১২ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব –১৬)

হনুমান ভাবল তাই ত। মাতৃজ্ঞা সবার উপরে। মাতার মুখের বচন রাখতে হবে। হনুমান বলল- “রাজা শকুন্ত, মনে হচ্ছে এখুনি তোমার শিরোচ্ছেদ করি। কিন্তু কি করবো? মায়ের আদেশ পালন করাই পুত্রের ধর্ম। আমি জানি না তোমাকে রক্ষা করতে আমি সমর্থ হব কিনা। বহু আগে ইন্দ্রপুত্র জয়ন্ত প্রভু শ্রীরামের বাণ থেকে রক্ষা পেতে ব্রহ্মলোক ও কৈলাসে গিয়েও নিস্তার পায় নি। তার একটি নয়ন অন্ধ হয়েছিলো। দেখা যাক, তোমার নিয়তিতে কি আছে ।” এই বলে হনুমান তখন রাজা শকুন্তকে নিয়ে একস্থানে গেলো। ‘রাম’ নাম লিখে একটি স্তূপ রচনা করলো। যার প্রতি প্রস্তরে ‘রাম’ নাম লেখা ছিলো। শকুন্তকে তার ওপর বসালো। সেই স্তূপে ‘রাম’ নাম লেখা একটি ধ্বজা স্থাপন করলো। হনুমান বলল- “রাজা শকুন্ত! অবিরত ‘শ্রীরাম জয় রাম- জয় জয় রাম’ এই মন্ত্র জপ করো। যত বিপদ আসুক, এমনকি সামনে স্বয়ং ভাস্করপুত্র যমকে দেখলেও নাম জপ ছাড়বে না। যদি তোমার প্রাণ বাঁচে তবে এই ‘রাম’ নামেই বাঁচবে। অন্যত্থায় ত্রিলোকের কোন শক্তি তোমাকে রক্ষা করতে পারবে না। তাই ভুলেও ‘রামনাম’ জপ করা ছাড়বে না।” রাজা শকুন্ত সমানে জপ আরম্ভ করলো। “শ্রীরাম জয় রাম – জয় জয় রাম”- এই মহা মন্ত্র জপ আরম্ভ করলো। অপরদিকে সূর্য উদয় হয়েছে। শত্রুঘ্ন ও ভরত এসে বলল- “ভ্রাতা! আমরা তোমার সেবক। আমরা গিয়ে সেই রাজা শকুন্তের মস্তক আনিবো। আপনি তাহা ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্রর চরণে অর্পিত করবেন।” এই বলে ভরত ও শত্রুঘ্ন চার অক্ষৌহিণী সেনা নিয়ে চলল। ভাবল ইহা দেখে নিশ্চয়ই রাজা শকুন্ত যুদ্ধের পরিকল্পনা করবে। কিন্তু কাশীরাজ্য ঘুরেও রাজা শকুন্তকে পেলো না। খুঁজতে খুঁজতে তারা সেই স্থানে আসলো। ভরত ও শত্রুঘ্ন দেখলো হনুমান স্বয়ং প্রহরা দিচ্ছে রাজা শকুন্তকে কে। এই দেখে বিস্মিত হলেন ।

ভরত , শত্রুঘ্ন বললেন- “ওহে পবনপুত্র! তুমি জানো না, এই পাপীর মস্তক কেটে নেবার জন্য আমাদের অগ্রজকে মহর্ষি বিশ্বামিত্র আদেশ করেছেন। তবে একে সুরক্ষা করছ কেন ? তুমি তোমার প্রভুর বিরুদ্ধে গিয়েছো ?” হনুমান বলল- “ভ্রাতা! ইনি আমার মাতা অঞ্জনাদেবীর কাছে সুরক্ষা চেয়েছিলেন । আমি তাহাই করেছি।” ভরত শত্রুঘ্ন বললেন- “তবে তোমাকে বন্দী করে আমরা শকুন্তের মস্তক নিয়ে যাবো।”হৈ হৈ করে চার অক্ষৌহিণী সেনা ছুটলো। হনুমান বলল- “রাজা শকুন্ত! অবিরত ‘রাম’ নাম জপ করো। ভুলেও নাম ত্যাগ করো না।” রাজা শকুন্ত প্রান ভয়ে সমানে উচ্চস্বরে রাম নাম জপ করতে লাগলো। দেখা গেলো একটি অদৃশ্য প্রাচীর হনুমান ও রাজা শকুন্তের চারপাশে দাঁড়িয়ে গেলো। সেটা ‘রামনাম’ এর প্রাচীর। অযোধ্যার সেনারা কিছুতেই সেই প্রাচীর পার হতে পারলো না। বলশালী উন্মত্ত হস্তী, অশ্ব গুলি আঘাত করেও সেই প্রাচীর ভাঙ্গতে পারলো না। সেনারা বর্শা, তির, পাশ, ছোড়া, পট্টিশ, গদা, তোমর , মশাল আদি অস্ত্র নিক্ষেপ করলেও সেই প্রাচীর ভেদ হল না। হনুমান ও রাজা শকুন্ত উভয়ে উচ্চ রবে ‘রাম’ নাম জপতে লাগলেন । তখন ভরত শত্রুঘ্ন নানা প্রকার দিব্যাস্ত্র চালনা করতে লাগলেন। দিব্যাস্ত্রের প্রভাবে চারপাশে ঘোর অন্ধকার নেমে আসলো। ভূকম্প, উল্কাবৃষ্টি, আগুনের গোলা পতিত হতে লাগলো। কিন্তু সেই প্রাচীরে সেসকল অস্ত্র ঠেকতেই বিফল হয়ে ফিরে গেলো। রাম নামের অভেদ্য দুর্গ দাঁড়িয়ে রইলো। পরাজিত হয়ে ভরত, শত্রুঘ্ন সেনা নিয়ে চলে গেলো। ফিরে এসে বলল- “দাদা! রাজা শকুন্ত হনুমানের মাতা অঞ্জনাদেবীর কাছে সুরক্ষা চেয়েছে। হনুমান নিজে স্বয়ং উপস্থিত থেকে আপনার নাম জপ করে রাজা শকুন্তকে রক্ষা করছে। তাই আমরা পরাজিত হয়েছি।” শ্রীরাম বললেন- “আমার ভক্ত হনুমান সেই রাজা শকুন্তের রক্ষা করছে? হায় একি পরিস্থিতি এলো। যেই হনুমান আমার আদেশে সাগর ডিঙিয়ে সীতার খোঁজ এনেছিলো, আমার আদেশে গন্ধমাদন পর্বত তুলে এনেছিলো, সে আজ আমার শত্রুকেই সুরক্ষা দিচ্ছে। তবে হনুমানকে বন্দী করা হোক।” লক্ষ্মণ এবার যেতে চাইলো। প্রভু শ্রীরাম আদেশ দিলেন ।

শ্রীলক্ষ্মণ পাচ অক্ষৌহিণী সেনা নিয়ে আসলেন। জঙ্গল কাঁপিয়ে মদমত্ত হস্তী সকল আসতে লাগলো, অশ্ব গুলি খুঁড়ের ধূলায় আচ্ছাদিত হল, রথের চক্রের আওয়াজ শোনা গেলো। লক্ষ্মণকে আসতে দেখে হনুমান বলল- “ইনি মহাযোদ্ধা। রাবণের পুত্র মেঘনাদকে বধ করেছেন। রাজা শকুন্ত হস্তে করতালি দিয়ে রাম নাম জপ করো। দেখো প্রভুর নামের মহিমা।” রাজা শকুন্ত হস্তে করতালি দিয়ে “শ্রীরাম জয় রাম- জয় জয় রাম” জপতে লাগলেন । লক্ষ্মণ এসে বলল- “হনুমান ! তোমাকে মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র বন্দী করতে আদেশ দিয়েছেন। সরে যাও, অন্যত্থা তোমাকে আটক করা হবে।” হনুমান বলল- “ভ্রাতা লক্ষ্মণ! যে রাম নাম জপ করে তাহাকে রক্ষা করা আমার কর্তব্য। আমি তাহাই করছি মাত্র।” লক্ষ্মণের আদেশে সেনারা অগ্রসর হলে রাম নামের দুর্ভেদ্য প্রাচীর কিছুতেই তাদের অগ্রসর হতে দিলো না। সকলে স্তম্ভিত হয়ে গেলো। যত রকমের ঘাতক অস্ত্র ছিলো সব বর্ষণ করলো। সকল অস্ত্রই বিফল হল। লক্ষ্মণ তখন একের পর এক দিব্যাস্ত্র সকল চালনা করতে লাগলো। সব গুলি সে ‘রাম’ নামের প্রাচীরে ঠেকতে বিফল হয়ে গেলো। একে একে সব অস্ত্র বিফল হল। ‘রাম’ নামের প্রাচীর কোন অস্ত্রই ভেদ করতে পারলো না। লক্ষ্মণ হার মেনে ফিরে গেলো । আকাশে দেবতা বৃন্দ এই সকল দেখছিলেন। প্রজাপতি ব্রহ্মা বললেন- “দেখো নারদ! রাম নামের মহিমা। কোন অস্ত্রই রাম নামের প্রাচীর ভেদ করতে সক্ষম নয়। এই পবিত্র নাম আমি দেবাদিদেব শিব পঞ্চমুখে জপ করেন । তারকব্রহ্ম ‘রাম’ নাম মুক্তি দেয় ইহা দেখেছিলে। এবার প্রত্যক্ষ করো সেই মহামন্ত্র সকল প্রকার ঘাতক অস্ত্র স্বরূপ নানান বাধা থেকেও সুরক্ষা করে। ভয়ে ভীত হয়ে রাজা শকুন্ত এই পবিত মহামন্ত্র কীর্তন করে সকল বাধা থেকে রক্ষা পাচ্ছেন। আর পবিত্র চিত্তে এই মহামন্ত্র কীর্তনের ফল আমিও বর্ণনা করতে সক্ষম নই । এরপর দেখো আরোও কি কি লীলা সামনে আসে।”

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।