২৫ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব- ৪৪)

রামায়ণে আমরা দেখতে পাই, শ্রীরামচন্দ্র যুদ্ধে আপন বিক্রম দেখানোর অধিকার সবাইকে দিয়েছেন। লক্ষ্মণ নিজে লঙ্কার যুদ্ধে অবস্থান করেছিলেন। শত্রুঘ্ন লবণ অসুর বধ করেছিলেন। এবার ভরতের গন্ধর্ব দিগদের বধের পালা। শুভ দিনে তিন অক্ষৌহিণী সেনা তৈরী হল। গজ, অশ্বারোহী, পদাতিক সেনা সকল তৈরী হলে। কোটি রথে অসংখ্য বীর যোদ্ধা সকল নানান ঘাতক অস্ত্র নিয়ে উঠলো। মাণ্ডবী কুলদেবতা সূর্যনারায়ণের পূজা করে ভরতের হস্তে তরবারি দিলেন। কপালে তিলক দিয়ে বিজয় কামনা করলেন । পুস্প দ্বারা পূজিত করলেন। ধূপ দ্বারা আরতি করলেন । এরপর ভরত গেলেন শ্রীরামের কাছে। শ্রীরাম আশীর্বাদ করলেন। ভরতের দুই পুত্র তক্ষ ও পুষ্কর মহারাজকে প্রণাম করলে মহারাজ শ্রীরাম বললেন- “তোমাদের পিতা বীর। তোমরা বীরের বংশে জন্ম হয়েছো। কুলের মান গড়িমা বজায় রেখো। যুদ্ধে তোমাদের পিতাকে সহায়তা করো।” এরপর মহারাজ শ্রীরাম ভরতকে ‘সংবর্ত’ নাম এক অস্ত্র দিলেন। বললেন- “ভ্রাতা! গন্ধর্বেরা মায়াবিদ্যাতে পটু। বহু মায়া রচনা করবে। এই অস্ত্র প্রচুর বিধ্বংসী ক্ষমতা রাখে। সময় বুঝে এই অস্ত্রে গন্ধর্ব দিগকে নাশ করবে।”ভরত রথে উঠলেন। ঢাক- ঢোল- কাঁসর- ন্যাকড়া- দুন্দুভি- দামামা- শিঙা বেজে উঠলো। অসংখ্য শঙ্খে ধ্বনি উঠলো। ভরত গিয়ে রথে উঠলেন । দুপাশে দুই পুত্র রথে উঠলো। হস্তী গুলি ভূমি কাঁপিয়ে শুণ্ড তুলে গর্জন করে বের হল। অশ্ব গুলি বের হল। রথের চাকায় ধূলাঝড় উঠলো। এভাবে সমগ্র সেনা সকল বের হল। হৈহৈ করতে করতে সব সেনারা চলল। ভরত তার পুত্র সহ বের হলেন। সোজা সিন্ধু নদের দিকে চলল। আশেপাশে অনেক রাজা তাহাদের স্বাগত জানালেন। কারণ অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় সকল রাজাই আনুগত্য স্বীকার করেছেন। কত গ্রাম, কত নদী, কত জনপদ, কত নগর, কত পর্বত পার হল। মাঝে মাঝে রাত নামলে সেইস্থানে শিবিড় রচনা করে দিন কাটালেন। এইভাবে সেই রাজ্যের উদ্দেশ্যে চললেন।

গন্ধর্বেরা খবর পেলো। গন্ধর্ব দেবতাদের অনুগত এক ধরনের জীব। যেমন- যক্ষ, রক্ষ, কিন্নর, বেতাল, কুস্মাণ্ড ইত্যাদি। গন্ধর্বেরা দেবতাদের খুব মান্য করেন। স্বর্গে সোমরস জোগান এরাই। আবার স্বর্গের নৃত্যে বিবিধ বাজনা বাজিয়ে তাল প্রদান করেন । গন্ধর্বেরা মায়াবী। বিভিন্ন ধরনের মায়া জানে তাহারা। এরা কিছু বদ হয় আবার কিছু উত্তম । এদের শরীর থেকে দিব্য সুগন্ধ বিচ্ছুরিত হয় । ভরতের সেনার পেছন পেছন রক্ত মাংসের আশায় ব্যাঘ্র, সিংহ, শৃগাল ও বিভিন্ন মাংসভোজী পক্ষী কুল চলছিলো। গৃধের দল আকাশে বিচরণ করতে করতে এই সেনা দলের পেছনে চলছিলো। শুধু কি তাই ! রক্তমাংস প্রিয় বেতাল, পিশাচেরা এই সেনা দলের পেছন পেছন চলছিলো। অবশেষে ভরত সেনা নিয়ে গন্ধর্ব প্রদেশে আবির্ভূত হল । সেই সিন্ধু নদের পাশে মনোরম পরিবেশ। সেই মনোরম পরিবেশ অতীব সুন্দর। সিন্ধ নদে বয়ে চলা জলের ধারার শব্দ শোনা যায়। মিষ্টি শীতল জল প্রবাহিত। দুপাশে অপূর্ব সুন্দর বন। বিভিন্ন গাছে বিভিন্ন সুগন্ধি পুস্প ভরে আছে। যাহার সুবাস বাতাস বহুদূর অবধি বহন করে নিয়ে যায়। আর মিষ্ট কতশত ফলে বৃক্ষ গুলি সজ্জিত হয়ে আছে। এই সুন্দর কানন প্রহরা দেয় তিন কোটি অত্যাচারী গন্ধর্ব। গন্ধর্বেরা খবর পেলো। শোনা মাত্রই হৈহৈ করে ছুটে এলো । এত সংখ্যক অয্যোধ্যার সেনাকে দেখে হাস্য করতে লাগলো। কারণ সংখ্যায় অল্প হলেও গন্ধর্বেরা ভাবল মায়াবিদ্যার সহায়তায় অল্প সময়ে এই সমস্ত কিছু নাশ করে দেবে । ভরতের নির্দেশ পেতেই সেনারা যুদ্ধে এগিয়ে গেলো। বর্শা, শর ইত্যাদি গন্ধর্ব দের দিগকে ছুড়তে লাগলো। গন্ধর্বেরা মায়া বিদ্যার সহায়তায় সেই সকল অস্ত্র চূর্ণ করতে আরম্ভ করলো। গন্ধর্বেরা খড়্গ, দিব্যদণ্ড, তরবারি নিয়ে যুদ্ধে অগ্রসর হল। যুদ্ধের সময় তারা বিভিন্ন মায়ার আশ্রয় নিতে লাগলো। অদৃশ্য হয়ে অয্যোধ্যার সেনাদের ওপর আঘাত হানতে লাগলো। মায়া দ্বারা বৃহৎ প্রস্তর রূপ ধারণ করে অয্যোধ্যার সেনাদের ওপর পড়তে লাগলো।

মায়া আক্রমণে অয্যোধ্যার সেনারা কোণঠাসা হচ্ছিল্ল। রক্তনদীর ধারা গিয়ে সিন্ধু নদে মিশল। চারিদিকে কেবল অসংখ্য মৃত শব দেখা গেলো। কিছু গন্ধর্ব আবার মায়া দ্বারা নানা অস্ত্র ভরতের দিকে নিক্ষেপ করতে লাগলো। তক্ষ ও পুষ্কর তখন বিবিধ দিব্যাস্ত্রের সন্ধান করে গন্ধর্ব দের অস্ত্র গুলি চূর্ণ করতে লাগলো। দুই বালকের বীক্রম দেখে গর্বে ভরতের বুক ফুলে উঠলো। এই ত হলেন বীর সূর্যবংশী। লবকুশের ভ্রাতা এমনই শক্তিমান হওয়ার প্রয়োজন । চোখের পলকে নানা অস্ত্র নিক্ষেপ করে গন্ধর্ব দের অস্ত্র নষ্ট করতে লাগলো। ভরত নিজেও যুদ্ধে অগ্রসর করলেন। কিন্তু নানা দিব্যাস্ত্রে গন্ধর্বেরা ধ্বংস হল না। উলটে নানা মায়া বিদ্যা প্রয়োগ করে ভরতকে অতীষ্ঠ করে তুলল। তখন ভরত ধনুকে সেই গন্ধর্বনাশক ‘সংবর্ত’ অস্ত্রের আহ্বান করলেন। প্রবল বিক্রমশালী সংবর্ত অস্ত্র ভরতের ধনুকে আপন মহিমায় আবির্ভূত হলেন । ভরত মন্ত্র পড়ে সেই বাণ ছুঁড়লেন। অতি উজ্জ্বল আলো উৎপন্ন হয়ে সেই অস্ত্র গন্ধর্ব দের দিকে ধেয়ে গেলো। সেই দেখে গন্ধর্বদের ভয়ে যেনো মুখ- হাত- পা শুকিয়ে গেলো। অনেক মায়াবিদ্যা, অনেক অস্ত্র ছুড়লেও ভরতের নিক্ষেপিত অস্ত্র বিফল হল না । নিমিষে সেই অস্ত্র তিন কোটি শক্তিশালী গন্ধর্বকে ছিন্নবিছিন্ন করে দিলো। গন্ধর্বদের রক্ত মাংসে মেদিনী ঢাকা পড়লো। মাংসাশী প্রানীরা তাহা ভক্ষণ করতে লাগলো। যুদ্ধে ভরত জয়লাভ করলেন । এরপর মহারাজ শ্রীরামের আদেশে সেই বিজিত রাজ্য দুভাগ করে দুই পুত্রকে দিলেন । ‘তক্ষশীলা’ নামক রাজ্যের রাজা হলেন ভরতের এক পুত্র তক্ষ। অপর পুত্র পুষ্কর ‘পুষ্করাবতী’ রাজ্যের রাজা হলেন । ভরত সেই বিজিত রাজ্য ‘তক্ষশীলা’ , ‘পুষ্করাবতী’ নামক রাজ্যে ভাগ করেছিলেন । শ্রীরামচন্দ্র ইহা শুনে অতীব প্রসন্ন হলেন। এইভাবে মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র এগাড়ো হাজার বর্ষ রাজত্ব করেছিলেন।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

4506744

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।