২৫ নভেম্বর ২০১৬

রামায়ণ কথা ( উত্তরকাণ্ড পর্ব –২৬)

একদা ভগবান শ্রীরাম দণ্ডকারণ্যে অগ্যস্ত মুনির সাথে দেখা করতে গেলেন । অগ্যস্ত মুনি ছিলেন শ্রীরামের আরেক গুরু। যিঁনি পূর্বে অনেক অস্ত্রাদি দিয়েছিলেন । অগ্যস্ত মুনি শ্রীরামকে অনেক কিছু উপহার দিলেন। অতি মূল্যবাণ অলঙ্কারাদি দিলেন । অগ্যস্ত মুনি বললেন- “হে শ্রীরাম সত্য যুগে ব্রাহ্মণ কে দেবতা জ্ঞানে পূজা করা হত। চারযুগে ব্রাহ্মণই রাজার পথ প্রদর্শন করেন । হে শ্রীরাম , যেমন স্বর্গে দেবেন্দ্র ইন্দ্রদেবতা দেবতাদিগের রাজা হয়ে দেবতাদিগকে পালন করেন তেমনি মর্তে ব্রাহ্মণ গন রাজাকে পালন করেন। ব্রাহ্মণের বিধান সমাজে কার্যকারী করাই রাজার ধর্ম। ব্রাহ্মণের বিধান অস্বীকার করলে সমাজে বিশৃঙ্খলা উৎপন্ন হয়, দেবতারা রুষ্ট হন।” এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন- বাল্মিকী রামায়নের উত্তরকাণ্ডে ব্রাহ্মণের অনেক প্রশংসা আছে। এগুলোই সার। অথচ আজকের যুগে কানে ফুসমন্তর দেওয়া সোসাইটির পাল্লায় পড়ে সনাতন আদর্শ বিসর্জন দিয়ে বিদেশী ভাবধারায় গা ভাসিয়ে ব্রাহ্মণ কে অপমান করছি। কোন পূজার পর পূজক পুরোহিত ব্রাহ্মণের সাথে দক্ষিণা নিয়ে ঝগড়া করা যেমন অসভ্যতামির লক্ষণ তেমনি তা চূড়ান্ত পাপ। আর পূজার পর প্রথমে প্রসাদ পূজক ব্রাহ্মণকে ভোজন করিয়ে অন্য সকলের নেওয়া উচিৎ। নচেৎ পূজার ফল হয় শূন্য। ওতে দেবতা রুষ্ট হন । যাই হোক, ভগবান শ্রীরাম বললেন- “হে মহর্ষি! আপনার কথন শিরোধার্য । আমার একটি প্রশ্ন আছে। এই সুন্দর অরণ্য দণ্ড কারণ্য নাম কিভাবে হল?” অগ্যস্ত মুনি বললেন- “হে শ্রীরাম! এ অনেক পুরানো ঘটনা। এই ঘটনার সাথে জড়িয়ে আছে এক কামুক রাজার আস্ফালন, এক লাঞ্ছিতা নারীর ক্রন্দন, এক পিতার অভিশাপ। এই ঘটনা প্রমান করে স্ত্রী জাতির ওপর অত্যাচার করলে কি ভয়ানক ফল হয়।”

অগ্যস্ত মুনি ঘটনা আরম্ভ করলেন। বহু পূর্বে ঋষশৃঙ্গ ও ঋক্ষ পর্বতের মাঝে এক সুন্দর রাজ্য ছিলো। সেই রাজ্য বিদর্ভ নামে খ্যাত ছিলো। একদিনের কথা। সেই রাজ্যের রাজা ছিলেন রাজা দণ্ড। দণ্ড রাজা মধু নামক এক পুরী নির্মাণ করে রাজত্ব চালায় । সেই রাজা জিতেন্দ্রিয়, প্রজা পালক ও সদাচারী ছিলেন । একদিন সেই রাজা তপস্যার কারণে এই বনে আসে। এই বনে এসে কিছুকাল বিষ্ণু তপস্যা করেন। তপস্যা সম্পূর্ণ হয় নি সেই রাজার । তখন চৈত্র মাস। বসন্ত ঋতুতে কামদেবের প্রভাব অতিশয় বিস্তৃতি লাভ করে। বসন্ত ঋতুতে এই বন অতি সুন্দর শোভা ধারণ করেছিলো। চতুর্দিকে পক্ষী , কোকিলের চিত্তহরণকারী কলরব ও বিবিধ সুবাসিত পুস্পের ঘ্রান রাজা দণ্ডের মনে অত্যন্ত কাম প্রভাব বিস্তৃত করেছিলো। ফাল্গুন ও চৈত্র মাসকে বসন্ত ঋতু বলে। এই মাসে কামপ্রভাব সব থেকে বেশী হয় । মধুমাসে বনের এইরূপ সৌন্দর্য ও যুগল পক্ষী- জন্তু দেখে রাজা দণ্ড কামশরে জর্জরিত হলেন। উন্মত্তের ন্যায় তিনি কামের বশবর্তী হয়ে ছুটে বেড়াতে লাগলেন । সেই সময় এই স্থানে অসুরগুরু শুক্রাচার্যের কন্যা অরজা পুস্প চয়নে এসেছিলেন। সদ্য যৌবনে প্রবেশ করা অরজার রূপ লাবণ্য ছিলো অভূতপূর্ব । অষ্টাদশী চঞ্চলা যুবতী পুস্প সাজে সজ্জিতা হয়ে পুস্প চয়ন করছিলেন । তাহার রূপে মগ্ন হয়েছিলেন রাজা দণ্ড। সেই যুবতীকে কামুক দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করছিলেন সেই রাজা। অপরদিকে শুক্র কন্যা অরজা এসব জানতেন না। তিনি আপন মনে পুস্প চয়নে নিরত। বিবিধ বর্ণের প্রজাপতি সেই কন্যার সর্বাঙ্গে খেলা করছিলো। কন্যার উজ্জ্বল বর্ণ, অঙ্গে পুস্প সুবাসে মোহিত হয়ে প্রজাপতির দল তাহাকেই পুস্প মনে করে তাহার ওপর এসে এসে বসছিলো। হঠাত রাজা দণ্ড এসে বলল- “হে সুন্দরী! হে মধুমুখী! তুমি কে? তোমাকে দেখা মাত্র আমি কামে বশীভূত হয়েছি।”

দেখিয়া কন্যার রূপ কামে অচেতন ।
হস্তেতে ধরিয়া কহে মধুর বচন ।।
কাহার যুবতী তুমি কন্যা বল কার ।
অবশ্য কহিবে মোরে সত্য সমাচার ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

অরজা ভয় পেয়ে বললেন- “হে রাজন! এমন বাক্য কহিবেন না। আমি অসুর গুরু শুক্রের কন্যা। আমার পিতা আপনার গুরুতুল্য।” দণ্ড রাজা বলল- “হে সুন্দরী! আমাকে আলিঙ্গন দাও। তোমার আলিঙ্গন ব্যতীত আর বুঝি প্রাণ ধরে না। আমি সত্য বচন করছি, আমি তোমাকেই বিবাহ করবো। তুমিই হবে রানী। কিন্তু এই মুহূর্তে আমাকে রতিদান করে আমার জ্বালা নিবারণ করো। তুমি রাণী হবে। শত শত দাসী তোমার সেবা করবে। স্বর্ণ অলঙ্কারে আচ্ছাদিত থাকবে তোমার সুন্দর দেহ।”

রাজা বলে তব রূপে প্রাণ নাহি ধরি ।
প্রানরক্ষা কর মোর শুন লো সুন্দরী ।।
আমার রমণী হৈলে হব তব দাস ।
তোমা বিনা আর নারী না লইব পাশ ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

অরজা বললেন- “এ হয় না রাজন। আমি পিতার অধীন। আপনি আমার পিতার নিকট আমার পাণি প্রার্থনা করুন। এই মুহূর্তে আপনার আশা আমি পূর্ণ করতে পারি না। আপনি আমাকে দয়া করে কুপ্রস্তাব প্রদান করবেন না। আমার পিতা জানতে পারলে তিঁনি শাপ দিয়ে আপনাকে ভস্ম করবেন।” কামে জর্জরিত ব্যাক্তি কামক্রীড়ায় সারা না পেলে পশু রূপ ধারণ করেন। রাজা দণ্ড তাই করলেন। বললেন- “হে সুন্দরী! তোমার সৌন্দর্য দর্শনের পর আমার মন অতি চঞ্চল হয়েছে। যদি আমার প্রস্তাবে রাজী না হও, যদি আমাকে রতিদান না করো- তবে তোমাকে বল পূর্বক ভোগ করবো।” ভয়ে যুবতী রাজার চরণে পরে অনেক কাকুতি মিনতি করলেও রাজা নিবৃত্ত হল না। অরজা কে জোর করে ধর্ষণ করলো । অরজার সাথে জোর করে কামক্রীড়া করে রাজা দণ্ড বিদায় নিলেন। আলুলায়িত, ধূলাময় অঙ্গে কন্যা ‘হা পিতা’ বলে ক্রন্দন করে শুক্রের আশ্রমে গেলো। অরজা সেই ভয়ানক স্মৃতিতে এত ভয় পেয়েছিলো যে সে কেবল পিতার সম্মুখে ক্রন্দন করলো। কিছুই বলতে পারলো না। । শুক্র ক্রোধে অন্ধ হয়ে ধ্যানে বসে দেখলেন রাজা দণ্ড এইরূপ জঘন্য পাপ করেছে । শুক্র বললেন- “সেই দুরাচারী রাজা দণ্ড আমার পুত্রীর এই রূপ সর্বনাশ করেছে। এখন ত্রিজগৎ দেখবে আমি রাজা দণ্ডের কি অবস্থা করি। আমি ভৃগু বংশীয় ব্রাহ্মণ। আমি রাজা দণ্ডকে অভিশাপ দিলাম সে তার পাত্র- মিত্র- অতিথি- অনুচর মন্ত্রী- সেনাপতি, প্রাসাদ- সেনা সহ পুরে মড়বে। দেবরাজ ইন্দ্র তাহার রাজ্যে জলন্ত অঙ্গারের বৃষ্টি করবেন।”

( ক্রমশঃ)
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।