২৫ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব –৩০)


যজ্ঞ আরম্ভ হল। ব্রাহ্মণ ঋষি পবিত্র মন্ত্রাদি পড়ে যজ্ঞে বহ্নি প্রজ্বলন করলেন । সকলে দেখতে লাগলেন। ঋষি মুনিরা ‘সাধু’ ‘সাধু’ বলে প্রশংসা জানালো। বৈদিক মন্ত্র পড়ে আহুতি প্রদান করা হল । ধান্য, যব,গম, দৈ, দুধ, ঘৃত , মধু আনা হয়েছিলো। পুস্প পত্র সকল রাখা ছিলো। যজ্ঞের পর্বত প্রমান শিখায় ব্রাহ্মণেরা মন্ত্র পড়ে আহুতি প্রদান করতে লাগলেন। আহুতি পড়া মাত্রই অগ্নি সপ্ত জিহ্বা প্রকাশ করে লকলক করছিলো। যজ্ঞধূমের পবিত্র সুবাসিত গন্ধ চারপাশ ছড়িয়ে পড়লো। শ্রীফলের পত্র , চন্দন কাষ্ঠের সুবাসে ভুবন মোহিত হল। পর্বত প্রমান ফল মূল নানাবিধ ভোজন যজ্ঞদেবতাকে উৎসর্গ করা হল। সেই যজ্ঞস্থলে সকলে যে যার ইচ্ছানুযায়ী বস্তু পাইতে লাগলো। সারি সারি যতদূর দেখা যায় কেবল লোকেদের মাথা দেখা যায় । সকলে এই যজ্ঞ দেখে অতি প্রসন্ন । যজমানের আসনে ভগবান শ্রীরাম বসলেন। তাঁহার বামে মাতা সীতার স্বর্ণ মূর্তি শোভা পাচ্ছিল্ল। এমন সময় মহর্ষি বাল্মিকী লব ও কুশ কে নিয়ে এলেন। বাল্মিকী মুনি বললেন- “পুত্র! এই হল ভগবান শ্রীরামের সেই অশ্বমেধ যজ্ঞ। তোমরা এখানে সীতাদেবীর চরিত্র সঙ্গীতের মাধ্যমে শোনাবে।” লব ও কুশ জানতো না যে সীতাদেবীকে শ্রীরাম ত্যাগ করেছেন। বাল্মিকী মুনি তাহাদের সেই অধ্যায় পড়ান নি । লব কুশকে দেখে সকলে অবাক হল। অপূর্ব সুন্দর অঙ্গকান্তি- এই ঋষি বালক দ্বয়কে দেখে বনবাসী বলে মনে হয় না। ইহাদের গঠনে রাজকীয় লক্ষণ আছে। আহা কি সৌম্য। দেখলেই সকল জ্বালা জুড়োয়। বৃদ্ধ লোকেদের মনে হল যেনো বাল্যবস্থায় ছোট্ট শিশুরামের মুখাবয়ব দুই বালকের মধ্যে । সকলের মনে হল লব ও কুশকে ক্রোড়ে নিয়ে বাৎসল্য প্রদান করতে। বড় মায়াময় ও সুন্দর মুখ খানি। হৃদয়ে বসে যায় সেই ছবি । মহর্ষি বাল্মিকীর সঙ্গে এসেছেন এরা কারা? অপরদিকে বাল্মিকী মুনি হনুমান, বিভীষণ, সুগ্রীব, অঙ্গদ, নল- নীল, জাম্বুবান সকলকে দেখালেন লব ও কুশকে। হনুমানের চঞ্চলতা ভাব দেখে দুভ্রাতা খুবুই হাস্য করতে লাগলো ।

অবশেষে শ্রীরাম সেই অশ্ব কে আনলেন। যাহাকে ছাড়া হবে। পেছনে শত্রুঘ্ন দুই অক্ষৌহিণী সেনা সহ, হনুমানকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন । অশ্বের কপালে জয় পত্র লেখে দিলেন। অশ্বকে বিধিবিধানে পূজা করলেন।

তুরঙ্গ- নগর হৈতে আইল তুরঙ্গ ।
তুরঙ্গ সোয়ার তার কত শত রঙ্গ ।।
শ্যামবর্ণ অশ্ব শ্বেতবর্ণ চারি খুর ।
নানা অলঙ্কার শোভে সুহার কেয়ুর ।।
লেজ শোভা করে যেন ধবল চামর ।
কপালে চামর তার অতি শোভাকর ।।
সর্ব গায় খামি খামি সুবর্ণ অদ্ভুত ।
জলদ মণ্ডলে যেন খেলিছে বিদ্যুৎ ।।
স্বর্ণবর্ণ কর্ণ তার ধরে নানা জ্যোতি ।
দুই চক্ষু জ্বলে যেন রত্নের বাতি ।।
গলে লোমাবলি যেন মুকতার ধারা ।
রাঙ্গা জিহ্বা মেলে যেন আকাশের তারা ।।
জয়পত্র ঘোড়ার কপালেতে লিখন ।
দিলেন শত্রুঘ্ন বীরে ঘোড়ার রক্ষণ ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

এইভাবে অশ্বকে পূজা করে রাকা শ্রীরামচন্দ্র অশ্ব ছাড়লেন। অশ্ব যে সকল স্থানে ইচ্ছা গমন করতে পারবে। যে রাজ্যে ইচ্ছা যেতে পারবে। যে রাজ্যে অশ্ব যাবে সেই রাজ্যকে , রাজা শ্রীরামচন্দ্রের মিত্রতা স্বীকার করে অযোধ্যায় এসে যজ্ঞে উপস্থিত হবে। আর যে রাজা অশ্ব ধরবে, তার সহিত যুদ্ধ করে তাকে পরাজিত করে সম্মান সহিত যজ্ঞে আনয়ন করা হবে। এই ছিলো অশ্বমেধ যজ্ঞের নিয়ম। অশ্বের পেছন পেছন শত্রুঘ্ন দুই অক্ষৌহিণী কটক নিয়ে চলল। কোটি সেনা, রথ , অশ্বারোহী বের হল। অতি বৃহৎ শ্রাবনের জলধর জলদের ন্যায় হস্তী গুলি ভূমি কাঁপিয়ে বের হল। সকলে মহারাজ শ্রীরামের জয়ধ্বনি আরম্ভ করলো। লব ও কুশ হা করে সব দেখছিলো। জীবনে তাহারা রাজার এমন সেনা দেখেনি । জন্ম থেকেই তাহারা আশ্রমে পালিত । বাল্মিকী মুনির চরণ পূজা করে মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র আসন দিলেন। লব ও কুশকে দেখে শ্রীরামচন্দ্র খুবুই আবেগ প্রবণ হলেন । দেখতে পেলেন শিশু দুটির মুখে নিস্পাপ জানকীর মুখ । লব ও কুশকে দেখা মাত্রই শ্রীরামচন্দ্রের মনে যেনো বাৎসল্য উদয় হল।

কি মধু ভরা চোখ । দেখা মাত্রই হৃদয়ে যেনো স্নেহ বাৎসল্য উদয় হয়। মুনিকুমার দ্বয়ের শরীরে রাজলক্ষণ স্পষ্ট। ইহারা কি সত্যি মুনি কুমার নাকি কোন রাজ্যের রাজপুত্র! চলন গমন, কথার ভঙ্গিতে রাজার চিহ্ন প্রকাশ পাচ্ছে। মনে হয় ইহাদিগকে ক্রোড়ে নিয়ে কত না আদর করি । আহা! সীতা না জানি কোথায় আছে। যদি বেঁচে থাকে তবে ইহারও হয়তো এমন সন্তান হয়েছে। অয্যোধ্যার রাজকুমার আজ অযোধ্যায় নেই। ইহা ভাবতেই শ্রীরামের চোখ ছলছল করতে লাগলো। পরে আবার শক্ত হয়ে কর্তব্যকর্ম স্মরণ করে যজ্ঞে মন দিলেন। কৌশল্যা, কৈকয়ী, সুমিত্রা তিন রাজমাতা লব কুশকেই দেখছিলেন। তাহাদেরও সীতার কথা মনে পড়লো। বেচারী, জনমদুখিনী সীতা যদি আজ রাজপুরী থাকতো, তবে নিশ্চয়ই তাহারও সন্তান হত। তারা ঠিক এমনই হত। তিন রাজমাতা অনেক উপহার, খেলনা, মিষ্টান্ন লব কুশকে দিতে চাইলেও তাহার নিলো না। মহর্ষি বাল্মিকীর আদেশে ‘রামায়ণ’ গান আরম্ভ করলেন। সীতা চরিত্র ফুটিয়ে তুললেন সঙ্গীতে। সীতাদেবী ধরিত্রী মায়ের কন্যা। ভূমি কর্ষণ উৎসবে মিথিলা রাজা জনক তাঁহাকে প্রাপ্তি করেছিলেন। হর ধনুক ভঙ্গ করে শ্রীরামের সাথে সীতার বিবাহ, বনবাসে পতির অনুগমন – সকল কিছুই গাইলেন। বনবাসে কষ্টে দিন যাপন সীতাদেবীর, দুষ্ট রাবণের দ্বারা সীতা হরণ গাইলেন । লঙ্কায় বন্দিনী থেকে সেই মহাসতী নারী ‘রাম’ নাম জপ করেই দিন কাটিয়েছেন। রাবণ কতই না যাতনা দিয়েছে, তবুও সীতাদেবী রাবণের প্রস্তাবে সায় দেন নি। সেই সতী নারীকে বিন্দু মাত্র স্পর্শ করতে পারেনি দশানন । রাবণ বধের পর মুক্ত হয়েও সীতাদেবী অগ্নিপরীক্ষায় সসম্মানে সফল হয়েছেন। এই সীতা চরিত্র শুনে দুঃখে সকলের অশ্রুধারা নেমে এলো। রাজ্যের প্রজারা ক্রন্দন করতে লাগলেন । সীতা দেবীর চিরকাল দুঃখেই কাটলো। তবুও সতীত্ব ধর্মে অবিচল থেকে স্বামীর একবাক্যে নির্বাসন মেনে নিয়েছেন। একটা ‘টুঁ’ শব্দ করেন নি। এমনই দেবী সীতার চরিত্র ।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।