২৫ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব –২৪)

বিপ্রের দুঃখে শ্রীরামের চোখে জল এসে গেলো। বিপ্রকে কি ভাবে বোঝাবেন। বিপ্রের পদচিহ্ন স্বয়ং শ্রীবিষ্ণু বক্ষে ধারণ করে আছেন । পাছে ব্রাহ্মণের শাপে গোটা অযোধ্যাই না ভস্ম হয় । শ্রীরাম ভাবলেন কি জন্য এমন ঘটেছে। তিঁনি ত ন্যায় নীতি সহ রাজ্য পালন করেন। প্রজাদের দাবী মানতে গর্ভস্থ স্ত্রীকে পর্যন্ত ত্যাগ করেছেন। তবে এ কি থেকে হল। এই রহস্য ভেদের জন্য তিঁনি প্রথমে পুত্রহারা ব্রাহ্মণকে সান্ত্বনা দিয়ে আট জন শ্রেষ্ঠ ঋষি কে আহ্বান জানালেন। বশিষ্ঠ, বামদেব, মার্কণ্ড, মৌদ্গল্য, কাত্যায়ন, জাবাল, গৌতম ও নারদ মুনিকে আহ্বান জানালেন । আটজন ব্রাহ্মণ ঋষিকে যত্ন সহকারে আসন দিলেন। পূজা করলেন । এই ব্রাহ্মণের অকাল মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলেন । নারদ মুনি বললেন- “হে রঘুনন্দন! যেরূপে এই ব্রাহ্মণের পুত্রর অকালমৃত্যু হয়েছে তাহার প্রতিবিধান সম্ভব । সত্যযুগে ব্রাহ্মণ ব্যতীত অপর কাহারোও তপস্যার অধিকার ছিলো না। সেই সত্যযুগে তপস্যা দ্বারা উজ্জ্বল ও অজ্ঞানরহিত ছিলো। কিন্তু ত্রেতা যুগে ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয় তপোবল ও বাহুবল সকল বিষয়ে সমান । তবুও ত্রেতা যুগে ক্ষত্রিয় অপেক্ষা ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব দেখে মনু আদি ধর্ম প্রবর্তক গন সর্ব সম্মত বর্ণাশ্রম ধর্ম প্রচার করলেন । ত্রেতা যুগে অধর্ম এক পদ ভূমি পাইবে। বর্ণাশ্রম ধর্ম থাকিলেও অধর্ম থাকিবে। ত্রেতাযুগে মানবের পরমায়ু ক্ষীণ হয়েছে । ত্রেতা যুগে বৈশ্য ও শূদ্রেরা – ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের সেবা করবে । ব্রাহ্মণ- ক্ষত্রিয়- বৈশ্য এই ত্রিজাতির সেবা করাই শূদ্রের ধর্ম । দ্বাপর যুগে অধর্ম দ্বিপাদ ভূমি পাইবে , সেই যুগে বৈশ্যেরা তপস্যা করিবে। মহারাজ শূদ্রেরা কেবল কলিযুগে তপস্যা করিবে। যথাক্রমে সত্য- ত্রেতা- দ্বাপর যুগে ব্রাহ্মণ- ক্ষত্রিয়- বৈশ্য রা তপস্যা করবে। রাজন দ্বাপর যুগেও শূদ্রের তপস্যা করা অধর্ম । নিশ্চয়ই কোন শূদ্র এই ত্রেতা যুগে আপনার রাজ্যের সমীপে তপস্যা করিতেছে । দুর্মতি মানব যে নগরে বা রাজ্যে অধর্ম করে সেখানে অলক্ষ্মী আবির্ভূত হয় । হে রাজন এই অশাস্ত্রীয় কার্যকলাপ বন্ধ করুন।” ( বাল্মিকী রামায়ণ – উত্তরকাণ্ড – অষ্টাশীতিতম সর্গ – শ্লোক- ১-৩০)

শ্রীরামচন্দ্র বলিলেন- “হে দেবর্ষি ! আমি আপনার কথা অনুসারে কর্ম করবো। আমি দেখবো কোন দুরাচারী শূদ্র আমার রাজ্যে তপস্যা করিতেছে। সেই দুর্মতির শাস্তির বিধান করবো।” মুনি গন বললেন- “হে শ্রীরাম ! যদি সেই দুর্মতি অশাস্ত্রীয় শূদ্রকে নিবৃত্ত করতে পারেন, তবেই এই বালক প্রাণ ফিরে পাইবে।” শ্রীরাম তখন ভরত, লক্ষ্মণ কে বললেন- “তোমরা এই বিপ্রকে সান্ত্বনা প্রদান পূর্বক এঁনার যত্নআত্তির ব্যবস্থা করো। ইঁহার নিস্প্রাণ পুত্রের শব তৈল ও ভেষজ ঔষধি দ্বারা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করো- যাহাতে এই নিথর দেহ নষ্ট না হয়। আমি সেই শূদ্রকে প্রথমে বুঝিয়ে নিবৃত্ত করবার চেষ্টা করবো। যদি নিবৃত্ত না হয় তবে আমার অস্ত্র তাহাকে নিবৃত্ত করবে।” শ্রীরাম তখুনি অশ্ব পৃষ্ঠে আরোহণ করে সেই শূদ্রের খোঁজ করতে গেলেন । চারিদিকে খুঁজে বেড়াতে লাগলেন সেই শূদ্রকে । যেখানে যেখানে মুনি ঋষি দেখলেন, দেখতে পেলেন তাহারা সকলেই ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়। কোথাও বৈশ্য বা শূদ্রকে তপস্যা করতে দেখলেন না। চারপাশে দূত প্রেরণ করলেন । খুঁজে আনতে যে কোথায় কোন অধার্মিক শূদ্র শাস্ত্র অবমাননা করে মহাপাপ করছে । দূতেরাও নিস্ফল হয়ে ফিরে এলো। তখন ভগবান শ্রীরাম দক্ষিণ দিকে এসে বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণে অবস্থিত শৈবল গিরির উত্তর দিকে এক সুন্দর বিরাট দীঘি দেখতে পেলেন । সেই সরোবর তীরে অধোমুখে লম্বমান তপস্বী দেখলেন। সেই ছিলো দুর্মতি শূদ্র তপস্বী । ভগবান শ্রীরাম বলিলেন- “হে তপস্বী! আপনি এখানে তপ করছেন । আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করেছি আপনি কোন বর্ণে জন্ম গ্রহণ করেছেন ?” সেই তপস্বী বলল- “মহারাজ শ্রীরাম! আমি শূদ্রজাতিতে জন্মেছি। আমার নাম শম্বুক । কঠোর তপস্যা দ্বারা দেবলোক জয় করে দেবতা হইতে বাসনা করি । আমি আপনাকে মিথ্যা বলিতেছি না।” শূদ্র হয়ে ‘ওঁ’ উচ্চারণ করে যজ্ঞ করা ইহা ভালো ঠেকল না। এই শূদ্রের জন্যই সেই ব্রাহ্মণ পুত্র হারিয়েছে । ভগবান শ্রীরাম বললেন- “ওরে দুর্মতি! শূদ্রের কর্তব্য তপস্যা নয়। শূদ্রের কর্তব্য অপর তিন বর্ণের সেবা করা। তুমি তপস্যা বন্ধ করো। তোমার এই অশাস্ত্রীয় যজ্ঞের জন্য আমার রাজ্যে এক ব্রাহ্মণের পুত্রর অকালে প্রাণ গেছে।”

শূদ্র বলল- “এ কদাপি হবে না। তপস্যা আমি করবোই । যজ্ঞাদিতে আহুতি প্রদান করবোই।” ভগবান শ্রীরাম অনেক বোঝালেন। ভগবান শ্রীরাম খড়্গ হস্তে নিলেন-

তপ্সবীর বাক্যে কোপে কাঁপে রাম- তুণ্ড ।
খড়্গ হাতে কাটিলেন তপস্বীর মুণ্ড ।।
সাধু সাধু শব্দ করে যত দেবগণ ।
রামের উপরে করে পুস্প বরিষণ ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

শ্রীরামচন্দ্র খড়্গ দিয়ে শম্বুক শূদ্রের মুণ্ড কেটে বধ করলেন। দেবতারা ব্রহ্মা সহিত ‘সাধু’, ‘সাধু’ বলে রামচন্দ্রের ওপর পুস্প দিলেন ।

গৃহাণ চ বরং সৌম্য যং ত্বমিচ্ছন্যরিন্দম্ ।।
স্বর্গভাকু ন হি শূদ্রোহয়ং ত্বৎকৃতে রঘুনন্দন ।।
( বাল্মিকী রামায়ণ – উত্তরকাণ্ড – ঊননবতিতম সর্গ – শ্লোক ৮ )

অর্থাৎ- দেবতারা বলিলেন, হে শ্রীরাম! তুমি বর গ্রহণ করো। এই ব্যক্তি শূদ্র বলে তোমার হস্তে নিধন হইলেও স্বর্গে গেলো না ।

শ্রীরাম বলিলেন- “হে সুরগণ! আপনারা বর দিতে চাইলে এই বর দিন, যে ঐ ব্রাহ্মণের নিহত পুত্র যেনো জীবিত হয়ে ওঠে। ঐ ব্রাহ্মণ যেনো পুত্রকে ফিরে পান।” দেবতারা তাই আশীর্বাদ দিলেন । সেই ব্রাহ্মণের পুত্র জীবিত হল। ব্রাহ্মণ শ্রীরামের প্রশংসা করে ফিরলেন। এখানে একটি কথা বলার শম্বুক কে কেন বধ করলেন। যেখানে শূদ্রানী শবরী দেবীর মুখের উচ্ছিষ্ট ফল ভগবান শ্রীরামচন্দ্র গ্রহণ করেছিলেন। কারণ এইটাই। শবরী শাস্ত্র উলঙ্ঘন করেন নি । তিঁনি অবিরত ‘রাম’ নাম কীর্তন করেছেন। শম্বুক যদি তাই করতেন তবে তিনিও কৃপা পেতেন । কিন্তু সে তা না করে শাস্ত্র ভেঙ্গে ত্রেতা যুগেই তপস্যা আরম্ভ করেছিলেন। মহাপ্রভু ঘরে ঘরে বিলিয়েছেন নাম। সেই নামেই মহামুক্তি। আজকাল কিছু মঠ আছে- গলায় তুলসীমালা আর কানে ফুসমন্তর দিয়েই তাদের দিয়ে যজ্ঞ করাচ্ছে। যজ্ঞ করতে হলে সেই বিধান মানা আবশ্যক। রাশি রাশি গব্যঘৃত আর উৎকৃষ্ট মধু দিলেই যজ্ঞ সমাপন হয় না। যজ্ঞের পুরোহিতকে গায়ত্রী মন্ত্রে দীক্ষা ও দশবিধ সংস্কার ধারণ করতে হয়- শূদ্রকূলে এসব সেই যুগে হতো না । গায়ত্রী উপবীত না নিলে সে যজ্ঞ করার উপযুক্তই নয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেও দশবিধ সংস্কার সূচী পালন করেছিলেন । শাস্ত্র উলঙ্ঘন ভগবান শ্রীরাম , ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, ভগবান মহাপ্রভু কেউ করেন নি। কিন্তু তাঁদের নাম নিয়ে হাতে গোনা দু একটি মঠ ফুসমন্তর দেবার খেলায় নেমেছে। এবার দেখুন এর পরিণতি কি হয়- তাহা মহর্ষি বাল্মিকী রামায়নে লিখেছেন।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।