মাতা সীতার মুখ হতে এই রকম বাক্য শুনে সকলে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। শাস্ত্রজ্ঞ মুনি ঋষিদের মুখেও কোন উত্তর ছিলো না । মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র মাথা নীচু করে রইলেন । কারোর মুখে উত্তর নেই। সীতা দেবী চোখের জল মুছে বললেন- “আমি অনেক কটু কথা বলবার জন্য ক্ষমা চাইছি। আমি অযোধ্যা নরেশ মর্যাদা পুরুষোত্তমের স্ত্রী। কিন্তু তাহার পূর্বে আমি একজন নারী। একজন নারী রূপে এই সত্য জানানো উচিৎ ছিলো। নচেৎ আমার নারীধর্ম আমাকে ধিক্কার জানাতো। বারবার নারীর সতীত্বের পরীক্ষা গ্রহণ করা নারীধর্মের চূড়ান্ত অপমান। কিন্তু একজন যোগ্য স্ত্রী রূপে আমি এই পরীক্ষা দেবো। কারণ স্ত্রীর সতীত্বে স্বামীর যশ , খ্যাতি বৃদ্ধি পায়, আজ অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে আমি তাহা প্রমান করবো।” এই বলে দেবী সীতা করজোড়ে সকলের সামনে বললেন- “যদি আমি সতী নারী হয়ে থাকি, তবে এখুনি দেবী বসুন্ধরা তাহার গর্ভে আমাকে স্থান দিন। আমি শ্রীরাম ভিন্ন অপর কাহাকেও কখন মনে স্থান দেই নাই, এই সত্যবলে ভগবতী বসুন্ধরা আমাকে তাঁহার গর্ভে স্থান দান করুন। আমি কায়মনোবাক্যে সতত কেবল শ্রীরামের অর্চনা করিয়াছি , সেই সত্যবলে ভগবতী বসুন্ধরা আমাকে তাঁহার গর্ভে স্থান দান করুন । আমি শপথ করে বলছি , শ্রীরামচন্দ্র ভিন্ন আমি অন্য কাহাকেও জানি না, এই সত্যবলে ভগবতী বসুন্ধরা তাঁহার গর্ভে আমাকে স্থান দান দিন।” এইভাবে বারংবার সীতাদেবী শ্রীরামচন্দ্রের নামে শপথ দিতে লাগলেন। সহসা ভূমিকম্প আরম্ভ হল। দেখতে দেখতে চতুর্দিক দুলে উঠলো। সশব্দে সেই স্থানে ভূমি দুই ভাগ হয়ে গেলো। তাহার মধ্য থেকে একটি দিব্য সিংহাসন উপস্থিত হল। মণি , রত্ন দ্বারা খচিত ছিলো সেই দিব্য সিংহাসন । উৎকৃষ্ট রত্ন আভূষণে সজ্জিত নাগেরা দিব্য দেহে ঐ সিংহাসন ধারণ করিয়া উঠলেন। তাহার মধ্যে অধিষ্ঠিতা ছিলেন ধরিত্রী দেবী মাতা বসুধা । সীতাদেবীকে ক্রোড়ে তুলে নিলেন দেবী ধরিত্রী । সাদরে স্বাগত জানিয়ে সীতাদেবীকে অভিনন্দন জানালেন । করজোড়ে সীতা দেবী বসুন্ধরা মাতার ক্রোড়ে বসলেন ।
সীতাদেবী কে বসুধার ক্রোড়ে যেতে দেখে সকলে হায় হায় করে উঠলো। লব ও কুশ মাতার পেছন পেছন ধাইলো। কিন্তু সীতাদেবী বাধা দিলেন । উপস্থিত মুনি ঋষিরা অবধি মাতা সীতার সতীত্বের প্রশংসা করে ‘সাধু’, ‘সাধু’ করলেন । মহর্ষি বাল্মিকী পূর্বেই জানতেন এমন হবে । শ্রীরাম ছুটে এলেন । সন্দেহবাদী সেই সকল প্রজারা তখন ভূমিতে প্রণাম করে বললেন- “মা। আমরা ঘোরতর পাপী। আপনার ন্যায় সতী নারীর নামে কলঙ্ক দিয়েছি। আমাদের বিনাশ কেহ রোধ করতে পারবে না।” সীতামাতা বললেন- “না পুত্র! এমন হবে না। নারী ক্ষমা ও ধৈর্যের জীবন্ত মূর্তি। সে নাশ করে না বরং সৃষ্টি করে। যদি এমন না হতো তবে বহু আগেই কোন এক হতভাগ্যা নারীর শাপে এই সমাজ ভস্ম হত। নারীর ক্ষমা, ধৈর্য, নিঃস্বার্থ সেবা, স্বামীভক্তিই তাহার সতীত্বের লক্ষণ। সেই নারীকে দেবতারা শ্রদ্ধা করেন। ইহার পরে তাঁহার অগ্নিপরীক্ষা চাওয়া চূড়ান্ত অপরাধ। তোমাদের সকলের মঙ্গল হোক। আমি বিদায় গ্রহণ করছি।” এই বলে সীতাদেবী সকলকে প্রণাম করে লব ও কুশকে বললেন- “পিতার সেবা করাই পুত্রের ধর্ম। পিতার আজ্ঞা পালন পুত্রের অগ্র কর্তব্য। তোমার পিতাও তাই করেছেন। এখন তোমরা তোমাদের পিতার নিকট থাকো।” এই বলে সীতাদেবী ভগবান শ্রীরামকে প্রণাম করে বললেন- “প্রভু! যুগে যুগে যেনো তোমারই চরণদাসী হয়ে জন্মাতে পারি। ইহা ভিন্ন আমার কিছু কামনা নাই। লব ও কুশ আপনারই পুত্র। তাহাদের রাজধর্ম ও ক্ষত্রিয়ধর্মের শিক্ষা দিয়ে যোগ্য করে তুলুন।” সকলে শুনে রোদন করতে লাগলো। হনুমান রোদন করতে লাগলো। লব কুশ, তিন ভ্রাতা, সীতার তিন ভগিনী, সীতার পিতামাতা, তিন শাশুড়ী, অয্যোধ্যার প্রজারা, মুনি ঋষি , বিভীষণ সহ রাক্ষসেরা, সুগ্রীব, অঙ্গদ, জাম্বুবান, নল, নীল আদি সকল বানরেরা রোদন করতে লাগলেন। সকলেই সীতাদেবীকে যেতে মানা করলেন। ভগবান শ্রীরাম বললেন- “হে জানকী। তুমি ভিন্ন আমার অস্তিত্ব কি? দয়া করে তুমি আমাকে একলা রেখে যেয়ো না।” সীতামাতা বললেন- “প্রভু! আপনি আবার দুর্বল হচ্ছেন। মন কঠোর করে আমাকে বিদায় দিন। আমার ইহজন্মে এতটুকুই অধ্যায় ছিলো- যাহা পূর্ণ হয়েছে । এবার আমার ফিরে যাবার সময় এসেছে। আপনি রাজা। রাজাকে সর্বদা দুর্বলতা, আবেগ পরিত্যাগ করে চলতে হয়। তাতেই রাজ্য সুরক্ষিত থাকে। আপনি আপনার পুত্রদের দেখবেন।”
এই বলে মাতা সীতাদেবী বললেন- “সকলের মঙ্গল হোক।” এই বলা মাত্র ধরিত্রী দেবী সীতা সহিত পাতালে চলে গেলেন। দুভাগ হয়েছিলো যে ভূমি, তাহা আবার একত্র হল। শ্রীরাম সেই স্থানে এসে রোদন করতে করতে বলতে লাগলেন- “আমার স্মমুখেই আমার সীতা আমার থেকে চলে গেলেন।এই বিহন অসহনীয়। পূর্বে যখন সীতাকে রাবণ হরণ করেছিলো, তখনও এত শোক হয় নি। হা সীতা! তোমা বিনা আমার অস্তিত্ব কি? হে বসুমতী। আমি করজোড়ে অনুরোধ করছি আমার সীতাকে ফিরিয়ে দাও।” লব ও কুশ মাটিতে পড়ে রোদন করে বলতে লাগলো- “মা জন্ম হতে পিতাকে দেখি নাই। তুমি আমাদের মাতা আবার তুমি পিতা। কত কষ্টে আমাদের লালিত পালিত করেছো মা । আজ আমাদের ছেড়ে কেন চলে গেলে? তোমা বিনা আমরা কিরূপে বাঁচি?” জনক রাজা , সুনয়না দেবী রোদন করতে লাগলেন। মনে পড়লো সীতাদেবীকে ভূমি কর্ষণ উৎসবে প্রাপ্তি করেছিলেন। মাতা বসুমতী আবার তাঁর সন্তান কে ফিরিয়ে নিলেন । শ্রীরাম পুত্রদের সান্ত্বনা দিয়ে বললেন- “হে বসুন্ধরা। সকল জীবকে তুমি আশ্রয় দাও, ঠিক যেমন মাতা তাঁর সন্তানকে আশ্রয় প্রদান করেন। তুমি সর্বংসহা। এত পাপী তোমার বুকে অবস্থান করা সর্তেও তুমি খণ্ড খণ্ড হও নি। হে বসুমতী! তুমি করুণার মূর্তি। কৃপা করে আমাদের দুঃখ দেখে সীতাকে ফিরিয়ে দাও। সীতা বিনা সকল কিছু অন্ধকার।” বসুমতী সাড়া দিলো না দেখে শ্রীরাম কঠোর হয়ে বললেন- “যদি তুমি আমাকে সীতা ফিরিয়ে না দাও, তাহলে ব্রহ্মাস্ত্রে মেদিনী ধ্বংস করে দেবো।” এই বলে কঠোর হয়ে শ্রীরাম, লক্ষ্মণকে আদেশ দিলেন- “ভ্রাতা সত্বর আমার ধনুর্বাণ নিয়ে আসো। আমি আজ ধরণী ধ্বংস করে সীতাকে ফিরিয়ে আনবো।” তখন প্রজাপতি ব্রহ্মা দৈববাণী করে বললেন- “হে শ্রীরাম! আপনি কি আপনার অবতারের প্রসঙ্গ ভুলে গেছেন? বরাহ অবতারে আপনি ধরিত্রী উদ্ধার করেছিলেন, আবার সেই ধরিত্রীকে ধ্বংস করতে চান ? সীতাদেবী সাক্ষাৎ দেবী লক্ষ্মী। তিনি পাতালে গিয়ে সীতারূপ ত্যাগ করে দেবী লক্ষ্মীরূপে নাগলোকের পথ ধরে বৈকুণ্ঠে গমন করেছেন। সেখানে তিঁনি আপনার জন্য প্রতীক্ষা করছেন।”
( ক্রমশঃ )
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন