
অগ্যস্ত মুনি ঘটনা আরম্ভ করলেন। বহু পূর্বে ঋষশৃঙ্গ ও ঋক্ষ পর্বতের মাঝে এক সুন্দর রাজ্য ছিলো। সেই রাজ্য বিদর্ভ নামে খ্যাত ছিলো। একদিনের কথা। সেই রাজ্যের রাজা ছিলেন রাজা দণ্ড। দণ্ড রাজা মধু নামক এক পুরী নির্মাণ করে রাজত্ব চালায় । সেই রাজা জিতেন্দ্রিয়, প্রজা পালক ও সদাচারী ছিলেন । একদিন সেই রাজা তপস্যার কারণে এই বনে আসে। এই বনে এসে কিছুকাল বিষ্ণু তপস্যা করেন। তপস্যা সম্পূর্ণ হয় নি সেই রাজার । তখন চৈত্র মাস। বসন্ত ঋতুতে কামদেবের প্রভাব অতিশয় বিস্তৃতি লাভ করে। বসন্ত ঋতুতে এই বন অতি সুন্দর শোভা ধারণ করেছিলো। চতুর্দিকে পক্ষী , কোকিলের চিত্তহরণকারী কলরব ও বিবিধ সুবাসিত পুস্পের ঘ্রান রাজা দণ্ডের মনে অত্যন্ত কাম প্রভাব বিস্তৃত করেছিলো। ফাল্গুন ও চৈত্র মাসকে বসন্ত ঋতু বলে। এই মাসে কামপ্রভাব সব থেকে বেশী হয় । মধুমাসে বনের এইরূপ সৌন্দর্য ও যুগল পক্ষী- জন্তু দেখে রাজা দণ্ড কামশরে জর্জরিত হলেন। উন্মত্তের ন্যায় তিনি কামের বশবর্তী হয়ে ছুটে বেড়াতে লাগলেন । সেই সময় এই স্থানে অসুরগুরু শুক্রাচার্যের কন্যা অরজা পুস্প চয়নে এসেছিলেন। সদ্য যৌবনে প্রবেশ করা অরজার রূপ লাবণ্য ছিলো অভূতপূর্ব । অষ্টাদশী চঞ্চলা যুবতী পুস্প সাজে সজ্জিতা হয়ে পুস্প চয়ন করছিলেন । তাহার রূপে মগ্ন হয়েছিলেন রাজা দণ্ড। সেই যুবতীকে কামুক দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করছিলেন সেই রাজা। অপরদিকে শুক্র কন্যা অরজা এসব জানতেন না। তিনি আপন মনে পুস্প চয়নে নিরত। বিবিধ বর্ণের প্রজাপতি সেই কন্যার সর্বাঙ্গে খেলা করছিলো। কন্যার উজ্জ্বল বর্ণ, অঙ্গে পুস্প সুবাসে মোহিত হয়ে প্রজাপতির দল তাহাকেই পুস্প মনে করে তাহার ওপর এসে এসে বসছিলো। হঠাত রাজা দণ্ড এসে বলল- “হে সুন্দরী! হে মধুমুখী! তুমি কে? তোমাকে দেখা মাত্র আমি কামে বশীভূত হয়েছি।”
দেখিয়া কন্যার রূপ কামে অচেতন ।
হস্তেতে ধরিয়া কহে মধুর বচন ।।
কাহার যুবতী তুমি কন্যা বল কার ।
অবশ্য কহিবে মোরে সত্য সমাচার ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )
অরজা ভয় পেয়ে বললেন- “হে রাজন! এমন বাক্য কহিবেন না। আমি অসুর গুরু শুক্রের কন্যা। আমার পিতা আপনার গুরুতুল্য।” দণ্ড রাজা বলল- “হে সুন্দরী! আমাকে আলিঙ্গন দাও। তোমার আলিঙ্গন ব্যতীত আর বুঝি প্রাণ ধরে না। আমি সত্য বচন করছি, আমি তোমাকেই বিবাহ করবো। তুমিই হবে রানী। কিন্তু এই মুহূর্তে আমাকে রতিদান করে আমার জ্বালা নিবারণ করো। তুমি রাণী হবে। শত শত দাসী তোমার সেবা করবে। স্বর্ণ অলঙ্কারে আচ্ছাদিত থাকবে তোমার সুন্দর দেহ।”
রাজা বলে তব রূপে প্রাণ নাহি ধরি ।
প্রানরক্ষা কর মোর শুন লো সুন্দরী ।।
আমার রমণী হৈলে হব তব দাস ।
তোমা বিনা আর নারী না লইব পাশ ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )
অরজা বললেন- “এ হয় না রাজন। আমি পিতার অধীন। আপনি আমার পিতার নিকট আমার পাণি প্রার্থনা করুন। এই মুহূর্তে আপনার আশা আমি পূর্ণ করতে পারি না। আপনি আমাকে দয়া করে কুপ্রস্তাব প্রদান করবেন না। আমার পিতা জানতে পারলে তিঁনি শাপ দিয়ে আপনাকে ভস্ম করবেন।” কামে জর্জরিত ব্যাক্তি কামক্রীড়ায় সারা না পেলে পশু রূপ ধারণ করেন। রাজা দণ্ড তাই করলেন। বললেন- “হে সুন্দরী! তোমার সৌন্দর্য দর্শনের পর আমার মন অতি চঞ্চল হয়েছে। যদি আমার প্রস্তাবে রাজী না হও, যদি আমাকে রতিদান না করো- তবে তোমাকে বল পূর্বক ভোগ করবো।” ভয়ে যুবতী রাজার চরণে পরে অনেক কাকুতি মিনতি করলেও রাজা নিবৃত্ত হল না। অরজা কে জোর করে ধর্ষণ করলো । অরজার সাথে জোর করে কামক্রীড়া করে রাজা দণ্ড বিদায় নিলেন। আলুলায়িত, ধূলাময় অঙ্গে কন্যা ‘হা পিতা’ বলে ক্রন্দন করে শুক্রের আশ্রমে গেলো। অরজা সেই ভয়ানক স্মৃতিতে এত ভয় পেয়েছিলো যে সে কেবল পিতার সম্মুখে ক্রন্দন করলো। কিছুই বলতে পারলো না। । শুক্র ক্রোধে অন্ধ হয়ে ধ্যানে বসে দেখলেন রাজা দণ্ড এইরূপ জঘন্য পাপ করেছে । শুক্র বললেন- “সেই দুরাচারী রাজা দণ্ড আমার পুত্রীর এই রূপ সর্বনাশ করেছে। এখন ত্রিজগৎ দেখবে আমি রাজা দণ্ডের কি অবস্থা করি। আমি ভৃগু বংশীয় ব্রাহ্মণ। আমি রাজা দণ্ডকে অভিশাপ দিলাম সে তার পাত্র- মিত্র- অতিথি- অনুচর মন্ত্রী- সেনাপতি, প্রাসাদ- সেনা সহ পুরে মড়বে। দেবরাজ ইন্দ্র তাহার রাজ্যে জলন্ত অঙ্গারের বৃষ্টি করবেন।”
( ক্রমশঃ)
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন