজিত হয়ে আহত হয়েছেন।” সীতাদেবী কপালে করাঘাত করে রোদন করতে লাগলেন এই শুনে। হনুমান ও মাতা সীতার সাক্ষাৎ হল। হনুমান প্রণাম করে বলল- “মা আপনি এই আশ্রমে। আপনার পুত্র কি লব আর কুশ ? মাতঃ! কৃপা করে চলুন। প্রভু অজ্ঞান বশত পাছে আপন সন্তান দের বধ না করেন। কিংবা দুই বালক অজ্ঞানে পিতাকেই না হত্যা করে। এ কেমন লীলা! পিতা ও পুত্রের যুদ্ধ।” তখন মহর্ষি বাল্মিকী আসলেন। বললেন- “এই যুদ্ধ থামাতে হবে।” অপরদিকে ভগবান শ্রীরাম ক্রোধে বললেন- “তোমরা বড় অবাধ্য বালক। আজ তোমাদের বন্দী করবো।” লব ও কুশ প্রথমে বাণ নিক্ষেপ করলেন। সেই বাণ পুস্প হয়ে ভগবান শ্রীরামের চরণে পড়লো। তাহার পর লব ও কুশ শিলাবাণ নিক্ষেপ করলেন। অসংখ্য শিলা অযোধ্যার সেনার ওপরে পড়লো। শিলাতে পিষে গেলো সেনা সকল। হস্তী, অশ্ব, রথ চূর্ণ হল। তাহার পর লব কুশ কালাগ্নি বাণ মারলেন। আগুনের তেজে শ্রীরামের সেনা ঝলসে গেলো। ভগবান শ্রীরাম তখন মরুত বাণ নিক্ষেপ করলেন । লব ও কুশ বজ্রবাণে সেই অস্ত্র ধ্বংস করলেন । দুই বালকের তেজে সমানে বানর, রাক্ষস, মানব সেনারা নাশ হতে লাগলো।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।